অনুসন্ধান কমিটি সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ তৈরি করতে পারবে না

সাম্প্রতিক কালে দেশের রাজনীতিতে আলোড়ন সৃষ্টিকারী ইস্যুতে পরিণত হয়েছে সদ্য পাস হওয়া আইনের ভিত্তিতে অনুসন্ধান কমিটি গঠন এবং কমিটির সুপারিশকৃত দশ ব্যক্তির মধ্য থেকে মহামান্য রাষ্ট্রপতির আদেশে পাঁচজনের সমন্বয়ে নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনের প্রক্রিয়া। এই পাঁচজনের একজন হবেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার, আর চারজন কমিশনার। ১৪ ফেব্রুয়ারি ওয়েবসাইটে ৩২২ জন ব্যক্তির তালিকা প্রকাশিত হয়েছে, যেখানে দেশের খ্যাতিমান শিক্ষাবিদ, বিচারপতি, অবসরপ্রাপ্ত আমলা, সামরিক কর্মকর্তা, পেশাজীবী ও মিডিয়া ব্যক্তিত্বদের অনেকেরই নাম পাওয়া যাচ্ছে। তাঁদের মধ্য থেকে অনুসন্ধান কমিটি অনায়াসে নির্বাচন কমিশনের সম্ভাব্য দশ সদস্যকে পছন্দ করতে পারবে (তালিকার বাইরে থেকেও যে কাউকে বাছাই করার এখতিয়ার অনুসন্ধান কমিটির রয়েছে)।

নির্বাচন কমিশন গঠনের এই পদ্ধতির বিরুদ্ধে ভালো যুক্তি খাঁড়া করা যাবে না। কিন্তু সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের গেরো এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে খুলবে না। কারণ, সংকটের গোড়ায় রয়ে গেছে নির্বাচনকালীন সরকার। ক্ষমতাসীন সরকারের মেয়াদের শেষ দিকে এসে ওই সরকারকে ‘লেম-ডাক’ সরকার হিসেবে বহাল রেখে পরবর্তী সংসদীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের নিয়ম-নীতি বিশ্বের প্রায় সব দেশে থাকলেও স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন সরকারকে বহাল রেখে একবারও জালিয়াতিমুক্ত নির্বাচন হয়নি। লেম-ডাক সরকারব্যবস্থায় বিদেশনীতি, অর্থছাড় এবং দৈনন্দিন আইনশৃঙ্খলা রক্ষার মতো নেহাত কয়েকটি রুটিন বিষয় পরিচালনা ব্যতীত সরকারের বড় কোনো নীতি গ্রহণ ও পরিবর্তনের ক্ষমতা থাকে না। এমনকি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন পুলিশ-বিজিবি-র‍্যাব-আনসার-ভিডিপি এবং নির্বাচনসংশ্লিষ্ট সব সরকারি-স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদায়ন, বদলি, নীতি বাস্তবায়ন, শৃঙ্খলা বজায় এবং দৈনন্দিন পরিচালনার দায়িত্বও নির্বাচনপ্রক্রিয়া শুরু হওয়ামাত্রই নির্বাচন কমিশনের কাছে থাকার কথা।

২০১৪ সালের সংসদীয় নির্বাচনের আগে জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর মধ্যস্থতায় অনুষ্ঠিত সংলাপে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ একটি লেম-ডাক সরকারব্যবস্থা সম্পর্কে রাজি হওয়ার কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল, কিন্তু খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রীর পদে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাসীন রেখে কোনো আপসে যেতে রাজি না হওয়ায় ওই ফর্মুলা ভেস্তে যায়। এর ফলে আওয়ামী লীগ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচন করে আবার ক্ষমতাসীন হওয়ার সুযোগ পেয়ে যায়। পরবর্তী সময় বিএনপি স্বীকার করেছে, ওই ফর্মুলা গ্রহণ না করা তাদের ভুল ছিল।
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে বিএনপি কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করেও মনোনয়ন-বাণিজ্যসহ অনেক ভুল নীতি ও সিদ্ধান্তের কারণে নির্বাচনে চরম বিপর্যয় এড়াতে পারেনি। আমার বিশ্বাস, ভোটের আগেই নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চাণক্যনীতিকে কৌশল হিসেবে নিয়েছিল বিএনপি, হয়তো তাদের তত্ত্বকে প্রমাণ করার জন্য যে কোনো ক্ষমতাসীন দলীয় সরকারের অধীন এ দেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।

ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকারকে ক্ষমতায় রেখে যেহেতু ওই নির্বাচন সব দলের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হচ্ছিল, তাই দেশের জনগণের মধ্যে ভীষণ উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা ছিল। একই সঙ্গে প্রত্যাশা ছিল, এই অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হলে রাজনীতির একটা বড়সড় গ্যাঁড়াকল থেকে দেশটা মুক্তি পেয়ে যেত। কারণ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিটা আদায় করা যাবে না জেনেও বিএনপি-জামায়াত ওই দাবি নিয়ে ২০১১ সাল থেকে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টির পাঁয়তারা চালিয়ে যাচ্ছিল এবং এখনো যাচ্ছে। দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, ১৯৭৩ সাল থেকে শুরু করে ক্ষমতাসীন দলীয় সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত কোনো নির্বাচনই বাংলাদেশে সুষ্ঠু না হওয়ায় দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম করে ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার চালু হয়েছিল সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী পাসের মাধ্যমে। ওই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিল আওয়ামী লীগই।

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুমের মতো মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং ব্যালট জবরদখলের মাধ্যমে ভোট জালিয়াতির ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র যদি কঠোর কোনো পদক্ষেপ নেয় তাহলে আমাদের বিপদ বাড়বে। আমাদের উদীয়মান অর্থনীতিও এর ফলে চাপের মুখে পড়তে পারে। অতএব, অবিলম্বে তারানকোর ফর্মুলার আলোকে সত্যিকার লেম-ডাক সরকারব্যবস্থার আইন পাসের প্রক্রিয়া শুরু করা এখন সরকারের জন্য অনিবার্য হয়ে পড়েছে।

কিন্তু ১৯৯১ সালের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং ১৯৯৬-২০০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত চারটি নির্বাচনের কোনোটাতেই নির্বাচনের অব্যবহিত আগে ক্ষমতাসীন দল বা জোট নির্বাচনে জিততে পারেনি। কারণ, এ দেশে ক্ষমতায় থাকা যেহেতু পুঁজি লুণ্ঠনের লাইসেন্স পাওয়ার ও একচেটিয়া ক্ষমতা ফলানোর অসীম সুযোগে পরিণত হয়, তাই পূর্ববর্তী ক্ষমতাসীন দল বা জোট দ্রুত জনপ্রিয়তা হারিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত প্রতিটি নির্বাচনেই জনগণ দ্বারা প্রবলভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। ২০০৮ সালে নির্বাচিত মহাজোট তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এই ‘অ্যান্টি-ইনকামবেন্সি বায়াস’ উপলব্ধি করে ২০১০ সালে প্রদত্ত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায়ের সুযোগ নিয়ে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্ত করে ২০১১ সালে আগের ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তিত করেছে।

অতএব সুষ্ঠু নির্বাচন হলেও আওয়ামী লীগ ও মহাজোট বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করত—এ ব্যাপারে সাধারণ জনগণের মনে স্পষ্ট ধারণা গড়ে উঠেছিল। উপরন্তু, বিএনপি ইচ্ছাকৃতভাবে নির্বাচনী প্রচার থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেওয়ায় মহাজোটের নেতা-কর্মীরা খালি মাঠ পেয়ে গিয়েছিলেন। নির্বাচনের তিন দিন আগে একাত্তর টেলিভিশনের ‘একাত্তর সংযোগ’ শীর্ষক টক শোতে আমি অভিযোগও করেছিলাম যে ধানের শীষের প্রার্থীরা ইচ্ছাকৃতভাবে নির্বাচনী মাঠে নিষ্ক্রিয় থাকার কৌশল নিয়েছেন! আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব ও তাঁর উপদেষ্টারা জনগণের এই নাড়িস্পন্দন ধরতে পারলেন না এবং নির্বাচনী পরিবেশের এহেন একতরফা সুবিধা কাজে লাগাতে পারলেন না। অতএব, জালিয়াতির শিকার ওই নির্বাচনকে এর পর থেকে ‘আগের রাতের ব্যালট জবরদখলের নির্বাচন’ বদনামটা বয়ে বেড়াতে হচ্ছে।

সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপি ও তাদের সঙ্গে জোটবদ্ধ দলগুলো ক্ষমতাসীন সরকারের অধীন কোনো নির্বাচন না করার অবস্থানে রয়েছে। কিন্তু তাদের সাংগঠনিক দুর্বলতা বর্তমানে এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যে এ ইস্যুতে জনগণকে তারা আন্দোলনের মাঠে নামাতে পারছে না। তারপরও আওয়ামী লীগকে মনে করিয়ে দিচ্ছি, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আয়োজিত গত ৯ ও ১০ ডিসেম্বরের গণতন্ত্র সম্মেলনে বিশ্বের ১১০টি দেশকে আমন্ত্রণ জানানো হলেও বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ না জানানোয় বাংলাদেশের গণতন্ত্রের লাইনচ্যুতির ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অসন্তোষের ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়েছে। লাইনচ্যুত ভোটের রাজনীতিকে অবিলম্বে মেরামত না করা হলে অদূর ভবিষ্যতে জাতি বড়সড় বিপদে পড়বে বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলোর ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপের মাধ্যমে। এমনকি এ ইস্যুতে খোদ জাতিসংঘও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে পারে। তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে দোষারোপ করে পার পাওয়া যাবে না।

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুমের মতো মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং ব্যালট জবরদখলের মাধ্যমে ভোট জালিয়াতির ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র যদি কঠোর কোনো পদক্ষেপ নেয় তাহলে আমাদের বিপদ বাড়বে। আমাদের উদীয়মান অর্থনীতিও এর ফলে চাপের মুখে পড়তে পারে। অতএব, অবিলম্বে তারানকোর ফর্মুলার আলোকে সত্যিকার লেম-ডাক সরকারব্যবস্থার আইন পাসের প্রক্রিয়া শুরু করা এখন সরকারের জন্য অনিবার্য হয়ে পড়েছে। একই সঙ্গে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন পুলিশ-বিজিবি-র‍্যাব-আনসার-ভিডিপি এবং সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ও নির্বাচনী দায়িত্বপ্রাপ্ত অন্যান্য সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদায়ন, বদলি, শৃঙ্খলা বিধান এবং দৈনন্দিন পরিচালনার দায়িত্বও নির্বাচনপ্রক্রিয়া শুরু হওয়ামাত্রই নির্বাচন কমিশনের হাতে কার্যকরভাবে ন্যস্ত করার আইন সংসদে পাস করার আশু পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছি।

ড. মইনুল ইসলাম অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি