ইঙ্গিতটা কিন্তু এই সেদিন রাহুল গান্ধীই দিয়েছিলেন, রাজনীতির পণ্ডিতেরা হায় কেউ বুঝতেই পারেননি। পারলে কাগজে কাগজে অবশ্যই জল্পনা শুরু হয়ে যেত।
রাহুল তখন দুবাইয়ে। উত্তর প্রদেশের লক্ষ্ণৌয়ে ‘বুয়া-ভাতিজা’ জুটি মায়াবতী ও অখিলেশ সংবাদ সম্মেলন করে কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে রাজ্যের ছিয়াত্তরটা আসন নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছেন। কংগ্রেসের জন্য ছেড়ে রেখেছেন আমেথি ও রায়বেরিলি। এ ছাড়া ছেড়েছেন আর দুটো মাত্র আসন। সেই দুটোর নাম তাঁরা করেননি, তবে বুঝিয়ে দিয়েছেন ওই দুই আসন তাঁরা ছাড়ছেন পশ্চিম-উত্তর প্রদেশের জোট নেতা অজিত সিংয়ের রাষ্ট্রীয় লোকদলের জন্য। নিজেদের জন্য তাঁরা ধরে রাখলেন ৩৮টি করে আসন।
আজকের দুনিয়ায় খবর আলোর গতিতে ছোটে। রাহুলকে ঘিরে ধরলেন দুবাইয়ের সাংবাদিকেরা। ইঙ্গিতটা তাঁর সেখানেই দেওয়া। রাহুল বলেছিলেন, মায়াবতী ও অখিলেশের প্রতি তিনি গভীর শ্রদ্ধাশীল। নিজস্ব ভাবনা অনুযায়ী রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্ণ অধিকার তাঁদের রয়েছে। তাঁদের মতো রাহুলও চান বিজেপিকে ক্ষমতাচ্যুত করতে। তবে একই সঙ্গে তিনি চান কংগ্রেসও শক্তিশালী হয়ে উঠুক। এরপরই রাহুল বলেছিলেন, ‘উত্তর প্রদেশে আমরাও দু-একটা চমক দেখাব। আমাদের মতো করে আমরা ওই রাজ্যে নিজেদের শক্তিতে লড়ব।’
সেদিন কেউ বোঝেননি, ৪৭ বছরের বোন প্রিয়াঙ্কাই হতে চলেছেন রাহুলের সবচেয়ে বড় চমক! কংগ্রেসের রাজনীতিতে প্রিয়াঙ্কা কিন্তু সেই অর্থে চমক নন। ১০ বছর ধরে আমেথি ও রায়বেরিলি তাঁর দ্বিতীয় ঘরবাড়ি। ভোটের সময় তো বটেই, অন্য সময়েও নানা রকম সামাজিক কাজকর্মে এই দুই কেন্দ্রে তিনি জড়িয়ে থাকেন। ছোট ছোট জমায়েতে ভাষণ দেন। কিন্তু সবটাই দলের ভেতরে থেকেও আলগা আলগা। এই প্রথম রাহুল তাঁর বোনকে আনুষ্ঠানিকভাবে দলের পদাধিকারী করলেন। দায়িত্ব দিলেন উত্তর প্রদেশের অর্ধেক আসনের। দায়িত্ব পালনে তিনি সফল না ব্যর্থ, এই প্রথম তা দাঁড়িপাল্লায় তুলে মাপা হবে। দায়িত্ব এড়ানোর কোনো উপায় এবার রইল না। খুব স্বাভাবিক, কংগ্রেসের নেতা-কর্মীরা এই ঘোষণায় উৎফুল্ল। চনমনে হয়ে উঠেছে উত্তর প্রদেশের রাজনীতিও। প্রিয়াঙ্কার অভিষেকের অর্থ কী কী, সেসব নিয়ে শুরু হয়েছে জল্পনা। উত্তর প্রদেশের রাজনীতিতে তিন দশক ধরে প্রায়ই নির্জীব থাকা কংগ্রেসকে প্রিয়াঙ্কা নামক জিয়নকাঠি নতুন জীবন দিতে পারবে কি না—সেটা যেমন প্রশ্ন, তেমনি প্রশ্ন, এই সিদ্ধান্ত রাজ্যে কার বাড়া ভাতে ছাই ফেলবে।
সব থেকে বেশি প্রতিক্রিয়া এসেছে বিজেপির দিক থেকে। দলের মুখপাত্র থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীরা প্রতিক্রিয়া তো জানিয়েছেন, খোদ প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত মুখ খুলেছেন। নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, ‘আবার প্রমাণ হলো কংগ্রেসের কাছে পরিবারই দল, আমাদের কাছে দলই পরিবার।’ তবে বুধবার রাত ও বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি ‘বুয়া-ভাতিজা’ জুটির কাছ থেকে। এই দুই ভিন্নধর্মী আচরণের রাজনৈতিক অর্থ তাহলে কী?
বিজেপির চিন্তিত হওয়ার প্রধান কারণ তাদের ও কংগ্রেসের ভোটব্যাংক অভিন্ন। জাতপাতভিত্তিক উত্তর প্রদেশে কংগ্রেসের সমর্থন যেটুকু অবশিষ্ট রয়েছে, তা প্রধানত উচ্চবর্ণের মধ্যে সীমাবদ্ধ। ২০১৪ সালের লোকসভায় সাড়ে ৭ শতাংশ এবং ২০১৭ সালের বিধানসভা ভোটে ৬ শতাংশের সামান্য বেশি যে ভোট কংগ্রেস পেয়েছে তা প্রধানত ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্যর মতো উচ্চবর্ণের। তিন দশক ক্ষমতার বাইরে থাকায় উচ্চবর্ণের বিপুল সমর্থন ক্রমেই চলে গেছে বিজেপিতে। রাজ্যের যাদবপ্রধান অনগ্রসর শ্রেণি বেছে নিয়েছে সমাজবাদী পার্টিকে, জাটভপ্রধান দলিত সম্প্রদায় কোল পেতে দিয়েছে মায়াবতীর বহুজন সমাজ পার্টিকে। মুসলমানেরা প্রধানত ভিড় করেছে এসপিতে। কিছুটা বিএসপিতেও। প্রতি ভোটে মুসলমান দেখেছে বিজেপিকে হারাতে এসপি, বিএসপি ও কংগ্রেসের মধ্যে কার সম্ভাবনা বেশি। সেই দেখে কেন্দ্র হিসেবে তারা ট্যাকটিক্যাল ভোট করেছে। প্রিয়াঙ্কার প্রবেশের ফলে উচ্চবর্ণ বেশি উদ্বেলিত হলে বিজেপির সর্বনাশ অবধারিত। বিশেষ করে উচ্চবর্ণের যুবসম্প্রদায়, চাকরিহীন প্রবৃদ্ধি যাদের অখুশি রেখেছে। মনে রাখা দরকার, ২০০৯ সালের লোকসভা ভোটে আলাদা লড়াই করে কংগ্রেস এই রাজ্যে ২১টা আসন জিতেছিল। সেগুলোর মধ্যে ১৩টাই ছিল এই পূর্বাঞ্চলে।
এসপি-বিএসপি কি তাহলে চিন্তিত নয়। অবশ্যই তাদের কপালের ভাঁজও গভীরতর হয়েছে। তারাও বুঝতে চাইছে, প্রিয়াঙ্কার প্রবেশ তাদের মূল সমর্থকদের মধ্যে কোপ ফেলবে কি না; বিশেষ করে মুসলমান সমর্থনে। সহজ অঙ্ক, প্রিয়াঙ্কা-রাহুল জুটি উচ্চবর্ণকে উৎসাহিত করলে বিজেপির সর্বনাশ। মুসলমানদের মন জয় করতে পারলে ক্ষয়াটে হবে বুয়া-ভাতিজা দুজনেই। কংগ্রেসের হারানো জমি পুনরুদ্ধারে যুবমানসে আশা জোগালে লোকসান তিন প্রধানেরই। ফলে কেউই দুশ্চিন্তামুক্ত হতে পারছে না।
এমনিতে উত্তর প্রদেশ চার অংশে বিভক্ত। পূর্বাঞ্চল, পশ্চিমাঞ্চল, বুন্দেলখন্ড-রোহিলখন্ড ও মধ্যাঞ্চল। এবার রাজ্যটাকে লম্বালম্বি দুভাগে ভাগ করে পূর্বাঞ্চলের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে প্রিয়াঙ্কাকে। এই অঞ্চলের মধ্যেই চলে আসছে আমেথি, রায়বেরিলি, লক্ষ্ণৌ, ফৈজাবাদ। প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচন ক্ষেত্র বারানসি ও মুখ্যমন্ত্রীর কেন্দ্র গোরক্ষপুরও এখানে। রায়বেরিলিতে মায়ের বদলে প্রিয়াঙ্কা ভোটে দাঁড়াবেন কি না, এখনো নিশ্চিত নয়। কিন্তু দাঁড়ালেও গোটা পূর্বাঞ্চলের ভার যেহেতু তাঁর ওপর, মোদি ও আদিত্যনাথকে তিনি নিশ্চিন্তে থাকতে দেবেন না। ২০১৪ সালের প্রবল মোদি-হাওয়া সত্ত্বেও রাজ্যের যে কেন্দ্রগুলোতে কংগ্রেস লক্ষাধিক ভোট পেয়েছিল, সেগুলো এই পূর্বাঞ্চলেই। বিজেপি অবশ্যই চিন্তিত, কারণ, পাঁচ বছরে হাওয়ায় অনেক পরিবর্তন ঘটে গেছে।
বুধবারেও রাহুল ‘বুয়া-ভাতিজা’ জুটিকে যথাযোগ্য সম্মান দিয়ে কথা বলেছেন। বলেছেন, বিজেপি তাঁদের সবার শত্রু। বিজেপিকে সরাতে তিনি মায়াবতী-অখিলেশকে সাহায্যের হাত সব রকমভাবে বাড়াতে প্রস্তুত। এই মন্তব্য রাজ্যে আসন বণ্টনের ক্ষেত্রে নতুন ভাবনার উদয় ঘটাবে কি না, বলা কঠিন। মায়াবতী-অখিলেশ দুদিন আগে পর্যন্তও রাহুলের কংগ্রেসকে তেমন গুরুত্ব দেননি। কংগ্রেসের ঐতিহ্যগত উচ্চবর্ণ ভোট কখনো যাদবপ্রধান এসপি ও দলিতপ্রধান বিএসপিতে ‘ট্রান্সফার’ হয় না। ফলে তাঁদের ধারণায়, কংগ্রেস আলাদা লড়লে এসপি-বিএসপির লাভ ও বিজেপির ক্ষতির আশঙ্কা বেশি। প্রিয়াঙ্কার অন্তর্ভুক্তি অন্য মেরুকরণের সম্ভাবনা উজ্জ্বল করে তুললে মায়াবতী-অখিলেশ কি রাহুলদের আর গুরুত্বহীন ভাবতে পারবেন?
রাহুলকে সঙ্গে নিয়ে মোদির বিজয়রথ ঠেকানোই সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ হবে কি না, সেই প্রশ্নের উত্তর এখন বুয়া-ভাতিজাকে খুঁজতে হবে। তেমনি প্রিয়াঙ্কার আগমনে বাড়তি উদ্যোগী হতে হবে বিজেপিকে। মোদির মুখ ও মান বাঁচানো অসম্ভব হয়ে উঠবে উত্তর প্রদেশ সমর্থনের হাত উপুড় না করলে।
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি