অজয় রায় আজীবন আপসহীন নীতিনিষ্ঠ একজন দেশপ্রেমিক মানুষ। তিনি মনে–প্রাণে বিশুদ্ধ বাঙালি। গভীরাশ্রয়ী মনন ও চিন্তার অধিকারী এ মানুষটির একটি নিজস্ব ভাবজগৎ আছে। জাতিসত্তা, ভাষা ও সংস্কৃতির প্রশ্নে তিনি শিকড়সন্ধানী মানুষ। একজন আধুনিক ও সংস্কারবাদী মানুষ হিসেবে যুগের পরিবর্তনকে স্বাগত জানালেও তিনি কখনোই ইতিহাসবিমুখ নন। বাঙালির হাজার বছরের শাশ্বত মৌলিক সমাজ–সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে তিনি মনের গহিনে লালন করে আসছেন সারা জীবন। প্রখর স্মরণশক্তির অধিকারী অজয় রায়ের পড়ালেখার সীমানা ও ক্ষেত্র বহুবিস্তৃত-বহুমাত্রিক।
আপাদমস্তক রাজনীতিক, দীর্ঘ বর্ণালি জীবনে বারবার গ্রেপ্তার হয়ে কারানিবাস, কখনো হুলিয়া মাথায় নিয়ে আত্মগোপনে, কখনো প্রকাশ্যে রাজনৈতিক অঙ্গন দাপিয়ে বেড়ানো—এই আমাদের অজয়দা। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, পাকিস্তান আমলে সব গণতান্ত্রিক আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে এবং বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর রাজনৈতিক অঙ্গনে তাঁর ভূমিকা যারপরনাই বলিষ্ঠ। পাশাপাশি আমাদের চিরায়ত সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনেও তাঁর অবদান অনপনেয়।
অজয় রায় ১৯২৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। সেখানে তাঁর মাতামহ মদন দত্ত আইন ব্যবসায় নিয়োজিত ছিলেন। পৈতৃক বাড়ি কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলার বনগ্রামে। চার ভাই ও দুই বোনের মধ্যে অজয় রায় জে্যষ্ঠতম। তাঁর বাবা ড. প্রমথ নাথ রায় ভারতের বারানসি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি ভাষার অধ্যাপক ছিলেন। তাঁর মা কল্যাণী রায় ছিলেন গৃহিণী। ১৯৩৭ সালে ভারতের যুক্ত প্রদেশের বারানসিতে চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি হন এবং অ্যাংলো–বেঙ্গলি ইন্টারমেডিয়েট কলেজ থেকে ১৯৪৩ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন। তিনি বারানসি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইএসসি পাস করেন ১৯৪৫ সালে। বারানসিতে অজয় রায়ের পরিবার যে এলাকায় বসবাস করত, সেটা ছিল কমিউনিস্ট-অধ্যুষিত। আবার কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন বাঙালি। ফলে স্কুলজীবন থেকেই কমিউনিস্ট নেতাদের সংস্পর্শে এসে একজন সক্রিয় কমিউনিস্ট কর্মী হয়ে ওঠেন। আইএসসি পাস করার পর তিনি বারানসি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্মাসি বিভাগে স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৪৪ সালে তাঁর বাবা মৃত্যুবরণ করেন এবং তার এক বছর পরই তাঁর মা মৃত্যুবরণ করলে বাধ্য হয়ে ছোট ভাই–বোনদের নিয়ে চলে আসেন বনগ্রামের পিত্রালয়ে। সেখানে ঠাকুরদা ও ঠাকুরমায়ের তত্ত্বাবধানে ভাইবোনদের লেখাপড়ার ব্যবস্থা করে নিজে মুন্সিগঞ্জের হরগঙ্গা কলেজে বিকম শ্রেণিতে ভর্তি হন ১৯৪৬ সালে। জেলখানা থেকে অর্থনীতিতে এমএ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বনগ্রামে ফিরে এসে কমিউনিস্ট পার্টির কাজে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন।
১৯৪৬ সালে তদানীন্তন বাংলায় যে পৃথক নির্বাচন পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তাতে সংখ্যালঘুদের জন্য সংরক্ষিত আসনে কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা ও ময়মনসিংহের ফুলপুর, ঈশ্বরগঞ্জ ও নান্দাইল থানা নিয়ে গঠিত আসনে কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে কমরেড মণি সিংহ প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। সেই নির্বাচনে অজয় রায় কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ নিয়ে নির্বাচনী প্রচারে অংশগ্রহণ করেন এবং নিজ এলাকা বনগ্রামে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের ছাত্র ফেডারেশনে সংগঠিত করার সফল প্রচেষ্টা চালান। পাশাপাশি
নিজ এলাকায় কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তুলতে নিরলসভাবে কাজ করেন তিনি। ওই সময় তিনি কমিউনিস্ট নেতা নগেন সরকার, ওয়ালী নেওয়াজ খান, মণি সিংহ, খোকা রায় প্রমুখ কমিউনিস্ট নেতার সান্নিধ্যে আসেন।
প্রথম জেলের স্বাদ পান ১৯৪৮ সালে ছাত্রাবস্থাতেই, তখন তিনি মুন্সিগঞ্জ হরগঙ্গা কলেজ থেকে বিএ পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। এরপর নানা সময়ে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক কারারুদ্ধ হয়েছেন। বিভিন্ন পর্যায়ে গ্রেপ্তার হয়ে সর্বমোট জেল খেটেছেন ১৫ বছর। কিন্তু জেলজীবনকেও যে অর্থবহ করা যায়, সৃজনশীলতার শ্রেষ্ঠ স্বাক্ষর রাখা যায়, বিশ্বের কারাসাহিত্যে তার অসংখ্য নিদর্শন রয়েছে; তিনিও তার ব্যতিক্রম নন। অজয় রায় সত্তরের দশকের মাঝামাঝিতে সিপিবির কেন্দ্রীয় সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য হন এবং এই পদে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত ছিলেন।
কমরেড অজয় রায় রাজনীতিতে, গণতান্ত্রিক আন্দোলনে, মুক্তিযুদ্ধে যেমন অবদান রেখেছেন, তেমনি আমাদের সংস্কৃতি ও সাহিত্যের আকাশকেও সাধ্যমতো আলোকময় করে তুলেছেন। রচনা করেছেন বেশ কটি গ্রন্থ; তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো: বাঙলা ও বাঙালী, বাংলাদেশের অর্থনীতি, বাংলাদেশের ভূমিব্যবস্থা, রাজনীতি কি ও কেন?, পুঁজিবাদী অর্থনীতি, বাংলাদেশের কৃষক বিদ্রোহ, গণ-আন্দোলনের নয় বছর, বীরকন্যা প্রীতিলতা, আমাদের জাতীয়তার বিকাশের ধারা, বাংলাদেশের বামপন্থী আন্দোলন ১৯৪৭-৭১, শিক্ষানবিশীর হাতেখড়ি, সাম্প্রতিক তীরের অন্বেষায়। এ ছাড়া তিনি সংবাদপত্রের নিয়মিত কলাম লেখক। ৮৭ বছর বয়সেও তাঁর লেখনী সচল, মস্তিষ্ক প্রবলভাবে সক্রিয়। হিন্দুধর্মমতে তো এ বয়সে বাণপ্রস্থে যাওয়ার কথা। কিন্তু অজয়দা তরুণোচিত তাঁর সক্রিয়তায়।
অজয় রায় রাজনীতি করেছেন বটে, তবে জনপ্রিয় ‘জননেতা’, কৃষক নেতা বা শ্রমিক নেতা হতে পারেননি। হননি বা হওয়া সম্ভব ছিল না পার্লামেন্টের সদস্য—রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারক, আইনপ্রণেতা বা মন্ত্রী। অজয় রায় সারা জীবন যে পার্টি করেছেন, সেই পার্টির সর্বোচ্চ নেতৃত্বের একজন হতে পেরেছিলেন, দলের নীতিনির্ধারক বা তাত্ত্বিক হতে পেরেছিলেন বটে। কিন্তু তিনি সেই পার্টিতেও স্থিত হতে পারেননি ভুবনজোড়া সমাজতন্ত্রের পতনের কার্যকারণে। অজয় রায়ের জীবন কি ব্যর্থ? মোটেই না। বাঙালি জাতিসত্তার স্বরূপ সন্ধানে তাঁর রচিত গবেষণাধর্মী একাধিক গ্রন্থ ইতিমধ্যে তাঁকে এ বিষয়ে একজন অথরিটি হিসেবে অভিষিক্ত করেছে।
অজয় রায় এ দেশের মুক্তিকামী শোষিত মানুষের আদর্শের বাতিঘর। পরিমিতিবোধসম্পন্ন, নীতিনিষ্ঠ ও প্রাজ্ঞ ব্যক্তিত্ব অজয় রায়। তিনি শিক্ষানুরাগী, বিনয়ী ও মানবিক গুণাবলির অধিকারী। তাঁর পরিশ্রম আর একনিষ্ঠতা দেখে মনে হয়, অজয়দা এখনো তরুণ।
আজ তাঁর ৮৭তম জন্মদিন। জয়তু অজয়দা!
রোবায়েত ফেরদৌস: সহযোগী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
robaet.ferdous@gmail.com