অন্য রকম 'ঘরোয়া রাজনীতি'

অতীতে যেকোনো নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপি—যেই দলই জয়ী হোক না কেন, রাজপথ বেজায় গরম থাকত। সরকারি দল ডঙ্কা বাজিয়ে উচ্চ নিনাদে দেশবাসীকে তাদের বিজয়ের খবরটি জানিয়ে দিত। শহর, বন্দর, গ্রাম—সবখানে। কোথাও সপ্তাহ ধরে, কোথাও মাস ধরে আনন্দ-উৎসব চলত। আর বিরোধী দল ‘এই দিন দিন নয়, আরও দিন আছে’ বলে সরকারের প্রতি কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করত এবং সভা-সমাবেশ করে নিজেদের শক্তির জানান দিত।

কিন্তু ৩০ ডিসেম্বর একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর রাজনীতি একেবারেই ঠান্ডা। বিরোধী শিবির পরাজয়ের বেদনায় কাতর। কিন্তু সরকারি শিবিরে আনন্দ আছে তা জোর দিয়ে বলা যাবে না। মান্না দের গানের অনুকরণ করে বলতে হয়, ‘কোথায় হারিয়ে গেল নির্বাচনের দিনগুলো...।’

নির্বাচনের পর প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা ছাড়া কারও মন ভালো নেই। তিনি অবিরাম লোক হাসিয়ে চলেছেন। ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর তিনি বলেছেন, ‘উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচন হয়েছে।’ কিন্তু নির্বাচনী দায়িত্বে যাঁরা ছিলেন, যাঁরা প্রার্থী ও ভোটার ছিলেন, তাঁরা কোথাও উৎসব দেখেননি।

উপজেলা নির্বাচন সামনে রেখে রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তাদের উদ্দেশে সিইসি বলেছেন, যদি কোনো রিটার্নিং কর্মকর্তা মনে করেন যে তাঁর পক্ষে উপজেলায় নির্বাচন করার পরিবেশ নেই, তাহলে তিনি সেটা বন্ধ করে দেওয়ার সুপারিশ করবেন। কমিশন সেটা বন্ধ করে দিতে পারবে। কিন্তু নির্বাচনে কোনো রকম অনিয়মের সঙ্গে আপস করা যাবে না।

তাঁর শব্দ চয়নের তারিফ করতে হয়। ভোট কারচুপি বা ভোট ছিনতাইয়ের তুলনায় অনিয়ম খুবই লঘু অপরাধ। তার সঙ্গেও আপস না করার কথা বলেছেন, এমন নির্বাচন কমিশনের প্রধান, যে কমিশন শুরু থেকেই নানা অনিয়মকে প্রশ্রয় দিয়ে এসেছে। যখন ক্ষমতাসীন ছাড়া সবাই তড়িঘড়ি করে ইভিএম ব্যবহারের বিরোধিতা করেছিল, তিনি শোনেননি। এখন বলছেন, ইভিএমে ত্রুটি ছিল।

২০১৪ সালেও জাতীয় নির্বাচনের কয়েক মাস পর উপজেলা নির্বাচন হয়। ওই সময় বিএনপি সংসদ নির্বাচন বর্জন করলেও উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল এবং প্রথম দুই পর্বের ফলাফল ক্ষমতাসীনদের প্রচণ্ড ধাক্কা দিয়েছিল। পরবর্তী ধাপের নির্বাচনে সেই ধারা কীভাবে উল্টে গেল, দেশবাসী তা-ও জানে। বিএনপি এবারের উপজেলা নির্বাচনে যাচ্ছে না, তাই ক্ষমতাসীনদের সে রকম কোনো ঝামেলা পোহাতে হবে না। উপজেলা নির্বাচন কিংবা ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে উপনির্বাচনটি ‘মহাজোটের’ মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে।

আর উপজেলা নির্বাচনের চেহারাটি মোটামুটি পরিষ্কার। বেশির ভাগ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে মনোনয়ন পাওয়া আওয়ামী লীগ প্রার্থীর সঙ্গে মনোনয়ন না পাওয়া আওয়ামী লীগ প্রার্থীর। কোনো কোনো উপজেলায় আওয়ামী লীগ প্রার্থীর সঙ্গে জাতীয় পার্টির কিংবা ইসলামী আন্দোলন কিংবা স্বতন্ত্র প্রার্থীর প্রতিদ্বন্দ্বিতা হলেও হতে পারে। অতীতে উপজেলায় নির্বাচন নিয়ে তৃণমূল পর্যায়ে যে ধরনের শোরগোল শোনা যেত, এবার তার কিছুই নেই। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে একটি কথা বেশ চালু ছিল; মনোনয়ন পাওয়াটাই আসল নির্বাচন। মনোনয়ন পেলে কেউ পাস ঠেকাতে পারবে না। ২৮৮টি আসনে অন্তত সেটাই প্রমাণিত হয়েছে।

২.
বাংলাদেশের রাজনীতি এখন অনেকটা ‘ঘরে’ ঢুকে গেছে। প্রায় প্রতিদিন নয়াপল্টনে বিএনপির ‘ঘর’ থেকে দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী সরকারের ও সরকারি দলের নানা অনিয়ম নিয়ে বিবৃতি দেন। কথা বলেন। প্রতিবাদ করেন। আর ধানমন্ডির ৩ নম্বর সড়কের আওয়ামী লীগ অফিস থেকে সেই বিবৃতির জবাব দেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বা অন্য কোনো নেতা।

সংসদ নির্বাচনের আগে যে আওয়ামী লীগের নেতারা কিসে বিএনপির ভালো হবে, কিসে নেতৃত্ব টিকে থাকবে, সেসব বিষয়ে নিয়ত সুপরামর্শ দিতেন, এখন পর্যন্ত সেই ধারা তাঁরা অব্যাহত রেখেছেন। দুঃসময়ে বিএনপির নেতারা ঝুঁকি নিতে না পারলে দলের ভবিষ্যৎ অন্ধকার বলে মন্তব্য করেছেন ওবায়দুল কাদের। তিনি প্রশ্ন রেখেছেন, ঝুঁকি নেওয়ার সাহস নেই, কী রাজনীতি করে? রাজনীতি করতে হলে ঝুঁকি নিতে হবে, খুবই হক কথা। রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধু ঝুঁকি নিয়েছেন। মাওলানা ভাসানী, তাজউদ্দীন আহমদ প্রমুখ ঝুঁকি নিয়েছেন। কিন্তু ১/১১-এর পর কে কতটা ঝুঁকি নিয়েছেন, তা-ও কিন্তু মানুষ দেখেছে।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জানিয়েছেন, বিদেশে বিএনপির ইমেজ সংকট আছে। কিন্তু দেশের ভেতরে কার ইমেজ কতটুকু বেড়েছে, সেটি একবার জরিপ করে দেখুন, ফলাফল সরকার বা সরকারি দলের পক্ষে না-ও যেতে পারে। নোয়াখালীর সুবর্ণচরে ধানের শীষে ভোট দেওয়ার কারণে যে নারী ধর্ষণের শিকার হলেন, সেই মামলার আসামিদের নাম-পরিচয় দেখলে তিনি বুঝতে পারবেন আওয়ামী লীগের ইমেজ বেড়েছে না কমেছে।

বিএনপি এখন সংসদে নেই। ৩০ ডিসেম্বরের পর নির্বাচনেও নেই। নেতারা ঘরে বসে বক্তৃতা-বিবৃতি দিচ্ছেন। ঘরোয়াভাবে প্রতিবাদ করছেন। সেটিও আওয়ামী লীগের নেতারা মেনে নিতে পারছেন না। প্রতিটি কথার উত্তর দিচ্ছেন। কী কী কারণে মানুষ বিএনপিকে প্রত্যাখ্যান করেছে, সেই তত্ত্ব দেশবাসীকে শোনাচ্ছেন। কিন্তু নজিরবিহীন ‘সুষ্ঠু’ ও ‘শান্তিপূর্ণ’ নির্বাচনের পর (সিইসি অতীতের নির্বাচনের সহিংসতার সঙ্গে তুলনা করে এটিকে সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ বলে অভিহিত করেছেন) কেন হাইকোর্টের বারান্দায় শত শত লোক আগাম জামিনের জন্য ধরনা দিচ্ছে, কেন গায়েবি মামলায় হাজার হাজার মানুষ ঘরবাড়িছাড়া, কীভাবে প্রতিবন্ধী তারা মিয়ারা নাশকতা মামলার আসামি হলেন, ওবায়দুল কাদের সাহেবরা কি সেই প্রশ্নের জবাব দেবেন?

৩.
রাজনীতির এখন তিন কেন্দ্র। নয়াপল্টনে বিএনপির অফিস। ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগের অফিস। কিন্তু সংসদীয় রাজনীতিতে জাতীয় সংসদই রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু হওয়া উচিত। নতুন জাতীয় সংসদের অধিবেশন চলছে; কিন্তু এ নিয়ে জনমনে উৎসাহ-আগ্রহ কম। সংসদে বিরোধী দলের নেতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ অনুপস্থিত। সিঙ্গাপুর থেকে ফিরলেও এখনো অধিবেশনে যোগ দেননি। তাঁর অনুপস্থিতিতে উপনেতা গোলাম কাদের দায়িত্ব পালন করছেন। অন্যদিকে ১৪ দলের শরিকদের অবস্থান কী হবে, পরিষ্কার নয়। আওয়ামী লীগের ইচ্ছা অনুযায়ী তারা যদি বিরোধী দলে বসে, এরশাদকেই নেতা হিসেবে মেনে নিতে হবে। তাই ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন শুধু বিএনপিকেই বেকায়দায় ফেলেনি, ১৪ দলের শরিকদেরও বিব্রতকর অবস্থায় ঠেলে দিয়েছে।

এটিকে যদি নির্বাচনের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া ধরে নিই, ভবিষ্যতে আরও অনেক প্রতিক্রিয়া দেখতে থাকব।

দেশে এখন অন্য রকম রাজনীতি চলছে। বাড়িতে, অফিসে, পথে, আড্ডায় রাজনীতি নিয়ে কথা হয়। নির্বাচন নিয়ে ঘরোয়াভাবে আলোচনা-বিতর্ক হয়। কিন্তু কেউ প্রকাশ্যে কিছু বলে না। বলতে চায় না। অনেকে বলেন, মাঠ গরম করা রাজনীতি শেষ হয়ে গেছে। বাস্তবে রাজনীতিটাই মাঠে নেই। পাকিস্তান আমলে কড়া সামরিক শাসনের সময় হোটেল-রেস্তোরাঁয় লেখা থাকত, ‘এখানে রাজনৈতিক আলোচনা করা নিষেধ।’ রাজনৈতিক আলোচনা মানে সরকারের সমালোচনা। অনেক আগেই আমরা সেই পাকিস্তান আমল পার হয়ে এসেছি। এরপর দুজন সামরিক শাসকের শাসনও দেখেছি। কীভাবে ‘গণভোট’ করে তাঁরা গণরায়কে লাঞ্ছিত করেছিলেন তা-ও দেখেছি। বিএনপি বা জাতীয় পার্টির কেউ আর এখন বলেন না—গণভোটে প্রচারিত ফলাফল সঠিক ছিল।

৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনটি কেমন হয়েছে, ভোটে কী কী অনিয়ম হয়েছে, সেই সত্যও আশা করি একদিন প্রকাশিত হবে। ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলছেন, বাংলাদেশের পরিস্থিতি ভেনেজুয়েলার মতো হতে পারে। দেশটিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছে। বাংলাদেশে বাইরের কেউ হস্তক্ষেপ করেনি; বরং শেখ হাসিনা সরকারকে অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়েছে। তারপরও কেন মেনন সাহেব ভেনেজুয়েলার প্রতিধ্বনি শুনতে পেলেন, সেটাই বড় প্রশ্ন। এটি ঝড়ের পূর্বাভাস কি না সেই প্রশ্নের উত্তর ভবিষ্যৎই দিতে পারে।

সোহরাব হাসান : প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
sohrabhassan55@gmail.com