স্বাধীনতা দিবস—নাগরিক মাত্রেরই গর্ব ও আনন্দের দিন। সেই ছেলেবেলা থেকে স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপন করে আসছি। তখন অবশ্য ছিল পাকিস্তানের জমানা। চট্টগ্রাম নিয়াজ স্টেডিয়ামে স্বাধীনতা দিবসের মার্চপাস্ট দেখেছি। মাঠে প্রদর্শিত ছাত্রছাত্রীদের নানা রকম কসরত দেখেছি। জুনিয়র ক্যাডেট কোরের সদস্য হিসেবে নিজেও কুচকাওয়াজে অংশ নিয়েছি।
বাংলাদেশ হওয়ার পর সে উদ্যাপন বেড়েছে। পাকিস্তানের স্বাধীনতার কেবল গল্প শুনেছি। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতা আমাদের সমগ্র অস্তিত্বে জানান দিয়ে আসে। আগের মতোই ঢাকা স্টেডিয়ামে মার্চপাস্ট দেখি। জাতীয় পতাকা উত্তোলনের সঙ্গে জাতীয় সংগীত বাজতে শুরু করলে উঠে দাঁড়াই। শহীদদের স্মরণ করি, গর্ববোধ করি। বিশেষ করে মনে পড়ে ভারতেশ্বরী হোমসের ছাত্রীদের অপূর্ব প্রদর্শনী এবং জামালপুরের এক এতিমখানার শিক্ষকের তাঁর ছাত্রদের নিয়ে চলন্ত মোটরসাইকেলে দাঁড়িয়ে জাতীয় পতাকাকে অভিবাদনের দৃশ্য।
এর মধ্যে গড়ে ওঠে জাতীয় স্মৃতিসৌধ। ফুল নিয়ে সেখানে যাই। সরকারি চাকরিকালে কাকডাকা ভোরে হাজির হই, রাষ্ট্রপতির বঙ্গভবনে সংবর্ধনার মতো রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতায় যোগ দিই। যতবারই জাতীয় স্মৃতিসৌধে গেছি, এর নকশা দেখে বিমোহিত ও আবেগোপ্লুত হয়েছি। অবশেষে এর নকশাবিদ স্থপতি সৈয়দ মাইনুল হোসেনকে মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কার-২০২২ দেওয়া হয়েছে। তাঁর জীবদ্দশায় কি এ পুরস্কার দেওয়া যেত না? ভাবা যায়, তাঁকে আমির হামজার সঙ্গে একই কাতারে দাঁড় করানো হয়েছিল! সামাজিক ও প্রচারমাধ্যমে ব্যাপক প্রতিবাদের মুখে আমির হামজার নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। এ কারণে পুরস্কারটি কলঙ্কমুক্ত হয়েছে।
আজকাল স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানাদিতে আর যোগ দেওয়া হয় না। তবে এবার ২৬ মার্চ অন্য রকম একটা উদ্যাপনে যোগ দিয়েছি। আগের দিন শুক্রবার, সকালে জাতীয় স্মৃতিসৌধের পাশ দিয়ে চলে যাই ঢাকা থেকে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার দূরে ধামরাইয়ের গ্রাম শৈলানে। সেখানে শৈলান প্রবীণনিবাসের নির্মাণ ও বিভিন্ন কক্ষসজ্জা সম্পন্ন হয়েছে। চিকিৎসাসামগ্রীর সংগ্রহ করা হয়েছে।
২৫ মার্চ থেকে নিবাসের অতিথিরা আসতে শুরু করেন। পরদিন স্বাধীনতা দিবসে বসবাসের জন্য নিবাসটির দ্বার উন্মুক্ত করা হয়। শৈলান প্রবীণনিবাসে প্রায় ৮০ জনের থাকার সুব্যবস্থা আছে। ধর্মনির্বিশেষে এ নিবাস সব অসহায় প্রবীণের জন্য উন্মুক্ত। প্রবীণ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আবেদনকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রদান করা হবে।
নিবাসের সব বাসিন্দাকে বিনা মূল্যে বাসস্থান, পোশাক, খাবার ও অন্যান্য সামগ্রী এবং গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র হাসপাতালের সহায়তায় চিকিৎসাসেবা দেওয়া হবে।
প্রথমেই আসেন শৈলান গ্রামেরই বাসিন্দা মো. শহীদুল ইসলাম (৬২)। তিনি চলাচল করতে পারেন। তবে তাঁর স্ট্রোক হয়েছিল এবং ডায়াবেটিসে ভুগছেন। তাঁকে নিয়ে আসেন তাঁর স্ত্রী। তাঁদের একটি প্রতিবন্ধী সন্তান আছে। দুঃখিনী মা বললেন, স্বামীর দেখাশোনা ও চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। তাই তিনি স্বামীকে শৈলান প্রবীণনিবাসে নিয়ে এসেছেন। এরপর একে একে আসেন আউয়াল (৬৩)। ঝালকাঠির তারুলীতে তাঁর বাড়ি। তিনি কানে কম শোনেন। তাঁর অভিভাবক তাঁর মেয়ে। সবশেষে আসেন আনসার (৫৮)। তাঁর বাড়ি পটুয়াখালীর বাউফলে। তাঁর অভিভাবক তাঁর ছেলে। আনসার হালকা কাজ করতে পারেন। আমাদের বললেন, উঠানে ঘাস বড় হয়েছে। একখান কাঁচি পেলে ঘাস কাটতে পারেন। কাঁচি দিলে তিনি উৎসাহে ঘাস কাটতে শুরু করেন। স্থানীয় এক মালির সহায়তায় প্রবীণেরা সবাই মিলে নিবাসে ১০টি পেঁপেগাছ, তিনটি মাধবীলতা ও চারি অপরাজিতাগাছ লাগান। প্রবীণেরাই গাছগুলোর পরিচর্যা করার বিষয়ে আগ্রহ ব্যক্ত করেন।
আরও আসার কথা ছিল কয়েকজনের। তাঁদের মধ্যে আছেন তাড়াইল, কিশোরগঞ্জ ও পীরগঞ্জের কয়েকজন। ছিলেন পাশের গ্রাম রামদাইরের জামিরুন। তিনি এখন বলছেন, ঈদের পরে আসবেন। আমরা তাঁদের সবার জন্য অপেক্ষা করব।
প্রবীণদের থাকার স্থান, শৌচাগার ও গোসলের স্থান, খাবার ও টিভি কক্ষ, অফিস ও লাইব্রেরি কক্ষ, তত্ত্বাবধায়কের দপ্তর, নামাজ ও সভাস্থান, অজুর জায়গা, চারপাশে হাঁটাচলার পথ, বাগান করার জায়গা ও চিকিৎসাকক্ষ দেখিয়ে দেওয়া হয়। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র হাসপাতাল থেকে আসা চিকিৎসক প্রবীণদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন। নিবাসের নিরাপত্তাপ্রহরীদের সঙ্গেও তাঁরা পরিচিত হন। দুপুরের খাওয়া, বিকেলের নাশতা ও রাতের খাবার খেয়ে প্রবীণেরা ঘুমিয়ে পড়েন।
প্রথম দিন মাত্র তিনজন প্রবীণনিবাসে যোগ দেন। এতে আমরা খানিকটা নিরুৎসাহিত হলেও হতোদ্যম নই। স্বল্পসংখ্যক প্রবীণের চাহিদা সম্পর্কে জেনে তাঁদের প্রয়োজন মেটাতে শিখব এবং আমাদের সেবার মান বাড়াতে চাই। সর্বোপরি কাঙ্ক্ষিত সেবা প্রদানের মাধ্যমে আমরা তাঁদের আস্থা অর্জন করতে চাই।
পরদিন স্বাধীনতা দিবসে আমাদের অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন প্রবীণেরাই। আমাদের ট্রাস্টের চেয়ারপারসন সেবা সম্পর্কে অবহিত করেন। প্রবীণদের কাছে আমাদের প্রত্যাশা তুলে ধরেন। স্থানীয় ট্রাস্টি নিবাসের পেছনে শৈলান গ্রাম, সোমভাগ ইউনিয়ন ও ধামরাই উপজেলাবাসীর সমর্থনের কথা ব্যক্ত করেন। নবাগত এক প্রবীণ তাঁর নিবাসে যোগদানের অনুভূতি ও প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন শৈলান সুরমা হাইস্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি, প্রধান শিক্ষক ও তাঁর এক সহকর্মী। আরও ছিলেন স্থানীয় মাদ্রাসার সুপার ও শৈলান জামে মসজিদের খতিব। অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত আলোচনা শেষে শৈলান হাইস্কুলের তিন শিক্ষার্থী প্রবীণদের হাতে নতুন পোশাক তুলে দেয় এবং নিজ নিজ কক্ষে নিয়ে যায়। ছাত্রছাত্রীরা প্রবীণদের বলে, ‘আজ থেকে আপনারা আর নিঃসঙ্গ নন। আমরা আপনাদের সঙ্গে আছি এবং থাকব।’
আমরা বিশ্বাস করি, পরিবারই হচ্ছে প্রবীণদের জন্য শ্রেষ্ঠ আশ্রয়স্থল। শৈলান প্রবীণনিবাস কেবল তাঁদের জন্য, যাঁদের নিজের বা পরিবারের আয়–সম্পদ দিয়ে ভরণপোষণ সম্ভব নয়। অথবা সন্তানকে যদি চাকরি বা অন্য কোনো কারণে দেশের ভেতরে বা বাইরে অন্যত্র চলে যেতে হয়, মা–বাবাকে সঙ্গে নেওয়া সম্ভব না হলে কিংবা তাঁরা যেতে না চাইলে শৈলান প্রবীণনিবাস কেবল তাঁদের জন্য। নিবাসে আশ্রয় নিলেও পরিবারের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ থাকবে। পরিবারের সদস্যরা তাঁদের দেখে যেতে পারবেন। প্রবীণেরাও বিভিন্ন উৎসবে পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে পারবেন। শৈলান প্রবীণনিবাস তাঁদের ‘পরিবারের বাইরে পরিবার’ বা পরিবারের একটি বর্ধিতাংশ হিসেবে কাজ করবে।
নিবাসে বসবাসের যোগ্যতার মাপকাঠি চারটি। ১. বয়স ষাটের কাছাকাছি বা তদূর্ধ্ব হতে হবে। ২. নিম্নবিত্ত হতে হবে। ৩. চলাচলে সক্ষম। নিজের কাজ নিজে করতে সক্ষম হতে হবে—নিজের বিছানা করা, কাপড় ধোয়া ইত্যাদি করতে সক্ষম হতে হবে। ৪. ভালো মানুষ হতে হবে। গুরুতর অসুস্থ, পেশাদার ভিক্ষুক, নেশায় আসক্ত, মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের গ্রহণ ও সেবা প্রদান করা সম্ভব হবে না। তবে নিবাসে অবস্থানকালে কেউ অসুস্থ বা চলাচলে অক্ষম হলে তাঁর দেখভাল করা হবে।
আগেই বলেছি, নিবাসে বসবাসের জন্য বহুসংখ্যক আসন এখনো খালি আছে। আগে এলে আগে পাবেন ভিত্তিতে এগুলো উপযুক্ত প্রার্থীদের বরাদ্দ করা হবে। তাই পাঠকদের পরিচিত নিবাসে বসবাসের উপযুক্ত ও আগ্রহী প্রার্থীদের বিষয়ে আমাদের জানাতে অনুরোধ করছি।
শেষ করছি হেলাল হাফিজের স্বাধীনতার কবিতা ‘একটি পতাকা পেলে’ দিয়ে। ‘কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে/ আমি আর লিখবো না বেদনার অঙ্কুরিত কষ্টের কবিতা/ কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে/ ভজন গায়িকা সেই সন্ন্যাসিনী সবিতা মিস্ট্রেস/ ব্যর্থ চল্লিশে বসে বলবেন,—“পেয়েছি, পেয়েছি”। কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে/ পাতা কুড়োনির মেয়ে শীতের সকালে/ ওম নেবে জাতীয় সংগীত শুনে পাতার মর্মরে। কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে/ ভূমিহীন মনুমিয়া গাইবে তৃপ্তির গান জ্যৈষ্ঠে-বোশেখে,/ বাঁচবে যুদ্ধের শিশু সসম্মানে সাদা দুধে-ভাতে। কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে/ আমাদের সব দুঃখ জমা দেব যৌথ-খামারে, সম্মিলিত বৈজ্ঞানিক চাষাবাদে সমান সুখের ভাগ/ সকলেই নিয়ে যাবো নিজের সংসারে।’
দেশের সব নাগরিকের জন্য স্বাধীনতা অর্থবহ হোক। সবাইকে স্বাধীনতা দিবসের অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা।
● মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান সাবেক সচিব ও অধ্যাপক
shailanprobeennibash@gmail.com