রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ বা আরএসএসের রাজনীতির সঙ্গে যে কারও দ্বিমত থাকতে পারে। কিন্তু কমজনই দলটির রাজনৈতিক সফলতা অস্বীকার করতে পারেন। বলা হতে পারে ভোটের সফলতাকে তারা আদর্শিক সফলতায়ও পরিণত করে নিয়েছে। কিন্তু উল্টোটিই সত্য।
৫ আগস্ট অযোধ্যায় বাবরি মসজিদের স্থলে মন্দির নির্মাণের প্রতীকী শুরু ২২ দশমিক ৬ কেজি ওজনের একখণ্ড রুপার ইট দিয়ে। তবে অনুষ্ঠানের তাৎপর্য কেবল ইট-সিমেন্টের ব্যাপার হয়ে নেই। মুহূর্তটিকে দক্ষিণ এশিয়ার দীর্ঘ ইতিহাসের নতুন যাত্রাবিন্দু বলা যায়।
২০১৯-এর ৫ আগস্ট কাশ্মীরিদের রাষ্ট্রনৈতিক স্বাতন্ত্র্য খারিজ করে ভারত সরকার। পরের বছর একই দিনে রামমন্দির নির্মাণের সূচনা হলো। বহুকাল আরএসএসের আকাঙ্ক্ষা আকারে ছিল এই দুটি লক্ষ্য। নির্বিঘ্নে তারা নিজেদের অপ্রতিরোধ্য প্রমাণ করে একের পর এক লক্ষ্যের দিকে এগোচ্ছে। সংগত কারণেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ৫ আগস্টকে তুলনা করেন ভারতের স্বাধীনতা দিবস ১৫ আগস্টের সঙ্গে। নিঃসন্দেহে এটা ‘ভারতীয়’ পরিচয়ের এক নতুন নির্মাণ।
৯৫ বছরে একের পর এক ‘সফলতা’
আরএসএসের জন্ম ১৯২৫ সালে। বজরং দল, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বিজেপিসহ এর অঙ্গসংগঠন এত অগণিত যে ভারতে সবাই আরএসএসকে বলে ‘সংঘ-পরিবার’। পরিবারের যে কারও সফলতায় কর্তৃত্ব দিতে হয় মুরব্বিকেই।
১৯৮০ সালে এই ‘পরিবার’ প্রথম বাবরি মসজিদের স্থানে মন্দির বানানোর রাজনীতিতে নামে। ৫০ বছর লেগেছে তাদের সফল হতে। কিন্তু ধৈর্য হারায়নি তারা। আন্দোলনের চূড়ান্ত ফল সম্পর্কে হিসাবে ভুল ছিল না তাদের। সংগ্রামের ১২তম বছরে তারা মসজিদ ভাঙতে সমর্থ হয়। পরের ২৮ বছরে সেখানে মন্দির নির্মাণের রাজনীতি গুছিয়ে নেয়। ভারতের সেক্যুলার ঐতিহ্যকে গুঁড়িয়ে দিয়ে এবং ১৮ কোটি মুসলমান ভোটারকে অগ্রাহ্য করেই আরএসএস তার লক্ষ্য অর্জন করল। এই রাজনীতির পথে কখনোই দৌদুল্যমান ছিল না তারা। আরএসএসের মুখপত্র ‘অর্গানাইজার’-এ সম্পাদক প্রফুল্ল কেটকর গত ২৮ জুলাই খোলামেলাভাবেই লিখেছেন: রামজন্মভূমি মুক্ত করার সংগ্রাম কোনো ধর্মীয় আন্দোলন ছিল না। এটা হলো ভারতের ইতিহাসকে নতুন করে লেখার প্রচেষ্টা। তাঁর লেখার শিরোনামও তাৎপর্যময়: ‘পুনর্জাগরণকে পুনর্গঠন’।
রামমন্দিরের যিনি মূল স্থপতি, ৭৭ বছর বয়সী সেই চন্দ্রকান্ত সমপুরাই বলেছেন, ৩০ বছর আগে থেকে তিনি বাবরি মসজিদের জমি ঘুরে দেখতেন। সঙ্গে থাকত বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতৃত্ব। একজন বিখ্যাত শিল্পপতি তাঁকে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের অশোক সিংহলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। অর্থাৎ ওখানে মন্দির গড়ার লক্ষ্য সংঘ-পরিবারের বহু পুরোনো। ধাপে ধাপে তারা কেবল প্রতিবন্ধকতাগুলো সরিয়েছে—রাজনৈতিক ক্ষমতা সংহত করে। চারবার নিষিদ্ধ হলেও কখনো আরএসএস নিজের আদর্শের প্রশ্নে মোটাদাগে আপস করেছে বলে নজির নেই।
লোকসভায় ২টি আসন থেকে ৩০৩টি আসন
আরএসএস চারবার নিষিদ্ধ হয়। তিনবারই কংগ্রেস সরকারের দ্বারা। সেই কংগ্রেসকে ভারতীয় রাজনীতিতে প্রায় কোণঠাসা অবস্থায় রেখেছে এখন ‘সংঘ-পরিবার’। আরএসএসের রাজনৈতিক গণসংগঠন হিসেবে বিজেপি ১৯৮৪ সালে লোকসভায় আসন পেয়েছিল ২টি; ভোট পায় ৭ শতাংশ। ৩০ বছর পর ২০১৪ সালে তারা আসন পায় ২৮২; ভোট দাঁড়ায় ৩১ শতাংশ। মাঝের প্রতি নির্বাচনে তাদের ভোট বেড়েছে। সর্বশেষ ২০১৯-এ বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর তাদের আসন ও ভোট আরও বাড়ল। এবার ভোট পেয়েছে তারা ৩৭ ভাগ; আসন দাঁড়িয়েছে ৩০৩টি।
সর্বশেষ দুই দফাসহ ইতিমধ্যে বিজেপি ভারতে পাঁচবার সরকার গঠন করে ফেলেছে। ৩১টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের ১৬টিতে তারা একক বা যৌথভাবে ক্ষমতায় আছে এ মুহূর্তে। এসবই রামমন্দির এবং হিন্দুত্ববাদের রাজনীতির ফসল। সংক্ষিপ্ত এই চিত্রের মূলবার্তা কিন্তু অনেক বড়। ধর্মকে ভোটের পণ্য বানিয়ে সংঘ পরিবার ঠকেনি। নিশ্চয়ই দক্ষিণ এশিয়ায় তারাই কেবল সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করেনি। তবে তাদের সফলতার রহস্য হলো, তারা কাজ করে আন্তরিকতা ও অঙ্গীকারের সঙ্গে, নির্মমভাবে। রাজনৈতিক কৌশল আকারে কেবল নয়; ভাবাদর্শ আকারে।
আরএসএসের ধর্মবাদ কেবল ভারতের রাজনীতি ও সমাজ জীবন পাল্টাচ্ছে তা–ই নয়, হিন্দুধর্মের স্বরূপকেও তারা নিজেদের আদলে আকার দিচ্ছে। দেব-দেবীর চরিত্রের এত দিনকার আধ্যাত্মিক ও আত্মত্যাগের ইমেজের মাঝে তারা আরোপ করে চলছে রাজনীতিমনস্ক ইমেজ। সঙ্গে যুক্ত করছে একই ধাঁচের স্লোগান। বিশ্বাসের জায়গায় ঠাঁই পাচ্ছে রাজনীতির কলাকৌশল। অযোধ্যায় রামমন্দিরের অবকাঠামো যত দৃশ্যমান হবে, উত্তর ভারতে বিজেপির একচেটিয়াত্ব আরও চূড়ান্ত হবে। আরএসএস মন্দির নির্মাণের জন্য সাড়ে তিন বছর সময় বরাদ্দ করেছে। হ্যাঁ, পরের জাতীয় নির্বাচনও হবে ২০২৪-এ! এর পরের বছরই আরএসএসের শতবর্ষ পূর্তি!
অতঃপর আরএসএসের কাছে নতজানু হলো কংগ্রেস
আরএসএসের ঐতিহাসিক প্রতিপক্ষ জাতীয় কংগ্রেস। কংগ্রেস নেতৃত্ব অযোধ্যায় মন্দিরের জন্য ভূমিপূজাকে সমর্থন করেছে। এটা একটা ঐতিহাসিক ঘটনা। তার প্রতীকী মূল্যও বিপুল। কংগ্রেস যে আরএসএসের রাজনীতি রুখতে ব্যর্থ হয়েছে তা–ই নয়, তারা শেষ পর্যন্ত আরএসএসের রাজনীতির কাছে নতজানুও হলো। কেন্দ্রে বিজেপির আরও একাধিকবার সরকার গঠনের চেয়েও আরএসএসের কাছে এই মুহূর্তটি অনেক মূল্যবান—সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার জন্য সেটা যতই বিপজ্জনক হোক।
অযোধ্যায় ৫ আগস্টের কংগ্রেসের সমর্থন কেবল মৌখিক ছিল না। মধ্যপ্রদেশ থেকে কংগ্রেস নেতৃত্ব মন্দিরে গাঁথার জন্য ১১টি রুপার ইট পাঠানোরও ঘোষণা দিয়েছে।
একদিকে বাবরি মসজিদ ভাঙার বিরোধিতা, অন্যদিকে মন্দির নির্মাণের জন্য রুপার ইট পাঠানো রাজনৈতিক আদর্শের চরম স্ববিরোধী এক চিত্র। তবে এবারই প্রথম ঘটেনি এ রকম। ১৯৮৯ সালের নির্বাচনে ‘সেক্যুলার কংগ্রেস’ অযোধ্যা থেকে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেছিল কেবল নিজের ধর্মীয় পক্ষপাত প্রমাণ করতে। ৫ আগস্টের নতজানুতা অবশ্যই সব অতীতের চেয়ে বেশি কিছু। ভারতীয় রাজনীতি মধ্য-ডান সমীকরণ থেকে ডান-ডান সমীকরণে ধাবিত হবে এখন। কংগ্রেসের এত দিনকার দোদুল্যমান মিত্র বামপন্থীদেরও এবার বড় ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পালা এল।
আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি আরএসএসের অনুকূলে
অযোধ্যায় বাবরি মসজিদের জমিতে রামমন্দির গড়ার মাধ্যমে আরএরসএস তার ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকে ভারতীয় রাজনীতির ভরকেন্দ্রে পরিণত করেছে। যেকোনো রাজনৈতিক শক্তির জন্য এটা স্বপ্নের সমান এক অবস্থা। সংঘ-পরিবার ঐতিহাসিক এই সুযোগটি ভালোভাবেই কাজে লাগাবে। ‘মন্দির ওখানেই বানাব’ কয়েক দশকের এই স্লোগানকে কাজে অনুবাদ করে প্রকৃতই এই দলটি এখন বলতে পারে, তারা যা চায় সেটা বাস্তবায়ন করে।
আগামী দিনগুলোতে সংঘ-পরিবার ভারতে আরও নতুন কিছু নির্দেশনা নিয়ে হাজির হবে। দ্রুতই সেটা ঘটবে। পরিস্থিতির ওপর তাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। তারা যা চাইবে তাই হবে এখন। আন্তর্জাতিকভাবেও পরিস্থিতি তাদের অনুকূলে। চীন-যুক্তরাষ্ট্র দ্বন্দ্বে ভারত ওয়াশিংটন ও ইউরোপের মিত্র হওয়ায় আরএসএসকে এখন আর বিপক্ষ মতাদর্শের মানুষ পিটিয়ে মেরে ফেলার জন্য নিন্দার ভয় নিয়ে শঙ্কায় থাকতে হবে না। কাশ্মীরে গত এক বছরের লকডাউন আন্তর্জাতিক পরিসরে সামান্যই মনোযোগ কেড়েছে। নয়াদিল্লির হিসাবে কোথাও ভুল হয়নি।
শিগগিরই আরএসএস দেশটির সংবিধান পরিবর্তন করতে চাইতে পারে বলে অনুমান এখন। এর মাধ্যমে তারা ভারতে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি, সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদ এবং পরিবর্তনবাদী কর্মকাণ্ডকে বেআইনি করে দিতে সমর্থ হবে। ভারতকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ ঘোষণা তাদের প্রকাশ্য লক্ষ্য। ভারতের জাতীয় পরিচয় ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ হবে নাকি সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ হবে; এ নিয়ে যে দোলাচল ছিল আরএসএস এবার তার ফয়সালা করতে পারে। ৫ আগস্ট অযোধ্যায় বক্তৃতা আকারে প্রধানমন্ত্রী মোদি সে রকমই ইঙ্গিত দিলেন। তাঁর ভাষায়, মহাত্মা গান্ধীও রামরাজ্যের স্বপ্ন দেখতেন। রামমন্দির এই স্বপ্নের পথ তৈরি করবে।
রাজনীতির ময়দানে হিন্দুরাষ্ট্রের লক্ষ্য আরএসএস ইতিমধ্যে অর্জন করেছে। সেই অর্জনের স্বীকৃতি কাগজপত্রেও করে নিতে চাইতে পারে তারা। আজকের ভারতের সংবিধানে সেক্যুলার পরিচয় বেশ খাপছাড়াই বটে। এর যেকোনো সংশোধনে কংগ্রেস গুনগুন করে কিছু আপত্তি তুলবে। তার ‘মোকাবিলা’ বিজেপির জন্য এখন আর শক্ত কিছু নয়। অন্যান্য গণতান্ত্রিক শক্তিগুলো রাজ্যে রাজ্যে বিভক্ত। তাদের ঐক্যের কোনো ভৌগোলিক শর্ত এখন আর উপস্থিত নেই।
এর বাইরে অযোধ্যাসহ অন্যান্য জায়গায় মসজিদ ভেঙে মন্দির তৈরির হিড়িক পড়তে পারে শিগগিরই। করোনার অর্থনৈতিক বিপর্যয় এবং সীমান্তে চীনের শক্তির সঙ্গে পেরে না ওঠার অস্বস্তি পোষাতে ভালো উপায় ধর্ম। আরএসএস এখন গণভাবে এই হাতিয়ার প্রয়োগ করবে। বিরুদ্ধবাদীরা এটাকে আরএসএসের ‘কৌশল’ বলে থাকে। কিন্তু এই বলা বোঝাপড়ার এক বড় ভুল। হিন্দুত্ববাদ ও হিন্দুরাষ্ট্র কায়েম আরএসএসের রাজনীতি, কৌশল নয়। কখনো ছিলও না।
শঙ্কার কারণ আছে সবার জন্য
ভারতে রাজনীতি যেভাবে দ্রুত ধর্মবাদী রূপ নিচ্ছে তাতে আশপাশের দেশের জন্য শঙ্কার কারণ আছে। বাংলাদেশও এই বিপদের বাইরে নেই। প্রতিবেশী পাল্টানো যায় না। ফলে প্রতিবেশীর সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষার বিকল্প কোনো নেই। কিন্তু বাবরি মসজিদের নাই হয়ে যাওয়া বাংলাদেশের মুসলিম জনগণের মনে যে গভীর মানসিক ক্ষত তৈরি করেছে তা সহজে দূর হওয়ার নয়। একে অগ্রাহ্য করে এখানকার নীতিনির্ধারকদের পক্ষে আন্তরাষ্ট্রীয় সুসম্পর্ক বজায় রাখার কাজটি সহজ নয়।
ভারতে আরএসএসের অপ্রতিরোধ্য অবস্থা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশে একই রকম ধর্মবাদী রাজনীতি-সংস্কৃতিকে পরোক্ষে ন্যায্যতা দিতে থাকবে। ৫ আগস্ট অযোধ্যায় ‘অতিথি’দের একাংশ ছিলেন ১৯৯২-এ মসজিদ ভাঙার ‘করসেবক’রা। এটা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যত্র যে বার্তা দেবে তার পরিণতি কী?
আলতাফ পারভেজ: ইতিহাস বিষয়ে গবেষক