মানবজীবনের প্রতিটি স্তরে প্রলোভনের কত যে ফাঁদ পাতা থাকে! কৌশলে এড়িয়ে চলতে হয় এসব ফাঁদ। বিশেষ করে প্রতিকারহীন অপরাধের সমাজে এসব ফাঁদ এড়িয়ে চলতে পারাটাও এক ধরনের যোগ্যতা। কারণ, অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে অনেক সময় জীবন হয়ে ওঠে দুর্বিষহ। তবে এসব প্রলোভন পায়ে ঠেলে সামনে এগিয়ে যেতে মেরুদণ্ডের জোর লাগে।
কখনো অন্যায়ের কাছে, অসুন্দরের কাছে মাথা নত না করার শিক্ষা অনেক বড় শিক্ষা। পরিবারই সে ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে। আমি নিশ্চিত, সাকিব আল হাসানের মা-বাবা তাঁকে এই শিক্ষাই দিয়েছিলেন। তাঁর শিক্ষার ভিত্তি ছিল মজবুত। না হলে তিন তিনবার জুয়াড়িদের প্রলোভনের হাতছানিকে উপেক্ষা করতে পারতেন না তিনি। এর বাইরেও হয়তো আরও অনেক বড় বড় প্রলোভন এসেছে তাঁর জীবনে এবং সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেসবের ঊর্ধ্বে থেকেছেন তিনি।
একজন সাকিব আল হাসান হয়ে ওঠা এত সহজ নয়। কজন হতে পেরেছেন সাকিব আল হাসান! একজন সাকিব হতে প্রয়োজন কঠোর পরিশ্রম, নিষ্ঠা, সাহসিকতা, আন্তরিকতা, দেশপ্রেম আর মূল্যবোধের দুর্লভ সমন্বয়। আর এই দুর্লভ সমন্বয়েই তৈরি হয়েছিলেন সাকিব। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। দুর্ভাগ্য পিছু নিয়েছে সাকিবের। আইসিসির আইনের নিষ্ঠুর জালে আটকা পড়েছেন তিনি। তবে সাকিব একা এই জালে আটকা পড়েননি। সাকিবের সঙ্গে আটকা পড়েছে বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষ ও তাদের স্বপ্ন।
সাকিব আল হাসান ভুল করেছেন, বিষয়টি অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। তিনি অন্যায় করেছেন জুয়াড়িদের তথ্য বিসিবি ও আইসিসিকে না জানিয়ে। আইসিসির নিয়ম বড় কড়া। অন্যায়ের সঙ্গে আপস না করার তথ্য সেখানে গুরুত্ব পায় না; বরং গুরুত্ব পায় জুয়াড়ির প্রস্তাব রিপোর্ট করা না করার তথ্য। এ অপরাধ নাকি ক্ষমার অযোগ্য।
ম্যাচ ফিক্সিংয়ের প্রস্তাবকারী জুয়াড়িরা বুক ফুলিয়ে ঘুরলেও তারা থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাদের দেশে ওসব অপকর্ম কি ধর্তব্য না? তবে যে আইন বিশ্বের এক নম্বর অলরাউন্ডারের অন্যায় প্রস্তাবের কাছে হার না মানার বিষয়টি গৌণ বিবেচনা করে, রিপোর্ট করা না করাকে মুখ্য হিসেবে বিবেচনা করে, সে আইন কেমন আইন, তা আমাদের মতো সাধারণ জনগণের বোধগম্য নয়। তবে একটি বিষয় তলিয়ে দেখা প্রয়োজন, কোনো অপরাধই একপক্ষীয় নয়।
সাকিব আল হাসান তিন-তিনবার জুয়াড়ির প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছেন। এতে স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয়, সাকিব অন্যায় করেননি আর অন্যায়কে প্রশ্রয়ও দেননি। কিন্তু তিনি কেন বিসিবি আর আইসিসিকে বিষয়টি জানাননি, সেই বিষয়টি কেউ তলিয়ে দেখেছেন কি! এ জন্য শুধু সাকিবকেই দায়ী করা যায় কি না, তা ভাবার অবকাশ আছে। বিসিবি কিংবা আইসিসি আদৌ খেলোয়াড়দের কাছে নির্ভরতার আশ্রয় হয়ে উঠতে পেরেছে কি! তাই এই দোষ সাকিবের একার নয়, এই দায়ভার তাদেরও। মানুষ প্রতিবাদ না করে অন্যায় থেকে দূরে থাকে তখনই, যখন প্রতিকারের আশা থাকে ক্ষীণ। তাই সাকিবের অপরাধ হয়তো সাকিবের একার না-ও হতে পারে।
কয়েক দিন আগে হাজির হয়েছিলাম একটি শিশু-কিশোর সম্মেলনে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন সাকিব আল হাসান। শিশুদের প্রশ্ন করা হয়, তারা সবার আগে কাকে মঞ্চে দেখতে চায়। তারা একযোগে চিৎকার করে বলেছিল ‘সাকিব’। এ দাবি শুধু শিশুদের নয়। এই দাবি বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের। আমরা অচিরেই ক্রিকেটের মঞ্চে আবার দেখতে চাই সাকিবকে। সাকিবের মতো একজন ক্রিকেটার আগামী দিনে কমপক্ষে এক বছর বাংলাদেশের হয়ে খেলতে না পারা দলের জন্য একটি বড় ধাক্কা। তিনি ব্যাট করেন, বল করেন, ফিল্ডিং করেন। তিনি দীর্ঘ সময় ধরে বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়। ক্রিকেট আমাদের ভালোবাসার নাম। সাকিব আল হাসান হলেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের উজ্জ্বল প্রতিচ্ছবি। সাকিব তাই আমাদের গর্ব, আমাদের অহংকার। সাকিব মানে হার না মানা এক সত্তা। আমরা আশায় আছি, সাকিব আবার ফিরে আসবেন, ফিরে আসবেন কিংবদন্তি হয়ে। বছরের পরিক্রমায় আরও ক্ষুরধার আর শাণিত হয়ে ফিরে আসবেন আমাদের প্রিয় সাকিব আল হাসান।
পাশাপাশি আরেকটি শঙ্কাও যে মনে ভর করে; উড়িয়ে দিতে পারি না কিছুতেই। সাকিবের নতুন পথচলা হোক কণ্টকমুক্ত। বৈরী হাওয়া যেন কোনোভাবেই স্পর্শ না করে সাকিবকে। পাশাপাশি অবসান ঘটুক ক্রিকেট নিয়ে রাজনীতির। সঠিকভাবে তদন্ত করা হোক ক্রীড়াঙ্গনের প্রতিটি দুর্নীতির। অবিলম্বে দৃশ্যমান ও পর্দার অন্তরালে থাকা সব অন্যায়কারীর বিচার দাবি করছি। আমাদের গর্ব ক্রিকেটের বিরুদ্ধে সকল ষড়যন্ত্র বন্ধ হোক। সাকিবের ক্রিকেট সত্তা পুনর্জন্ম লাভ করুক বিপুল বিক্রমে। সাকিব ফিরে আসুক আমাদের মাঝে। তবেই না খেলবে টাইগার আর জিতবে টাইগার। অনেক শুভকামনা সাকিবের জন্য।
নিশাত সুলতানা: লেখক ও গবেষক
purba_du@yahoo.com