কলকাতার চিঠি

অব্যাহত মমতা-ঝড়

মমতা ব্যানার্জি
মমতা ব্যানার্জি

পশ্চিমবঙ্গজুড়ে মমতা-ঝড় বয়েই চলেছে। এই ঝড়ের প্রধান ঝাপটা এখন পড়ছে কংগ্রেসের ওপর। কংগ্রেসের সাজানো বাগান তছনছ করে দিচ্ছে এই ঝড়। বাদ যায়নি বাম দলও। তবে তাদের দিকে এই ঝড়ের ঝাপটা কিছুটা কম লেগেছে।
গত ২৭ মে দ্বিতীয় দফায় পশ্চিমবঙ্গের শাসনক্ষমতায় আসেন মমতা। হন মুখ্যমন্ত্রী। ক্ষমতায় আসার পর মমতার দুই সেনাপতি রাজ্য-মন্ত্রী বিধায়ক শুভেন্দু অধিকারী আর সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গ থেকে কংগ্রেসের শেষ ঠিকানাটুকু মুছে দেওয়ার জন্য আদাজল খেয়ে মাঠে নামেন। কজন মন্ত্রীও ঘোষণা দেন এই রাজ্যপাট থেকে মুছে দিতে হবে বিরোধী দলের অস্তিত্ব। প্রথম টার্গেট করে মুর্শিদাবাদ জেলাকে। মুর্শিদাবাদ এই রাজ্যে কংগ্রেসের দুর্গ হিসেবে পরিচিত। এখানের নেতাও দোর্দণ্ড প্রতাপের। অধীর চৌধুরী। অধীর চৌধুরী পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কংগ্রেসের সভাপতিও। সাংসদ। ছিলেন কংগ্রেস আমলে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীও। ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে যখন মমতা-ঝড়ে তছনছ হচ্ছিল বিরোধীরা, তখনো মুর্শিদাবাদকে নোয়াতে পারেননি মমতা। মুর্শিদাবাদ কংগ্রেসের ঘাঁটি হিসেবেই অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছিল।
এ বছরের এপ্রিল-মে মাসে অনুষ্ঠিত ফের বিধানসভা নির্বাচনে মমতা বিধানসভার ২৯৪ আসনের মধ্যে ২১১টি জিতলেও অস্তিত্ব মুছে দিতে পারেনি কংগ্রেসের। কংগ্রেসই পৌঁছেছিল দ্বিতীয় স্থানে। পেয়েছিল ৪৪টি আসন। আর তৃতীয় স্থান পায় বাম দলেরা। তাদের ভাগ্যে জোটে ৩২টি আসন। ফলে বিধানসভায় বিরোধী দলের নেতার আসনটি পায় কংগ্রেস। নেতা হন কংগ্রেসের আবদুল মান্নান।
মমতার এই বিপুল বিজয়ের পর সংবিৎ ফিরে পান মমতা নিজেই। আর তো এই রাজ্যে কংগ্রেসের অস্তিত্ব রাখা যাবে না? কংগ্রেসকে করতে হবে সাইনবোর্ডের দল। ডাক পড়ে দুই নেতা শুভেন্দু অধিকারী আর অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের। অভিষেক মমতার ভাইয়ের ছেলে। মাঠে নেমে পড়েন দুজন। যেকোনো মূল্যে মুছে দিতে হবে এই রাজ্যের কংগ্রেসের অস্তিত্বকে। সেই সঙ্গে বাম দলেরও। ব্যস, যেই কথা সেই কাজ। মমতার এই দুই বিশ্বস্ত সৈনিক শুরু করেন মুর্শিদাবাদ থেকে কংগ্রেসকে মুছে দেওয়ার কাজ। কংগ্রেসের নেতা আবদুল মান্নান বলেছেন, অর্থ আর পুলিশি ভয় দিয়ে একে একে দখল করা হয়েছে মুর্শিদাবাদ জেলার পৌরসভাগুলো। সুস্থ গণতন্ত্রে এটা চলতে পারে না। কংগ্রেস–শাসিত সাতটি পৌরসভারই দখল নেয় তারা। ভাবা যায়, যুগ যুগ ধরে যে কংগ্রেস মুর্শিদাবাদের মাটির সঙ্গে মিশে ছিল, তা শুভেন্দু আর অভিষেকের কেরামতিতে বদলে যায়! মমতা দখল করেন শুধু সাতটি পৌরসভা নয়, মুর্শিদাবাদ জেলা পরিষদও। নতুন করে পতাকা ওঠে তৃণমূলের। বলা বাহুল্য, ২০১১ সালের পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস বিজয়ী হলেও মুর্শিদাবাদের দখল নিতে পারেনি। এবারের বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস মুর্শিদাবাদের ২২টি বিধানসভা আসনের মধ্যে ১৪টি জিতে তাদের দলীয় অবস্থানকে অক্ষত রেখেছিল। তৃণমূল পেয়েছিল ৪টি আর বাম দলও পেয়েছিল ৪টি আসন। শুধু মুর্শিদাবাদই নয়, আরও বেশ কয়েকটি পৌরসভা এবং গ্রাম পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতির দখল নিয়েছেন তাঁরা।
সব থেকে ব্যতিক্রম ঘটেছে দার্জিলিংয়ে। দার্জিলিং গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার দখলে রয়েছে। নেতা হলেন গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার প্রধান বিমল গুরুং। মমতা প্রথমবারের মতো ক্ষমতায় এসে দার্জিলিংয়ে পৃথক গোর্খাল্যান্ড রাজ্যের আন্দোলনকে স্তব্ধ করে সেখানে বিমল গুরুংয়ের নেতৃত্বে গড়েছিলেন জিটিএ বা গোর্খা টেরিটরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন। সেই জিটিএতেও ভাগ বসিয়েছেন মমতা। জিটিএর দ্বিতীয় ক্ষমতাধর নেতাকে নিজের দলে টেনে নিতে সমর্থ হয়েছেন মমতা। এমনকি গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার সাধারণ সম্পাদক রোশন গিরির বোনকেও নিজের দলে নিতে পেরেছেন তিনি। তাই দার্জিলিংয়ে তৃণমূলের পতাকা তুলতে সমর্থ হয়েছেন মমতা।
আর শিলিগুড়ি? শিলিগুড়ি পৌর করপোরেশনই পশ্চিমবঙ্গের একটি দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছে, যেখানে ক্ষমতায় রয়েছে বাম দল। মেয়র বাম নেতা ও সাবেক রাজ্যমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্য। শিলিগুড়ি করপোরেশনও দখল নেওয়ার জন্য মমতা মাঠে নেমেছেন। এখানের সৈনিক করেছেন তৃণমূল নেতা ও সাবেক মেয়র গৌতম দেবকে। গৌতম দেবও মমতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে শিলিগুড়ির বাম দুর্গকে ভেঙে তছনছ করার জন্য মাঠে নেমেছেন। তাই বলতে হয়, সত্যিই মমতার বৃহস্পতি তুঙ্গে।
আর সিঙ্গুর, তার তো কথাই নেই। দীর্ঘ ১০ বছর লড়ে জমি ফেরত পাওয়ার আন্দোলনে জয়ী হয়ে মমতা এখন সিঙ্গুরের টাটার স্থায়ী স্থাপনা ডিনামাইট দিয়ে ভেঙেচুরে সেই জমি কৃষিজমির রূপ দিয়ে জমির মালিকদের ফেরত দেওয়া শুরু করেছেন সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে। মমতা জয়ী হয়েছেন জমি অধিগ্রহণ মামলায়। এই সিঙ্গুরেই টাটা গোষ্ঠীকে সাবেক বামফ্রন্ট সরকার ২০০৬ সালে টাটার ন্যানো গাড়ির কারখানা গড়ার জন্য ৯৯৭ একর জমি দিয়েছিল কৃষকদের কাছ থেকে জমি অধিগ্রহণ করে। এতে সায় ছিল না একাংশ জমিদাতার। তাঁদের নিয়েই মমতা আন্দোলনে নেমে দেখিয়ে দেন মমতা যা বলেন, তা-ই করেন। মমতা কথা দিয়েছিলেন সিঙ্গুরের জমি ফেরত দেবেন জমিদাতাদের। এবার দিয়েছেন।
কিন্তু সবকিছুর পর একটি কথা থেকে যায়। মমতা এবং তাঁর দলের নেতা-কর্মীরা যেভাবে বিরোধী দলকে ভাঙার খেলায় মেতেছেন, রাজ্যপাট থেকে বিরোধী দলের অস্তিত্ব মুছে দেওয়ার লড়াইয়ে ব্রতী হয়েছেন, তা কি সত্যি সুস্থ গণতন্ত্রের পক্ষে ইতিবাচক? যদিও মমতা ইতিমধ্যে কংগ্রেস ও বাম দলের অন্তত পাঁচজন বিধায়ককে তাঁদের দলে টেনে নিতে সমর্থ হয়েছেন। এ নিয়ে মমতার বিধানসভায় সদস্যসংখ্যা বেড়ে ২১৬ হয়েছে। কেউ কেউ বলেন, মমতার লক্ষ্য এবার বিধানসভার ২৯৪টি আসনই দখল করা। বিধানসভাকে বিরোধীশূন্য করা। এটা কি পারবেন মমতা তাঁর শক্তি এবং ক্ষমতা দিয়ে? কারণ, বাম দলও ৩৪ বছর শাসন করে শেষ পর্যন্ত টিকতে পারেনি। বাম বিরোধী জনজোয়ারে ২০১১ সালে হারিয়ে গিয়েছিল তারা। মমতার ভাগ্যে ভবিষ্যতে সেই ফলাফলই কি অপেক্ষা করছে? কারণ, রাজনীতিতে শেষ কথা বলতে নেই। ঘটেও যেতে পারে এমন ঘটনা। কারণ, এবারের বিধানসভা নির্বাচনে মমতা বিরোধী দলের চেয়ে মাত্র ৩০ লাখ বেশি ভোটে জিতেছিলেন। তবে আসন পেয়েছিলেন বেশি। তাই ফের এই রাজ্যে মমতাবিরোধী ঝড় উঠলে এবং মমতার সাজানো বাগান তছনছ হলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। তবে সেই ঝড়কে সামাল দিতে মাঠে তৈরি রয়েছে মমতার বাহিনী।
অমর সাহা: প্রথম আলোর কলকাতা প্রতিনিধি।