ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি, ‘কৃষি হলো পুরুষের কাজ। মাঠে-ময়দানে খাটাখাটুনি নারীদের দিয়ে হয় না। ওরা ঘরে কাজ করবে।’ কিন্তু বাস্তবে জমি চাষ করা থেকে শুরু করে বীজতলা তৈরি, ধান রোপণ, পাকা ধান ঘরে তোলা, ধান মাড়াই-বাছাই, সেদ্ধ করা, বীজ সংরক্ষণ, সবজি চাষ, মাছ চাষ, গবাদিপশু প্রতিপালনসহ যাবতীয় কাজের এক বড় অংশই করেন নারী। তার ওপর আছে রান্নাবান্না। সন্তান ধারণ ও লালন-পালন—সব, সব কাজ।
বেশির ভাগ কাজ করেও নারী কিন্তু তাঁর নাম-দাম তেমন কিছু পান না। এর একটি বড় কারণ সংসারের মূল কর্তা সাধারণত পুরুষ। জমি ও সহায়সম্পত্তির মালিকানা মূলত সংসারের কর্তার। এটাই যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। তাই কাজ যতই করুন, সংসারের ‘রিমোট কন্ট্রোল’টা পুরুষের হাতেই থাকে। তাই নারীর যথাযথ স্বীকৃতি এখনো তেমন নেই।
তাহলে কি নারীর কাজের যথাযথ মূল্যায়ন হবে না? এটা না হলে দেশে টেকসই কৃষিব্যবস্থা গড়ে তোলা কঠিন। বিশেষভাবে কোভিড–১৯ মহামারির এই দুঃসময়ে অনেকে শহরে চাকরি হারিয়ে গ্রামে চলে যাচ্ছেন। ফলে নারীর ওপর কাজের চাপ আরও বাড়ছে। তা ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে খাদ্যের জোগান ঠিক রাখার জন্য নারীর ওপর চাপ বাড়ছে। তাঁকে কৃষির যাবতীয় কাজের অনেকটা দায়িত্ব পালন করতে হয়।
অবদান রাখবেন অথচ যথাযথ স্বীকৃতি পাবেন না, এটা তো চলতে পারে না। বিষয়টি নিয়ে গত ২৯ নভেম্বর একশনএইড বাংলাদেশ একটি ভার্চ্যুয়াল গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে। সহযোগিতায় ছিল নেদারল্যান্ডস দূতাবাস। আলোচনা হয় ‘পারিবারিক কৃষিতে নারীর শ্রম ও টেকসই কৃষি’ নিয়ে। এর সম্প্রচার সহযোগী ছিল প্রথম আলো। আলোচনায় প্রাধান্য পায় পারিবারিক কৃষি, এর উন্নয়নে করণীয় প্রভৃতি।
আমরা এখনো ‘পারিবারিক কৃষি’ শব্দটির সঙ্গে খুব বেশি পরিচিত নই। যদিও ফসল উৎপাদনের পাশাপাশি বীজ সংরক্ষণ, শাকসবজি উৎপাদন, পুষ্টি নিশ্চিত করার জন্য সে সব সবজি খাদ্যতালিকায় নিয়ে আসা, মাছ চাষ, হাঁস-মুরগির খামার—সবকিছু সম্পর্কেই আমাদের ধারণা আছে। সামগ্রিকভাবে একেই আমরা পারিবারিক কৃষি বলতে পারি। এক হিসাব অনুযায়ী বিশ্বে উৎপাদিত মোট ফসলের ৮০ শতাংশই আসে পারিবারিক কৃষি থেকে। এবং এ ক্ষেত্রে নারীর একটা বড় অবদান রয়েছে। এই স্বীকৃতিটুকু খুব দরকার। আমাদের সনাতন ধারণা পুরোপুরি পাল্টে ফেলতে না পারলে কৃষি টেকসই হবে না।
‘নারী কৃষক’ বলে কোনো শব্দ বা ধারণা এখনো সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ধরে নেওয়া হয় ‘কৃষক’ মানেই তিনি হবেন একজন পুরুষ। তাই কৃষিতে যত ধরনের ভর্তুকির সুবিধা সরকার দেয়, ‘কৃষক কার্ড’ না থাকায় নারী কৃষকেরা অনেক ক্ষেত্রে তা গ্রহণ করতে পারেন না।
এই সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে জাতিসংঘ ২০১৯ থেকে ২০২৮ সাল পর্যন্ত সময়কালকে ‘পারিবারিক কৃষি দশক’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। এই সময়কালে যেন বাংলাদেশ কৃষিতে এগিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়, সে সম্পর্কে প্রয়োজনীয় সুপারিশগুলো সামনে নিয়ে আসাই ছিল আলোচনার উদ্দেশ্য।
একশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির নারীদের প্রশিক্ষণ, তাঁদের আত্মবিশ্বাসী করে তোলা এবং কৃষিতে তাঁদের অবদানের যথাযথ স্বীকৃতি প্রদানের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। পাশাপাশি তিনি নারীদের সমবায় গড়ে তুলে সংঘবদ্ধ শক্তি হিসেবে দাঁড়ানোর কথাও বলেন। নারী যেন কৃষি বাজারে তাঁর অবস্থান দৃঢ় করতে পারেন, তার ওপরও তিনি গুরুত্ব আরোপ করেন।
এখানে আমরা বলতে পারি যে সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে, যা কাজে লাগিয়ে নারী কৃষি উৎপাদনে আরও বেশি সম্পৃক্ত হতে পারেন। কিন্তু আইন থাকলেও তার বাস্তবায়ন খুব সহজ নয়। যেমন, সরকার যে কৃষক কার্ডের সুবিধা দিচ্ছে, তা নারীরা অনেক ক্ষেত্রে গ্রহণ করতে পারেন না। কারণ ‘নারী কৃষক’ বলে কোনো শব্দ বা ধারণা এখনো সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ধরে নেওয়া হয় ‘কৃষক’ মানেই তিনি হবেন একজন পুরুষ। তাই কৃষিতে যত ধরনের ভর্তুকির সুবিধা সরকার দেয়, ‘কৃষক কার্ড’ না থাকায় নারী কৃষকেরা অনেক ক্ষেত্রে তা গ্রহণ করতে পারেন না।
আবার জমিজমার মালিকানা মূলত স্বামী তথা পরিবারপ্রধানের, যিনি অবধারিতভাবে একজন পুরুষ, তাঁর নামে থাকে। ফলে কৃষির বিভিন্ন খাতে হাড়ভাঙা খাটুনি খাটলেও প্রাপ্য সম্মান ও স্বীকৃতি নারীর কপালে জোটে না। প্রচলিত সেকেলে এসব বিধি-ব্যবস্থা বদলে দেওয়ার সময় এসেছে। বদলাতে হবেই। না হলে কৃষিতে আমাদের অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হবে।
প্রশ্ন হলো, এই বদলানোর কাজটি কে করবে বা কীভাবে হবে? আমরা উৎসাহিত হয়েছি যে সেদিনের আলোচনায় কৃষি মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক (সিড উইং) বলাই কৃষ্ণ হাজরা উপস্থিত ছিলেন। আরও ছিলেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রকল্প পরিচালক মোয়াজ্জেম হোসেন। তাঁরা নিজেরা যেমন সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা বলেছেন, তেমনি আবার অন্যদের কথাও শুনেছেন। বিভিন্ন এলাকায় যাঁরা নারী কৃষকদের এগিয়ে নিতে কাজ করছেন তাঁদের আলোচনা ও সুপারিশগুলোর প্রতি উপস্থিত নীতিনির্ধারকেরা যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছেন।
কৃষিতে এখন আধুনিক প্রযুক্তির প্রচলন বাড়ছে। গ্রামে গ্রামে এখন পাওয়া টিলার, ট্রাক্টরে চাষ, কম্বাইন্ড হার্ভেস্টারে বীজ বপন ও ফসল কাটা শুরু হয়ে গেছে। বিদ্যুচ্চালিত পাম্পে সেচ প্রকল্প প্রায় সবখানেই আছে। তাই উপযুক্ত প্রশিক্ষণ পেলে নারীরাও ট্রাক্টর চালাবেন, সেচ প্রকল্প চালাবেন। কোনো কোনো অঞ্চলে নারীরা এখনই চালকের আসনে বসে গেছেন। কৃষিপণ্য বাজারজাত করাও তাঁদের জন্য সহজ হয়েছে। ফলে কৃষিতে নারী-পুরুষ সমতা অর্জন করে পুরো জনশক্তি ভালোভাবে ব্যবহারের সম্ভাবনা বাড়ছে। কৃষিতে জেন্ডার-সমতা আনতে পারলে সত্যিকারভাবেই আমাদের দেশে আরেকটি কৃষিবিপ্লব হয়ে যাবে।
ইতিমধ্যেই আমরা মাছ-মাংস ও শাকসবজি উৎপাদনে বিশ্ব তালিকায় ওপরের দিকে উঠে গেছি। খাদ্য উৎপাদনে এখন আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ। পুষ্টিতেও পিছিয়ে নেই। তাই এখন সময় এসেছে আমাদের সেকেলে ধ্যানধারণাগুলো ঝেড়ে ফেলার। আধুনিক বিশ্বের উচ্চতর ধ্যানধারণায় সমৃদ্ধ হয়ে কৃষির ক্ষেত্রে দেশকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে হবেই।
এটা অসম্ভব কিছু নয়। কেউ চাইলেও ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। আধুনিক বিশ্বের স্রোতোধারা আমাদের এগিয়ে নিয়ে যাবেই। শুধু সবার সম্মিলিত চেষ্টা ও সমন্বিত কাজ করতে আমরা কতটা প্রস্তুত, সেটাই দেখার বিষয়।
আব্দুল কাইয়ুম প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক