দেশের কোনো কিছু ঠিকঠাক কাজ না করলেও গত ১০ বছরে আমাদের প্রবৃদ্ধির হার গড়ে ৬ শতাংশের ওপরে এবং ২০১৮–১৯ অর্থবছরে তা ৮ শতাংশের ওপরে। বিষয়টি বিদেশি উন্নয়নবিশারদদের কিছুটা ধন্দে ফেলে দেয়। আর সে কারণেই তাঁরা বাংলাদেশের উন্নয়নকে ‘প্যারাডক্স’ হিসেবে আখ্যা দেন। তাঁদের কাছে ব্যাপারটা ধাঁধার মতো। কিন্তু বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদেরা এই শব্দবন্ধের ব্যাপারে নানা আপত্তি তুলেছেন।
দেশের কোনো কিছু নিয়মমাফিক চলে না, তা ঠিক। কিন্তু এই অনিয়মের মধ্যেও একধরনের নিয়ম আছে। নিয়মটা হলো, এখানে যে কেউ চাইলেই যা খুশি তা করতে পারেন, যদি এর মধ্যে অতিরাজনৈতিক বিবেচনা না থাকে। তা না হলে ব্যাপারটা বোধ হয় সম্ভব হতো না। এই প্রবণতা বুঝতে তত্ত্বগত কাঠামোর জন্ম দিয়েছেন ল্যান্ট প্রিটশেট, কুনাল সেন ও এরিক রেকার। তাঁরা এর নাম দিয়েছেন ‘ডিলস স্পেস’। ডিল বা চুক্তি এখানে রুলস বা নিয়মের বিপরীত প্রপঞ্চ। অর্থাৎ রুলস বা নিয়মের অনুপস্থিতিতে এখানে অনানুষ্ঠানিক চুক্তির জগৎ গড়ে উঠেছে। এই জগৎ যেমন উন্মুক্ত হতে পারে, আবার বদ্ধও হতে পারে। এটি একদিকে সুশৃঙ্খল হতে পারে, তেমনি বিশৃঙ্খলও হতে পারে।
এই তত্ত্বানুসারে চুক্তির জগৎ উন্মুক্ত ও সুশৃঙ্খল হলে তা দেশের প্রবৃদ্ধির জন্য সহায়ক হয়। এই দেশের এখনো প্রায় ৮৬ শতাংশ মানুষ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন, যাঁদের কাজের নিরাপত্তা নেই বললেই চলে। অর্থনৈতিক হিসাবেও যাঁদের ভূমিকা অনেকটা অদৃশ্য। বিষয়টি বোঝার জন্য বাংলাদেশি অর্থনীতিবিদ মুশতাক খানের ‘প্রবৃদ্ধি-সহায়ক প্রতিষ্ঠান’তত্ত্বের দ্বারস্থ হওয়া যায়। তিনি দেখিয়েছেন, উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রতিষ্ঠান বাজারব্যবস্থার বিকাশ না করে বরং একধরনের প্রবৃদ্ধি-সহায়ক ব্যবস্থার জন্ম দিয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে বিষয়টি দেখা যায়। নিয়মের অনুপস্থিতিতে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে একধরনের চুক্তির জগৎ তৈরি হয়েছে। এই চুক্তির জগৎ তার ভাষার ওপেন অ্যান্ড অর্ডারড (উন্মুক্ত ও সুশৃঙ্খল) হলে তা প্রবৃদ্ধির সহায়ক হয়।
পাশাপাশি বাংলাদেশ কিছু নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে অত্যন্ত ভালো করেছে: তৈরি পোশাকশিল্প, ক্ষুদ্রঋণ, শ্রমশক্তি রপ্তানি, কৃষি উৎপাদন বাড়াতে গবেষণা ইত্যাদি। সানেমের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সেলিম রায়হান এসব প্রতিষ্ঠানকে ‘পকেটস অব ডেভেলপমেন্ট’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। অর্থাৎ উন্নয়নের কিছু নির্দিষ্ট জায়গা। এ ক্ষেত্রে তৈরি পোশাকশিল্পের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর দেশের গ্রামাঞ্চলে
কাজের অভাবে যখন বিপুলসংখ্যক মানুষ শহরে আসতে শুরু করে, তখন যদি এই তৈরি পোশাকশিল্প বা এ রকম শ্রমঘন অন্য শিল্প গড়ে না উঠত, তাহলে কী হতো, বলা মুশকিল। এটি এখন দেশের বৃহত্তম কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী খাত। গ্রামে কাজ না পেয়ে মানুষ বড় বড় শহরে আসছে শুধু এই আশায় যে, আর কিছু পাওয়া যাক বা না যাক, গার্মেন্টসে তো কাজ পাওয়া যাবে। এই খাত দেশের বিপুল মানুষকে চাকরির স্বাদ দিয়েছে।
পাশাপাশি ক্ষুদ্রঋণ ও এনজিওগুলোর অন্যান্য কার্যক্রম একদিকে যেমন সমাজে টাকার সংস্থান জুগিয়েছে, অন্যদিকে সমাজে অনেক বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করেছে। ফলে আজ মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস এবং শিশুর টিকাদানে বাংলাদেশ প্রভূত উন্নতি করেছে। দেশের প্রায় এক কোটি মানুষ এখন বিদেশে কাজ করছেন। তাঁরা এখন বিপুল পরিমাণ রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন। স্বাভাবিকভাবেই গ্রামাঞ্চলে টাকার সরবরাহ বেড়েছে। মানুষের অবস্থার উন্নতি হয়েছে। পরিস্থিতি এমন জায়গায় চলে গেছে যে বিশ্বব্যাংক গবেষণা করে দেখিয়েছে, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এখন যে পরিমাণ ওডিএও (অফিশিয়াল ডেভেলপমেন্ট অ্যাসিস্ট্যান্স) বা প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিএ) আসে, তার চেয়ে বেশি আসে রেমিট্যান্স। ফলে এই রেমিট্যান্স আমাদের মতো দেশগুলোকে উন্নয়ন–সহযোগীদের ওপর নির্ভরশীলতা থেকে বের করে আনতে পারে, যদি তা আমরা সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারি। অন্যদিকে কৃষি উৎপাদন ব্যাপক হারে বাড়ায় এখন আমরা খাদ্যে একরকম স্বয়ংসম্পূর্ণ।
আরেকটি ব্যাপার হলো, বাংলাদেশের মানুষের উদ্যম ও জেদ। সবাই এখন কিছু না কিছু করার চেষ্টা করছে। বসে থেকে পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষের ওপর নির্ভরশীল থাকার মানসিকতা থেকে এ দেশের মানুষ অনেকটাই বেরিয়ে আসতে পেরেছে। বিপুল মানুষ এখন নানা ধরনের উদ্যোগ নিচ্ছেন। এর সবই প্রায় অনানুষ্ঠানিক খাতে, তাই এগুলোকে কীভাবে আনুষ্ঠানিক খাতে নিয়ে আসা যায়, সেটাই এখন আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
সম্প্রতি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ওপর বাজেটের প্রভাব নিয়ে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক, উন্নয়ন সমন্বয় ও আইসোশ্যালের একটি যৌথ জরিপের প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে পেশাগত কারণে যাওয়ার সুযোগ হয়। সমীক্ষার প্রতিবেদনে দেখা গেছে, যে ৪ হাজার ৮০০ মানুষের মধ্যে এই জরিপ চালানো হয়েছিল, তাঁদের ৬৪ শতাংশের কাছে শিক্ষাই প্রধান অগ্রাধিকার। মানুষ বুঝে গেছে, শ্রেণিগত উন্নতির জন্য শিক্ষাই প্রধান হাতিয়ার। সে জন্য মানুষ শত কষ্ট সহ্য করেও সন্তানের পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েক বছর আগে যে ভ্যাটবিরোধী আন্দোলন হলো, তা থেকেও ব্যাপারটা বোঝা যায়। আগে ধারণা ছিল, সচ্ছল মানুষের সন্তানেরাই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন, কিন্তু ভ্যাটবিরোধী আন্দোলন সেই ধারণা ভুল প্রমাণিত করল। এই সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের ছাত্ররা ভ্যাটকে বোঝা হিসেবেই দেখেছেন। তাই তাঁরা ভ্যাট বাতিলের দাবিতে রাস্তায় নামেন।
মেয়েদের বিদ্যালয়ে আনার জন্য সরকার যেসব কর্মসূচি চালাচ্ছে, তার বড় প্রভাব আছে। জেলা শহরগুলোতে কোচিং সেন্টার ও কিন্ডারগার্টেনের হিড়িক দেখলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়, যদিও শিক্ষার মান নিয়ে বড় ধরনের উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হচ্ছে, মেয়েদের স্কুলে ভর্তি হওয়ার হার এখন প্রায় শতভাগ। এটি বাংলাদেশকে অনেক দূর নিয়ে যাবে বলেই ধারণা করা যায়।
যা হোক, প্যারাডক্স শব্দটির সবচেয়ে জুতসই বাংলা সম্ভবত আপাত–স্ববিরোধ, অর্থাৎ আপাতদৃষ্টিতে কোনো কিছু স্ববিরোধী মনে হলেও তা সত্য বর্জিত নয়। সে কারণেই বাংলাদেশ হাজার সমস্যা সত্ত্বেও এভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। ব্যাপারটা ধাঁধা নয়। এর একটা নিজস্ব আখ্যান আছে। তবে এভাবে আর কত দূর যাওয়া যাবে, তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।
প্রতীক বর্ধন: প্রথম আলোর সহসম্পাদক
bardhanprotik@gmail.com