স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী

অবরুদ্ধ বাংলাদেশকে স্বাভাবিক দেখানোর চেষ্টা

একাত্তরে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধি হিসেবে ভারত সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেন মঈদুল হাসান। পরবর্তী সময়ে তিনি লিখেছেন মূলধারা ’৭১ এবং উপধারা একাত্তর, মার্চ-এপ্রিল নামে দুটি বই। বিভিন্ন দেশে অবমুক্ত হওয়া মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র ঘেঁটে ও তাঁর নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি লিখছেন আরও একটি বই। তাঁর প্রকাশিতব্য সেই বইয়ের দ্বাদশ অধ্যায়ের শেষ কিস্তি প্রকাশিত হলো আজ।

মঈদুল হাসান
মঈদুল হাসান

সোভিয়েত প্রতিনিধি গুরগিয়ানভের সঙ্গে তৃতীয় দফা বৈঠকের পর ৩০ জুন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে আলোচনার সময় সেদিন তাঁর মধ্যে একধরনের ব্যাকুল ভাব আমি লক্ষ করি। যদিও তিনি ছিলেন চাপা স্বভাবের মানুষ।

পূর্বঘোষণা অনুযায়ী, চার দিন পরই ৪ জুলাই ছিল ১৯৭০ সালে নির্বাচিত আওয়ামী লীগের জাতীয় পরিষদ সদস্য (এমএনএ) এবং প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যদের (এমপিএ) প্রথম সম্মেলন। একাত্তরের মে মাসের প্রথম দিকে বাংলাদেশ সরকারকে তাৎক্ষণিক স্বীকৃতিদানের অনুরোধে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী অসম্মত হওয়ার পর থেকে আওয়ামী লীগ মহলে এমন কথা প্রচার পেয়েছে যে পাকিস্তানের আক্রমণের ভয়ে ভারত ওই স্বীকৃতিদানে সম্মত নয়। তাজউদ্দীন সেই ভারত সরকারের ওপর নির্ভর করা ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের অন্য কোনো উপায় বের করার ক্ষেত্রে অদ্যাবধি অপারগ। অবস্থা যদি এমনই অসহায়ত্বের হয়, তবে পাকিস্তানের সঙ্গে মিটমাটের জন্য আমেরিকার সহায়তা লাভের চেষ্টা তো করা যায়। এমন যুক্তি আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যে প্রসার লাভ করতে শুরু করে।

ভারতের জনমতে পরিবর্তন

একই সময়ে ভারতের জনমতেও একটা বড় পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছিল। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও আসামে বাংলাদেশের শরণার্থীর সংখ্যা উত্তরোত্তর বেড়ে চলায় এসব প্রদেশের জনজীবন নানাভাবে দুর্বিষহ হয়ে পড়েছিল। শরণার্থীদের আশ্রয়ের জন্য মাসের পর মাস তাদের স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকা থেকে শুরু করে শ্রমবাজারের মজুরি পড়ে যাওয়া, জনস্বাস্থে৵র অধোগতি পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে তাদের উদ্বেগ ক্রমশ বেড়ে চলেছিল। শরণার্থীদের সংখ্যা জুন মাসের শেষে ৬০ লাখ অতিক্রম করার পর একটিই প্রশ্ন সর্বসাধারণের মধ্যে আলোচিত হয়ে চলেছিল, এ সংকটের পরিসমাপ্তি কোথায়?

বিধিব৵বস্থা উপেক্ষা করে শরণার্থীরা শ্রমবাজারে ঢুকে পড়ায় স্থানীয় অধিবাসীদের মজুরি ও আয়-উপার্জন সর্বত্র হ্রাস পেয়ে চলেছে। কোনো কোনো এলাকায়, বিশেষত বাংলাভাষী নয়, এমন কিছু অঞ্চলে স্থানীয় অধিবাসীরা তখন শরণার্থীদের ঘোরতর অপছন্দ, এমনকি তাদের উৎখাত করতে শুরু করেছে।

বিশ্বব্যাংক সে সময় সাময়িকভাবে পাকিস্তানকে অর্থ বরাদ্দ বন্ধ রেখেছিল। সেই বরাদ্দ অবমুক্ত করানোর আশায় পূর্ব পাকিস্তানে স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে, এ ধরনের চিত্র হাজির করার উদ্দেশ্যে মোট চারজন মার্কিন সাংবাদিককে পাকিস্তান সরকার ২১ জুন ঢাকায় আমন্ত্রণ করে আনে।

এমন খবরও সংবাদপত্রে প্রকাশিত হতে থাকে। যেমন হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকার সংবাদ অনুসারে বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলা সন্নিহিত মেঘালয় অঞ্চল থেকে প্রায় ছয় হাজার শরণার্থী বিরক্তি, ভয়, দুঃখ ও অনিশ্চয়তার মধ্যে প্রধানত স্থানীয় উপজাতিদের বিরুদ্ধতা থেকে বাঁচার জন্য পালিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে গেছে।

ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউর ১২ জুনের সংখ্যায় বলা হয়, সাধারণ পথচারীদের মধ্যেও উষ্মা প্রকাশ পাচ্ছে। সীমান্তবর্তী জেলাসমূহে, বিশেষ করে দিনমজুর ও ভাগচাষিদের মধ্যে শরণার্থীদের প্রতি সহানুভূতি লোপ পেয়ে একধরনের ঘৃণা ও বিরুদ্ধতার জন্ম নিয়েছে। কেননা, খাদ্যদ্রব্যের দাম বেড়েছে অনেক। শরণার্থী দিনমজুরের সংখ্যা বাড়তে থাকায় মজুরি কমেছে উল্লেখযোগ্যভাবে।

পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরার বাংলাভাষীরা, যারা প্রথম দিকে উৎসাহ নিয়ে শরণার্থীদের পক্ষে এসে দাঁড়িয়েছিল, তারাও তখন অনেকভাবেই বিব্রত, ক্ষতিগ্রস্ত, বিরক্ত অথবা ক্লান্ত। এর রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ায় ইন্দিরা গান্ধীর কংগ্রেস দলের জনপ্রিয়তায় স্পষ্টতই ভাটা পড়ে। হিন্দু মহাসভাসহ বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক দলগুলোর তৎপরতা ও প্রভাব উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। শহরে শিক্ষিত মহলে এমন ধারণাই ক্রমশ প্রবল হয়ে ওঠে যে একমাত্র আমেরিকার সরকারই পাকিস্তানের সঙ্গে আপস আলোচনার ব্যবস্থা করে ভারতকে এই ক্রমবর্ধমান দুর্গতির হাত থেকে রক্ষা করতে পারে। এমন প্রত্যাশার বিস্তার আমি দেখেছিলাম দিল্লির নীতিনির্ধারক মহলেও মে মাসের শেষ সপ্তাহে।

যুদ্ধক্ষেত্রে একদল মুক্তিযোদ্ধা

ইয়াহিয়ার সুযোগের সদ্ব্যবহার ও শনবার্গের প্রতিবেদন

মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন কমপক্ষে তিনটি জাহাজে করে সমরাস্ত্র পাকিস্তানে পাঠানো ছাড়াও নিজের প্রশাসনকে এপ্রিলের শেষ দিকে কঠোর নির্দেশ দিয়েছিলেন, যাতে তারা ইয়াহিয়ার কার্যক্রমে কোনো বিঘ্ন না ঘটায়। এই সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে উপস্থিত সমস্যাবলির স্থায়ী সমাধানের উদ্দেশ্যে ইয়াহিয়া জাতীয় প্রচারমাধ্যমগুলোর মাধ্যমে ২৮ জুন আহ্বান জানান, দেশে যেহেতু স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এসেছে, সেহেতু দেশত্যাগী সব মানুষ যেন সত্ত্বর দেশে ফিরে আসেন। তিনি আরও ঘোষণা করেন, এর আগে আওয়ামী লীগকে যে আদেশে বেআইনি ঘোষণা করা হয়েছিল, তা বলবৎ থাকবে। নির্বাচিত বাঙালি সদস্যদের (এমএনএ) মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে চিহ্নিতরা জাতীয় পরিষদে আসন গ্রহণ থেকে বঞ্চিত থাকবেন। জাতীয় পরিষদ সদস্যদের পরিবর্তে এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিরাই শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করবেন এবং অনির্দিষ্টকালের জন্য দেশে সামরিক শাসন বলবৎ থাকবে।

ঢাকা অথবা অবরুদ্ধ বাংলাদেশে তখন স্বাভাবিক অবস্থা কী ছিল, তা জানার জন্য নিউইয়র্ক টাইমস-এর সংবাদদাতা সিডনি শনবার্গের রিপোর্টের অংশবিশেষ উদ্ধৃত করা যায়। বিশ্বব্যাংক সে সময় সাময়িকভাবে পাকিস্তানকে অর্থ বরাদ্দ বন্ধ রেখেছিল।

সেই বরাদ্দ অবমুক্ত করানোর আশায় পূর্ব পাকিস্তানে স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে, এ ধরনের চিত্র হাজির করার উদ্দেশ্যে মোট চারজন মার্কিন সাংবাদিককে পাকিস্তান সরকার ২১ জুন ঢাকায় আমন্ত্রণ করে আনে। তাঁদের মধ্যে শনবার্গকে পাকিস্তান থেকে বের করে দেওয়া হয় ৩০ জুন।

ওই সময়ের মধ্যে শনবার্গ যা দেখেছিলেন, তার সংক্ষেপিত বিবরণ ছিল এমন: ‘প্রাদেশিক রাজধানীর অর্ধেক জনশূন্য সড়ক দিয়ে সেনাবাহিনীর ট্রাকে করে রাষ্ট্রবিরোধী বন্দীদের কঠোর পরিশ্রমের কাজে বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। তাদের সবার মাথা ন্যাড়া করা। কারও পায়ে জুতা নেই। ছোট জাঙ্গিয়া ছাড়া গায়ে কোনো জামাকাপড় নেই। যাতে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে সহজে তাদের চিহ্নিত করা যায়। প্রতিদিন ঢাকা বিমানবন্দরে ঢিলেঢালা পায়জামা ও উপজাতীয় পোশাকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এসে নামে সেনারা, যাতে সেনা হিসেবে সহজে তাদের না চেনা যায়।...

‘পূর্ব পাকিস্তানে সেনা জনবল একই রকম রাখার জন্য ওয়াল্ড৴এয়ারওয়েজ নামক চার্টার্ড বিমান সংস্থা থেকে সরকারিভাবে দুটো ৭০৭ বোয়িং বিমান এক বছরের জন্য ভাড়া করা হয়েছে, যাতে এই অঞ্চলে ৭০ থেকে ৮০ হাজার সেনার লোকবল বজায় রাখা যায় নিয়মিত হতাহতের পরও।

‘এ ছাড়া স্রোতের মতো নিয়মিত আনা হয় বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে কাজ করার জন্য অবাঙালি জনশক্তি। কোনো বাঙালিকেই আর দায়িত্বশীল ও গোপনীয় কাজের জন্য বিশ্বাস করা হয় না। এমনকি যে মানুষগুলো বিমানবন্দরের পাশে ঘাস কাটে, তারাও সবাই অবাঙালি মুসলমান। ট্যাক্সিচালকদের মধ্যে বাঙালির সংখ্যা অতি নগণ্য। তাদের বাদ দিয়ে অবাঙালি মুসলিমকে কাজে লাগানো হয়েছে। যারা কাজ করে সেনাসদস্যদের সহযোগী হিসেবে, তাদের দিয়ে খবরাখবর সংগ্রহ করেই হোক অথবা তাদের আদেশ তামিল করিয়ে নিয়েই হোক।...

‘সম্প্রতি পূর্ব পাকিস্তানজুড়ে সামরিক বাহিনীর মাধ্যমে বেসামরিক হোম গার্ড তৈরির প্রশিক্ষণ চলছে। অথবা যারা অনুগত নাগরিক, তাদের মধ্যে অস্ত্র বিতরণ করে তাদের দিয়ে শান্তি কমিটি গঠন করা হচ্ছে। বিহারি এবং উর্দুভাষী অন্য মুসলিম ছাড়া স্বল্পসংখ্যক যাদের তারা রিক্রুট করছে, তারা মুসলিম লীগ ও জামায়াতে ইসলামীর অনুসারী।...

‘সম্প্রতি সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তারা তাদের তৎপরতা যেন প্রচ্ছন্নভাবে চালায়। ঢাকায় বিদেশি কূটনীতিবিদের অভিমত হলো, এই সতর্কতা নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বিশ্বব্যাংকের ১১ জাতির কনসোর্টিয়াম পাকিস্তানকে যে সাহায্যদান স্থগিত করেছে, তা পুনরায় যাতে শুরু করা সম্ভব হয়, সে জন৵। তাদের মধ্যে এ জন্যই বিদেশিদের চলাচলের সুযোগ, বিদেশি সাংবাদিকদের এখানে এনে রিপোর্ট করার সুযোগ সাময়িকভাবে দেওয়া হয়েছে। একমাত্র এ কারণেই হত্যাকাণ্ড এখন তুলনামূলকভাবে কম ও প্রচ্ছন্ন।’

পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও সামরিক অসমর্থতা

২৬ মার্চ গণহত্যা শুরুর পর থেকে পরবর্তী তিন মাসে বাংলাদেশে পাকিস্তানিদের সেনাসংখ্যা আড়াই গুণ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৭০ থেকে ৮০ হাজার। এদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল তোচি স্কাউট ও বালুচ স্কাউটের মতো অত্যন্ত নিষ্ঠুর প্রকৃতির রেঞ্জারস। সবার ওপর ঢালাও নির্দেশ ছিল হিন্দু প্রভাবিত বাঙালিদের খতম করার। এই সমুদয় বাহিনীর হাতে নিহতের সংখ্যা কত ঘটেছে, তা নির্ধারণ করার উপায় নেই। তবে এই হত্যাকাণ্ডের ব্যাপকতা প্রত্যক্ষ করে প্রায় ৬০ লাখ মানুষ তাদের ঘরবাড়ি, বিষয়-সম্পত্তি, আয়-উপার্জন সবকিছু ফেলে রেখে এক বস্ত্রে দেশ ত্যাগে বাধ্য হয়েছে। এখনো দৈনিক প্রায় ২০ হাজার মানুষ সীমান্ত অতিক্রম করে চলেছে। এমন পরিস্থিতি সত্ত্বেও ২৮ জুন ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করেন, পূর্ব পাকিস্তানে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরে আসার চার মাস পর দেশের শাসনক্ষমতা একটি বেসামরিক সরকারের কাছে হস্তান্তর করা হবে। এ জন্য তিনি দেশত্যাগী সবাইকে দেশে ফিরে আসার আহ্বান জানান। সংক্ষেপে বলতে হয়, উদ্ভূত সংকট নিরসনে ইয়াহিয়া খান রাজনৈতিকভাবে আগের মতোই অনুর্বর এবং ঈপ্সিত লক্ষ্য অর্জনে সম্ভবত সামরিকভাবেওঅসমর্থ।

পাকিস্তানের সামরিক অসমর্থতা প্রকাশ পায় দুই স্তরে। প্রথমত, ভারতে অবস্থিত বিদ্রোহী ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের ক্যাম্পসমূহ অতর্কিতে ধ্বংস করার জন্য চীনের কৌশলী সহায়তা লাভের প্রচেষ্টায়, যে কথা আগে শোনা গিয়েছিল। গত দুই মাসে তা সংঘটিত হওয়ার কোনো বাস্তব নিদর্শন ছিল না।

অনুমান করা হয়, ভারতের বিরুদ্ধে চীনের সরাসরি কোনো অভিযোগ না থাকায় কোনো সামরিক তৎপরতা শুরু করা তাদের পক্ষে নৈতিকভাবে সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ ততটা সহজ ছিল না। চীনের এই দ্বিধাই সম্ভবত পাকিস্তানের অতর্কিত আক্রমণের পরিকল্পনা স্থগিত রাখে।

অনেক বছর পর পাকিস্তানের সেই সময়ের পররাষ্ট্রসচিব সুলতান মহম্মদ খান তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থে একই কথা প্রকারান্তরে স্বীকার করেন। মাচে৴ গণহত্যা শুরু করার দুই সপ্তাহ পর ৯ এপ্রিল ইয়াহিয়া খান তাঁর পররাষ্ট্রসচিব এবং সেনাবাহিনীর সহকারী প্রধান জেনারেল গুল হাসান খানকে চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাইয়ের কাছে পাঠান বাংলাদেশে তাদের অভিযানের পক্ষে সর্বাত্মক সমর্থন ও সহযোগিতা লাভের আশায়। দুই দিনব্যাপী এই আলোচনায় চীন পাকিস্তানের আঞ্চলিক সংহতি বজায় রাখার প্রতি দৃঢ় সমর্থন ব্যক্ত করে। ভারত যদি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কোনো সামরিক ব্যবস্থা নেয়, তা প্রতিহত করার প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু এর বাইরে পাকিস্তানের চলতি কোনো অভিযানে অংশগ্রহণের প্রশ্নে সম্পূণ৴ নীরব থাকে। অধিকন্তু চীনের প্রধানমন্ত্রী তাঁদের সর্বোচ্চ নেতা মাও সে-তুংকে উদ্ধৃত করে পাকিস্তান সরকার যাতে হত্যাকাণ্ড বন্ধ করে রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সংকট নিরসনে সচেষ্ট হয়, সেই পরামর্শই পাকিস্তান প্রতিনিধিদলকে দেন।

সামরিক লক্ষ্য অর্জনে পাকিস্তানের সীমিত সামর্থ্যের বিষয়টি আমরা জেনেছিলাম অন্যভাবে। জুন মাসের শেষ দিকে প্রথম পর্যায়ে দুই হাজার মুক্তিযোদ্ধার প্রশিক্ষণ সম্পন্ন হওয়ার পর তাঁদের অনেককেই পরীক্ষামূলকভাবে যুদ্ধক্ষেত্রে অভিযানের জন্য সীমান্ত অতিক্রম করে দেশের ভেতরে পাঠানো হয়েছিল। তাঁদের চলাচলের পথ কিছুটা সুগম করার জন্য ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনী ফিল্ড গানের সাহায্যে পাকিস্তানের কয়েকটি সীমান্তচৌকি (বর্ডার আউট পোস্ট বা বিওপি) ধ্বংস করে। যেগুলো পুনর্নির্মাণের ব্যাপারে পাকিস্তানিদের এগিয়ে আসতে দেখা যায়নি। ফলে স্বল্প প্রশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো কোনো দল সীমান্তের কাছাকাছি এলাকা ছাড়িয়ে দেশের অনেক ভেতরে তৎপরতা চালিয়ে যেতে থাকে।

একই সময়ে বিশ্বব্যাংকের অর্থনৈতিক বরাদ্দ পুনরুদ্ধারের আশায় আমেরিকা থেকে আনা চার সংবাদপত্রের প্রতিনিধিকে অবরুদ্ধ বাংলাদেশে সংবাদ সংগ্রহের জন্য স্বল্পকালের স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছিল। এ ছাড়া তখন ঢাকায় ছিলেন ব্রিটেনের ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকার অপেক্ষাকৃত বর্ষীয়ান নারী সাংবাদিক ক্লেয়ার হোলিংওয়ার্থ। তাঁরা গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের দুঃসাহসী তৎপরতার কিছু কিছু সংবাদ বিশ্বকে জানিয়ে দিতে থাকেন যে বাংলাদেশ স্বাধীনতার জন্য গ্রাম-গ্রামান্তরে লড়াই করে চলেছে! (শেষ)