মতামত

অনলাইনে নারীর প্রতি সহিংসতার লাগাম টানবে কে

অনলাইনে নারীর প্রতি সহিংসতাকে কয়েক বছর আগে ‘দু–একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বলে পার পাওয়া গেলেও এখন তা সর্বজনীন হয়ে উঠেছে। দুঃখজনক বাস্তবতা হচ্ছে, প্রায় প্রতিটি ঘরে অনলাইনে সহিংসতার শিকার হওয়া নারীর সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে। এর প্রেক্ষাপট হচ্ছে, মানুষের হাতে হাতে পৌঁছে গেছে স্মার্টফোন, ওয়াই–ফাই আর ইন্টারনেট ডেটা হয়েছে সহজলভ্য। ২০২০ সালের মার্চ থেকেই আমরা করোনাকালের দুঃসময়ে বাস করছি। করোনাকালে শিক্ষা কার্যক্রম পুরোটাই অনলাইননির্ভর। হোম অফিস (ওয়ার্ক ফ্রম হোম) থেকে শুরু করে কেনাকাটা অনলাইননির্ভরতা বাড়িয়েছে।

বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) সর্বশেষ অক্টোবর মাসের হিসাব অনুযায়ী, দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১১ কোটির বেশি। এর মধ্যে ব্রডব্যান্ড ব্যবহারকারীর সংখ্যা সাড়ে ৮৬ লাখ। বাকিরা মুঠোফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। ইন্টারনেটের ব্যবহার যেমন বেড়েছে, একই সঙ্গে বেড়েছে হয়রানিও। এ ক্ষেত্রে বয়স, শ্রেণি, পেশার ভেদাভেদ না থাকলেও সবচেয়ে বেশি হয়রানি ও সহিংসতার শিকার হচ্ছেন নারী।

ইন্টারনেটের ব্যবহার যেমন বেড়েছে, একই সঙ্গে বেড়েছে হয়রানিও। এ ক্ষেত্রে বয়স, শ্রেণি, পেশার ভেদাভেদ না থাকলেও সবচেয়ে বেশি হয়রানি ও সহিংসতার শিকার হচ্ছেন নারী

অনলাইনে নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রম চালু রয়েছে। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে ব্যবস্থাগুলো শতভাগ কার্যকর হচ্ছে না। তবে কি যথাযথ কর্তৃপক্ষ সহিংসতার মাত্রা ও ভয়াবহতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়? যদি তা–ই হয়, তবে সম্প্রতি প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ ও প্রথম আলোর একটি জরিপের ফলাফল দেখলেই তারা ধারণা পাবে। জরিপটি বলছে, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারকারীর ৭৯ শতাংশ কখনো কখনো অনলাইনে হয়রানি ও সহিংসতার শিকার হয়েছেন, তার মধ্যে ৫৩ শতাংশ নারী। এর বেশির ভাগই বিশেষত নতুন স্মার্টফোন ব্যবহারকারী কিশোরী-তরুণী। (প্রথম আলো,২৫ নভেম্বর ২০২০)

এটা গেল পরিমাণ। ধরনটা? অনেক ক্ষেত্রেই খুব সাধারণ ঘটনা থেকে শুরু হয়ে নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা ঘটে। ব্যাপারটা এখন আর ফেসবুকের ইনবক্সে যখন-তখন ‘হায়-হ্যালো-কেমন আছেন’ ধরনের অযথা উৎপাতের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, বরং তা নানা দিকে নানা মাত্রায় ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে। পরিচিত এক তরুণীর কথাই বলি। তাঁর নাম সোনিয়া (ছদ্মনাম)। সোনিয়ার সহপাঠী এক যুবক তাঁকে প্রেমের প্রস্তাব দেন এবং সোনিয়া তা প্রত্যাখ্যান করেন। পরে সেই যুবক ক্ষিপ্ত হয়ে সোনিয়ার ফোন নম্বর একটি পর্নো সাইটে দিয়ে দেন। এরপর একের পর এক ফোন আসতে শুরু করে আর নানা ধরনের হয়রানিমূলক কথা ও অশ্লীল প্রস্তাব। অবশেষে দীর্ঘদিনের পুরোনো ফোন নম্বর পাল্টে এ বিড়ম্বনা থেকে কোনোমতে রক্ষা পেয়েছেন সোনিয়া। কিন্তু মাঝের পুরো সময়টা তিনি যে মানসিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে গেছেন, তা অবর্ণনীয়। তখন তিনি মানসিকভাবে এতটাই ভেঙে পড়েছিলেন যে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের দ্বারস্থ হতে হয়েছিল পর্যন্ত। প্ল্যান-প্রথম আলোর জরিপ বলছে, নারীদের ক্ষেত্রে মানসিকভাবে এ রকম চাপে পড়ার ঘটনা ঘটছে ৭১ শতাংশ।

অফিসে পুরুষ সহকর্মীর মাধ্যমেও নারীরা হয়রানির শিকার হন। সমাজে এ ধরনের ঘটনার সংখ্যা নেহাত কম নয়। অনলাইনে হয়রানির শিকার হয়ে পেশা পরিবর্তন করেছেন, চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন কিংবা স্বাধীন চলাচলে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছেন, এমন নারীর সংখ্যা ৩২ শতাংশ বলে তথ্য উঠে এসেছে প্ল্যান-প্রথম আলোর জরিপে। এ ধরনের ঘটনাও অহরহ ঘটছে। জরিপ বলছে, অনলাইনে নিরাপত্তাহীনতায় পড়েছেন ২৫ শতাংশ নারী আর সামাজিকভাবে হেয় হয়েছেন ১৭ শতাংশ নারী।

আমাদের চারপাশে হয়রানির শিকার হওয়া এ রকম নারীর সংখ্যা অসংখ্য। কখনো তাঁরা অভিযোগ করেন, কখনো চুপ থাকেন। বেশির ভাগ ভুক্তভোগী নারী বলছেন, তাঁরা কোথায় অভিযোগ করবেন এবং কত দিনে বিচার পাবেন, এসব ভেবে আর এগোতে চান না। কোথায় অভিযোগ করতে হবে, অর্থাৎ আইনি ব্যবস্থা সম্পর্কে জানেন না, এমন নারীর সংখ্যা ৬২ শতাংশ।

সম্প্রতি পুলিশের মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদ পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন (পিসিএসডব্লিউ) ফেসবুক পেজ উদ্বোধন করেছেন। এই ফেসবুক পেজে (http://m.facebook.com/PCSW.PHQ/) গিয়ে মেসেঞ্জারে অভিযোগ জানাতে পারবেন হয়রানির

শিকার যেকোনো নারী বা শিশু। এ ছাড়া ই-মেইল ও হটলাইন নম্বরে যোগাযোগ করেও সহযোগিতা নিতে পারবেন। ই-মেইল ঠিকানা cybersupport.women@police.gov.bd। হটলাইন নম্বরটি হলো ০১৩২০০০০৮৮৮। এই ইউনিট পরিচালনার দায়িত্বে থাকবেন নারী পুলিশ কর্মকর্তারা। তাঁদের কাজ হবে ঘটনার শিকার নারী ও শিশুদের বিচার পেতে সহযোগিতা করা।

সামাজিক মাধ্যমের আইডি হ্যাক করে ব্ল্যাকমেল করার ঘটনাও মাঝেমধ্যে শোনা যায়। টু-স্টেপ ভেরিফিকেশনের মাধ্যমে এ সমস্যা থেকে অনেকটাই মুক্তি পাওয়া সম্ভব। এর জন্য প্রয়োজন সচেতনতা। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা অনলাইন ব্যবহারে নারীদের সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করছে। এ ধরনের কার্যক্রম আরও বাড়ানো দরকার।

পাঠ্যপুস্তকে অনলাইন নিরাপত্তার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি হয়ে পড়েছে। এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের আরও তৎপর হওয়া দরকার। আমরা আশা করি, অনলাইন জগৎ নারীর জন্য সুরক্ষিত হবে।


ফিরোজ চৌধুরী প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক