আইনের শাসন

অবিশ্বাস্য ঘটনাই যখন স্বাভাবিক

গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের ক্রনিকেল অব আ ডেথ ফরটোল্ড (বাংলায় অনূদিত হয়েছে পূর্বঘোষিত একটি মৃত্যুর কালপঞ্জি হিসেবে) যাঁরা পড়েছেন তাঁরা জানেন, কীভাবে সান্তিয়াগো নাসারকে হত্যা করা হয়েছিল। ঘোষণা দিয়ে এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল। গ্রামের সবাই জানত, সান্তিয়াগোকে মেরে ফেলা হবে, শুধু জানত না সান্তিয়াগো নিজে। এবং হত্যাকাণ্ডটি ঠিকমতোই ঘটে। ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহানকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে, তার সঙ্গে এর কিছুটা হলেও মিল রয়েছে।

নুসরাতকে কীভাবে গায়ে আগুন দিয়ে হত্যার পরিকল্পনা হয়েছে, তা এখন আমরা জানতে শুরু করেছি। পুরো গ্রাম না জানলেও জনা বিশেক লোক জানতেন, নুসরাতের গায়ে আগুন দেওয়া হবে। ঘটনার দুই দিন আগে এই পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়েছে। যাঁরা এই ঘটনা ঘটাবেন, তাঁরা দুই দিন ধরে এর প্রস্তুতি নিয়েছেন। কেরোসিন তেল, বোরকা ও হাতমোজা কিনেছেন। এবং নির্ধারিত সময়ে সেই কাজটি তাঁরা ‘সাফল্যের’ সঙ্গে সেরেছেন। ক্রোধের বশে বোধবুদ্ধি হারিয়ে মানুষ অনেক কিছু করে ফেলে। এটা তেমন কোনো ঘটনা নয়। নুসরাতের গায়ে আগুন দেওয়া বা হত্যার পরিকল্পনার পর অন্তত ৪৮ ঘণ্টা সময় পাওয়া গিয়েছিল। এই সময়ে কারও মনের মধ্যেই এই বোধ জাগল না যে এমন একটি কাজ করা ঠিক হবে না! এমনকি এর পরিণতি কী হতে পারে, সেই চিন্তাও কারও মাথায় ঢুকল না!

এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার কারণ আমরা অনুমান করতে পারি। সবাই সম্ভবত ধরে নিয়েছিলেন যে গায়ে আগুন দিয়ে নুসরাতকে মেরে ফেললেও কারও কিছু হবে না। তা না হলে এমন একটি কাজে এতগুলো মানুষ জড়িয়ে পড়েন কীভাবে! তাঁরা জানতেন যে তাঁদের সঙ্গে প্রভাবশালীরা রয়েছেন এবং যে ঘটনাই ঘটুক, তাঁরাই পরিস্থিতি সামাল দেবেন। ঘটনা সেভাবেই এগোচ্ছিল। সরকারি দলের স্থানীয় নেতা ছিলেন তাঁদের পক্ষে, থানার ওসির আচরণে মনে হয়েছে, তিনিও প্রস্তুত ছিলেন পরিস্থিতি সামাল দিতে। গোল বাধিয়েছে আগুনে পুড়ে নুসরাতের কিছু সময় বেঁচে থাকা, তাঁর জবানবন্দি ও অপরাধীদের শাস্তি দেওয়ার ব্যাপারে তাঁর কঠোর মনোবল। আহত নুসরাত যদি হাসপাতালে যাওয়ার পথে তাঁর ভাইয়ের কাছে ঘটনার বিবরণ দিতে না পারতেন, যদি তা রেকর্ড করা না হতো বা মারা যাওয়ার আগে যদি তিনি জবানবন্দি দিতে না পারতেন, তাহলে কী হতো? সম্ভবত ঘটনাটি একটি আত্মহত্যা হিসেবেই বিবেচিত হতো। স্থানীয় থানার ওসি সেই পথই ধরেছিলেন।

এ এক অস্বাভাবিক ও অবিশ্বাস্য পরিস্থিতি। একটি ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান যৌন নিপীড়নের মতো অপকর্ম করেছেন, এমন নজির অনেক সমাজে মিলবে। কিন্তু তাঁকে বাঁচানোর জন্য সেই প্রতিষ্ঠানের কিছু শিক্ষার্থী, স্থানীয় সরকারি দলের নেতা ও থানার ওসি এক হয়ে মাঠে নামবেন, এটা অস্বাভাবিক। আর অবিশ্বাস্য হচ্ছে, অভিযোগ তুলে নেওয়ার জন্য নিপীড়নের শিকার নুসরাতকে চাপ দেওয়া, এতে সফল না হলে তাঁকে পুড়িয়ে মারার সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং সেই কাজে জনা বিশেক লোকের যুক্ত থাকা। একটি স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও আইনের শাসন কায়েম আছে, এমন সমাজে তো এই পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার কথা নয়। আমরা তবে কোন বাস্তবতার মধ্যে আছি? গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থা আসলে কতটা শোচনীয়?

বিশ্বে গণতন্ত্রের মান কমেছে—এটা নতুন কোনো খবর নয়। এবং গণতন্ত্রের এই পতন চলছেই। ২০০৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১১৬টি দেশে গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার মান কমেছে। এই সময়ে মাত্র ৬৩টি দেশে গণতন্ত্রের মানের কিছু অগ্রগতি আছে। এই সময়কালে আমেরিকার মতো দেশের গণতন্ত্রের স্বাস্থ্যও ভেঙেছে। নাজুক হয়েছে ইউরোপের বেশ কিছু দেশের গণতন্ত্র। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ফ্রিডম হাউস প্রতি বছর গণতন্ত্রের সূচক প্রকাশ করে। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত সর্বশেষ সূচকে দেখা গেছে, ২০১৮ সালের ১২ মাসে ৬৮টি দেশে গণতন্ত্রের মান পড়েছে। রাজনৈতিক অধিকার ও নাগরিক স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হয়েছে। বাংলাদেশের মানও পড়েছে। আগের বছর বাংলাদেশ পেয়েছিল ৪৫ নম্বর, আর ২০১৮ সালে পেয়েছে ৪১ নম্বর।

২০১৮ সালের একদম শেষে বাংলাদেশে নির্বাচন হয়েছে। নির্বাচন সামনে রেখে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির গুমোট ভাব কিছুটা হলেও কেটেছিল। বিরোধীরা জোট করে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। ২০১৮ সালের গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশ জায়গা পেয়েছে ‘আংশিক মুক্ত’ দেশের কাতারে। এরপর ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের অভিজ্ঞতা আমাদের হয়েছে। আগামী সূচকে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের মান কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, তা দেখার জন্য আমাদের এই বছরের শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তবে অনেকেই বলবেন, আমেরিকা বা ইউরোপের কোনো কোনো দেশে যখন গণতন্ত্রের মান নামছে, তখন আমাদের এ নিয়ে এত হা–হুতাশ কেন? আর এখন তো ‘উন্নয়নের’ সময়, এটা চাইলে গণতন্ত্রে ছাড় দিতেই হবে। অবস্থা এখন এমন দাঁড়িয়েছে যে গণতন্ত্র বলে কিছুর যে আদৌ দরকার আছে, তা শুধু সরকার বা সরকারি দল নয়, অনেক বিশ্লেষক বা পর্যবেক্ষকও মনে করেন না।

উন্নয়নের ‘স্বার্থে’ গণতন্ত্রকে নাহয় আপাতত বাদ দেওয়া গেল। কিন্তু আইনের শাসনের অবস্থা কী? গণতন্ত্র ও আইনের শাসন মিলেমিশে চলে—এই যুক্তি অনেক দেবেন। বলবেন, গণতন্ত্র ঠিকমতো না চললে আইনের শাসন চলে কী করে! কিন্তু গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে সুনাম নেই, এমন অনেক দেশেও যে আইনের শাসন ভালোভাবে কাজ করে, সেই দৃষ্টান্ত রয়েছে। আমাদের দুই কুলই যাওয়ার দশা হয়েছে। গণতন্ত্রের অবস্থা খারাপ, আইনের শাসনও নামছে নিচের দিকে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা দ্য ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্ট (ডব্লিউজেপি) প্রতিবছর বৈশ্বিক আইনের শাসন সূচক প্রকাশ করে। সর্বশেষ সূচকে আগের বছরের তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থান আরও নিচে নেমেছে। ১১৩টি দেশের মধ্যে গত সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১০২। আর সর্বশেষ সূচকে ১২৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১১২।

এই সূচক তৈরির কাজে ৮টি বিষয় বিবেচনায় নেওয়া হয়। এগুলো হচ্ছে ১. সরকারের ক্ষমতার সীমা, ২. দুর্নীতির অনুপস্থিতি, ৩. উন্মুক্ত সরকার, ৪. মৌলিক অধিকার, ৫. আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা, ৬. আইন ও বিধিবিধান প্রয়োগ, ৭. দেওয়ানি বিচার, ৮. ফৌজদারি বিচার। এই বিষয়গুলোর মধ্যে মৌলিক অধিকারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান সবচেয়ে শোচনীয়। ১২৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১১৯। আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তায় অবস্থান ১১৬ নম্বরে আর ফৌজদারি বিচারে ১১৪। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে হতাশা আরও বাড়ে। আইনের শাসনের সূচকে নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও ভারত বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে আছে।

আগেই বলেছি, ফ্রিডম হাউসের গণতন্ত্রের সূচক অনুযায়ী বাংলাদেশ এখন ‘আংশিক মুক্ত’ দেশের তালিকায় রয়েছে। এবং ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন ও পরবর্তী পরিস্থিতির প্রভাব সামনের সূচকে পড়তে পারে। বর্তমান গণতন্ত্রের সূচকে বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে থাকা বা একেবারেই ‘মুক্ত নয়’; এমন অনেক দেশ আইনের শাসনের সূচকে বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে আছে। রাশিয়া, চীন, তুরস্ক, ইরান বা মিয়ানমারের মতো দেশের গণতন্ত্রের অবস্থা বাংলাদেশের চেয়ে খারাপ। কিন্তু আইনের শাসনের দিক দিয়ে এই দেশগুলো বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে। গণতন্ত্রের খামতি থাকলেও কোনো না কোনো মাত্রায় যে আইনের শাসন নিশ্চিত করা সম্ভব, এটা প্রমাণ। উন্নয়নের ‘স্বার্থে’ না হয় গণতন্ত্রকে ছাড় দিলাম। আইনের শাসনে আমরা ছাড় দিচ্ছি কিসের স্বার্থে?

গণতন্ত্রের মান নিচে নামছে, আইনের শাসনের অবস্থা শোচনীয়। এমন অবস্থায় ফেনীর সোনাগাজীতে ঘটে যাওয়া ঘটনাটিকে আর অস্বাভাবিক ও অবিশ্বাস্য ভেবে অবাক হওয়ার সুযোগ কই!

এ কে এম জাকারিয়া: প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক
akmzakaria@gmail.com