অপরাধ ও অপরাধী নিয়ন্ত্রক

স্বজন হারানো মানুষের এই কান্না কবে শেষ হবে?
স্বজন হারানো মানুষের এই কান্না কবে শেষ হবে?

চাঞ্চল্যকর কোনো খুনের ঘটনা ঘটলে, গুরুত্বপূর্ণ কেউ অপহৃত হলে অথবা অন্য কোনো বড় অপরাধ সংঘটিত হলে মিডিয়া মুখর হয়, সরকারের সমালোচনা হয়, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি নিয়ে উদ্বেগ জানানো হয়। সরকারও কিছুটা নড়েচড়ে বসে। মন্ত্রী-সাংসদেরা বিবৃতি দেন। পুলিশের কর্মকর্তারা দেশের মানুষকে আশ্বস্ত করেন। খুনি যে-ই হোক অথবা অপরাধী যত শক্তিশালীই হোক, কোনো ছাড় দেওয়া হবে না বলে ঘোষণা দেওয়া হয়। মিডিয়ার মনোযোগ, তা আমাদের দেশে হোক, বিদেশে হোক, একটা শিশুর মতো, খুবই স্বল্পস্থায়ী। একটা বড় ঘটনার পেছনে মিডিয়া যদি দিন কয়েক লেগে থাকে, আরেকটি বড় ঘটনা ঘটে, সেই মনোযোগ আর থাকে না। আর কোনো অপরাধের খবর মিডিয়া থেকে মিলিয়ে গেলে তার প্রতিকারও দূরের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। অপরাধী আড়াল থেকে ফিরে আসে, অথবা ধরা পড়লেও জামিন নিয়ে বেরিয়ে যায়। নতুন করে অপরাধ ঘটায়, অথবা মিডিয়ায় বেশি শোরগোল হলে বিদেশে পালায়। ফলে অপরাধ চক্রের ধারাবাহিকতায় কোনো ছেদ পড়ে না।
কিন্তু অপরাধ কেন হয়, অপরাধের মাত্রা কেন বাড়ে, অপরাধী কেন বেপরোয়া হয়, সেই প্রশ্নে তেমন কোনো সময় দেওয়া হয় না। একটা সমাজকে অপরাধমুক্ত রাখতে হলে কাকে কী করতে হবে, কোন দায়িত্ব পালন করতে হবে, কোন দিকে নজর দিতে হবে, এসব রকেট-বিজ্ঞানের মতো জটিল কোনো বিষয় নয়, একজন স্কুলছাত্রও উত্তরগুলো বলে দিতে পারে। একবার এক বিতর্ক অনুষ্ঠানে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল, যার বিষয়বস্তু ছিল অপরাধ নির্মূল। দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের নিয়ে ছিল অনুষ্ঠানটি। বিতর্কের দুই পক্ষই এমন চমৎকার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করল প্রসঙ্গটির যে শ্রোতাদের বুঝতে বাকি থাকল না, কেন অপরাধ হয় এবং কেন এর মাত্রা ও বিস্তার বাড়ে। কিন্তু ওই শিক্ষার্থীরা যেসব কারণ উল্লেখ করেছিল অপরাধ সংঘটনের, যার কিছু আমি এই লেখায় উল্লেখ করব, সেগুলো নিয়ে দারুণ অস্বস্তিতে পড়ে সরকার, রাজনৈতিক দল, শিক্ষা ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং আমাদের সমাজ। সে জন্য কারণগুলো সামনে এলে সেগুলো সমাধানের চেষ্টা না করে ঝাড়ু দিয়ে গালিচার নিচে ঢুকিয়ে দিতেই উদ্গ্রীব হয়ে পড়ে সবাই। এক বিতার্কিক সেদিনের এক খবরের কাগজ দেখিয়ে বলল, এক সচ্ছল পরিবারের ছেলে এক গুরুতর অপরাধের দায়ে প্রমাণসহ অভিযুক্ত হলেও সব দোষ চাপানো হলো তার নির্যাতনের শিকার কিশোরীর ওপর। অপরাধটা ছিল ধর্ষণের, যা ওই শিক্ষার্থী তার সৌজন্যের কারণে উল্লেখ করেনি। তার প্রশ্ন ছিল, এই ছেলেটি যে একটি দানব, তা তো পরিবার মেনে নিল, এবং তাকে যে লাইসেন্স দিয়ে দিল, এতে এরপর আরও বড় অপরাধ ঘটাতে সে কি উৎসাহ পেল না?
এ কয়দিন দেশে খুনের কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে, যেগুলো লোমহর্ষক, ঠান্ডা মাথায় করা। এক মসজিদের ইমাম, ইসলাম ধর্ম নিয়ে যিনি কথা বলতেন টিভি চ্যানেলে, তাঁকে গলা কেটে খুন করা হলো। এক বাড়িতে ঢুকে তিনজনকে গুলি করে মারা হলো। সারা দেশে এ কয়দিনে ঘটেছে আরও অনেক খুন, জখম ও অন্যান্য অপরাধের ঘটনা। মিডিয়াতে লেখালেখি ও কথা বলা হচ্ছে। সরকারের এক প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনা। বিরোধী দল (অর্থাৎ বিএনপি) সরব হয়েছে, বলছে, সরকার খুনের রাজত্ব কায়েম করেছে। এ সরকার ব্যর্থ। তবে সরকার আগেও বলেছে, ঘরের ভেতর মানুষকে নিরাপত্তা দেওয়া সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। এই কথার ভেতর যুক্তি আছে। যেমন যুক্তি আছে নৌমন্ত্রীর কথায় যে পিনাক-৬ উদ্ধার না করতে পারাটা সরকারের ব্যর্থতা নয়। মন্ত্রী একে সাফল্যও বলছেন না, তবে আন্দাজ করি, কিছুদিন হাঁকডাক করে একটা উদ্ধার তৎপরতা যে দেখানো হলো, তা-ই বোধ হয় প্রকৃত সাফল্য। খুনের ব্যাপারেও হাঁকডাক হয়েছে। বলা হয়েছে দ্রুততম সময়ে অপরাধীরা ধরা পড়বে। তবে একটা অপরাধের সুরাহা হলেও ১০টার হয় না। ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে নবজাতক চুরি হওয়ার সাত দিনের মধ্যে র্যাব তাকে উদ্ধার করেছে, কিন্তু গত পাঁচ মাসে যে আরও ছয় নবজাতক চুরি হলো, তাদের খবর কী? মিডিয়া সাগর-রুনি হত্যার প্রসঙ্গ তোলে। ইলিয়াস আলীর অপহরণের প্রসঙ্গ তোলে। আরও অনেক অপরাধের গল্প বলে। কেন সেগুলোর সমাধান হয় না? কেন অপরাধীরা ধরা পড়ে না?
সরকারের দায়টা এখানে আসে। অপরাধ অপ্রতিরোধ্যভাবে কেন হয়, সে প্রশ্নের উত্তরে ওই বিতার্কিকেরা যা বলেছিল, তার সঙ্গে আমার কিছু পর্যবেক্ষণ যোগ করে বলতে পারি, এর কারণ রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব, দায়মুক্তির চর্চা, অপরাধীদের প্রশ্রয় দেওয়া, রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন, লোভের সংস্কৃতির ব্যাপকতা (যার একটি প্রকাশ দুর্নীতি), উগ্রবাদ, মাদক এসবের প্রভাব ইত্যাদি। অপরাধ হয়, কিন্তু অপরাধীরা ধরা পড়ে না, ধরা পড়লেও তাদের শাস্তি হয় না। এই বিষয়টাই তো অপরাধ নিয়ন্ত্রণ বা নির্মূলের প্রধান অন্তরায়। কেন শাস্তি হয় না? কারণ, অপরাধীদের রাজনৈতিক অবস্থান অথবা সংশ্লিষ্টতা। যারা আইনের রক্ষক, তারাই যদি ভক্ষক হয়ে দাঁড়ায়—যেমন ঘটেছে নারায়ণগঞ্জে এবং অন্য অসংখ্য জায়গায়—তখন অপরাধ আর অপরাধী এক হয়ে যায়।
সরকারি দলের ছাত্রসংগঠনের ভেতরে চলছে মারামারি, সরকারি দল যেসব থামানোর বদলে সহ্য করছে। টেন্ডার-বাণিজ্য চলছে। চলছে নানা অপকর্ম। সরকারদলীয় এক সাংসদের বিরুদ্ধে কাগজে অভিযোগ উঠছে ইয়াবা-বাণিজ্যের। নদী দখল করছেন সরকারদলীয় সাংসদেরা, নদীর মাঝখান দিয়ে কংক্রিটের রাস্তা বানাচ্ছেন ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য। সরকার নিশ্চুপ। এই নিশ্চুপতা শতবর্ষের। বিএনপি আজ অভিযোগ করছে সরকারের বিরুদ্ধে, কিন্তু বিএনপি আমলেও চিত্রটা ছিল একই রকমের, কারণ, নিজের দলের অপকর্মের দিকে চোখ বন্ধ রাখাটা পুরোনো চর্চা, যার ধারাবাহিকতাই আমরা এখন দেখছি।
একটা আদর্শ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কল্পনা করুন—যার ছবিটা ওই স্কুল-বিতার্কিকেরা নিখুঁতভাবে এঁকেছিল—যেখানে সরকার অপরাধের প্রতি শূন্য-সহ্যবোধ বা জিরো টলারেন্স নিয়ে কাজে নামল, যেখানে অপরাধীর একটাই পরিচয় সে অপরাধী এবং রাষ্ট্র পুরো সক্রিয়তা নিয়ে নেমে পড়ল অপরাধ নির্মূলে। সেই রাষ্ট্রে অপরাধের ডগায় নয়, দৃষ্টি যাবে গোড়ায়, যেখানে শিশুরা শিখবে অপরাধকে ঘৃণা করতে, দেখবে তার দৃষ্টান্ত, যেখানে সংস্কৃতির শিক্ষা, আত্মপ্রত্যয়ী হওয়ার শিক্ষা তাদের নিজেদের শক্তি খুঁজে নিতে উদ্বুদ্ধ করবে। তারা আপন শক্তিতে বিশ্বকে জয় করতে দাঁড়িয়ে যাবে। ওই সংস্কৃতির শিক্ষা, বিজ্ঞানমনস্কতা, অগ্রসর চিন্তা, মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও দায়বদ্ধতা সমাজটাকেই বদলে দেবে। সেই সমাজে কোনো ধর্ষক ছেলেকে বাবাই তুলে দেবেন পুলিশের হাতে।
সেই আদর্শ রাষ্ট্রে গণতন্ত্র হবে তৃণমূলের, সেখানে তরুণেরা কোনো দলের লেজ হয়ে দানবশক্তি নিয়ে সমাজের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে না, বরং সৃজনের শক্তি নিয়ে দেশটা এগিয়ে নিতে পথে নামবে। সেই রাষ্ট্রে উগ্রবাদ কলকে পাবে না, মাদক হেরে যাবে সৃজনশীল আত্মবিকাশের কাছে। অপরাধ একটা এক মাথার দৈত্য না যে ওই মাথাটা কেটে ফেললে অপরাধ নির্মূল হবে। গ্রিক পুরাণের হাইড্রার মতো এর শত মাথা। এই দৈত্যকে শুরুতেই পরাস্ত করতে হবে। বিতর্কের সেই আসরে বসে আমি বুঝেছিলাম, তরুণেরা তা করতে প্রস্তুত, সেই শক্তি অর্জন করতেও তারা প্রস্তুত। প্রস্তুত নয়, ইচ্ছুক নয় শুধু আমাদের রাজনৈতিক প্রশাসনিক কাঠামো ও দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা, আইনের রক্ষকদের ও সমাজের একটি অংশ। এর একটি কারণ, অপরাধ এখন বাণিজ্যও বটে। এই বাণিজ্যে এখন অনেকেরই রমরমা অবস্থা।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক। অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।