অজয় রায়ের আকাঙ্ক্ষা ও বাংলাদেশ

অজয় রায়: জন্ম ৩০ ডিসেম্বর ১৯২৮; মৃত্যু ১৭ অক্টোবর ২০১৬
অজয় রায়: জন্ম ৩০ ডিসেম্বর ১৯২৮; মৃত্যু ১৭ অক্টোবর ২০১৬

অজয় রায় সারা জীবন সাধনা করেছেন গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক, বৈষম্যমুক্ত আর মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন রাষ্ট্র ও সমাজ নির্মাণের। পুঁজিবাদী সমাজের লুণ্ঠন আর নিষ্ঠুরতার বিপরীতে তিনি সাম্য ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ তৈরির জন্য লড়াই করেছেন। তাঁর সমাজ ও রাষ্ট্রচিন্তার মৌল ভিত্তি ছিল মুক্তিযুদ্ধের চার মৌলনীতি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। কিন্তু বর্তমান বাংলাদেশে যখন সর্বগ্রাসী দুর্নীতি, অপশাসন, জঙ্গিবাদ আর সাম্প্রদায়িক হানাহানি দেখি, তখন বুঝি, অজয়দা এই বাংলাদেশ চাননি। গণতন্ত্র এখনো সবল হতে পারেনি। সংসদ ব্যবসায়ী-আমলাদের দখলে। সবার কাছে গ্রহণযোগ্য আর অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন এখন শিকেয় উঠেছে। নির্বাচন কমিশন প্রশ্নবিদ্ধ। নতুন নেতৃত্ব তৈরির পথ রুদ্ধ। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয় না। নির্বাচনে মনোনয়ন-বাণিজ্য চলে দেদার। হুন্ডা, গুন্ডা, কালোটাকার খেলা থেকে নির্বাচনী ব্যবস্থা বেরিয়ে আসতে পারেনি। রাজনৈতিক দলের ভেতরে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের চর্চা নেই। সমাজে গণতন্ত্রের অন্যতম নিদান দ্বিমত-ভিন্নমত আর পরমতসহিষ্ণুতা নেই বললেই চলে।
রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ হয়নি, তৃণমূলে গণতন্ত্রের চর্চা ও বিকাশ নেই। জনগণের রাজনীতি সমাজ ও রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠা পায়নি। রাজনীতি যেন দাবার কূটচাল, কেবলই কথার প্রতিশ্রুতি—সিংহাসনের হাতলে হাত রাখলে যা উবে যায় কর্পূরের মতো। নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, তথ্য অধিকার কমিশন কোনোটাই শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়াতে পারেনি। অর্থাৎ আমরা রাষ্ট্র ও সমাজে কোনো প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করতে পারিনি। আইন ও বিচারের অধিকার থেকে গরিব, প্রান্তিক মানুষেরা বঞ্চিত—এসব দেখে অজয়দা আমৃত্যু কষ্ট পেয়েছেন।
সারা দেশে আমরা রাষ্ট্রের সাম্প্রদায়িক চরিত্রই লক্ষ করছি। শাসক দল আওয়ামী লীগের ভেতরে সাম্প্রদায়িকীকরণ ও জামায়াতীকরণ ঘটছে। সাম্প্রদায়িকতায় বিএনপি আকণ্ঠ নিমজ্জিত, আর আওয়ামী লীগ? আবক্ষ—পার্থক্য কেবল এই। বিভিন্ন স্থানে জামায়াতের বহু নেতা-কর্মীর আওয়ামী লীগে আত্তীকরণ হচ্ছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে ঐতিহ্যগত ফারাক ছিল, তা ক্রমেই কমে আসছে। আওয়ামী লীগের জন্ম গণমানুষের মধ্য থেকে। তারা গণমানুষের অধিকার আদায়ে লড়াই করেছে, অসাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে, কিন্তু এখন সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গে আপস করছে। মৌলবাদী অর্থনীতিতেও আওয়ামী লীগ জড়িয়ে পড়েছে। আওয়ামী লীগ পাকিস্তান আমলে সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিরুদ্ধে সাহস নিয়ে দাঁড়াতে পারলেও এখন পারছে না। তখন মানুষ এসে পাশে দাঁড়াত। এখন অনেককে পাওয়া যায় না। বামপন্থীরাও এখন চিন্তার দিক থেকে প্রান্তিক। জনগণ এগিয়ে গেলেও বামপন্থীরা পুরোনো ধ্যানধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে পারছেন না। জাতিগত আর সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়ন চলছে বিভিন্ন স্থানে। তবে কি মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে? মুক্তিযুদ্ধের অর্জন ও চেতনা অনেকটাই ভূলুণ্ঠিত?
প্রশাসন থেকে বলা হয়, সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের অনুভূতিকে সম্মান দিতে হবে। কিন্তু সংখ্যালঘুদের কি অনুভূতি নেই? প্রশাসন গ্রামে গ্রামে মেলা বন্ধ করে দিয়েছে, এমনকি পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠানও বিকেল পাঁচটার মধ্যে শেষ করতে বলছে। এতে মেলাবিরোধী মৌলবাদী গোষ্ঠীই আশকারা পাচ্ছে। যেখানে সব ধর্মের মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, সেখানে ২০১১ সালের আদমশুমারিতে দেখা যাচ্ছে, হিন্দু জনসংখ্যা ১০ লাখ কমেছে; নিজভূমির মায়া ত্যাগ করে তারা ভারতসহ বিভিন্ন দেশে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। এটা হয়েছে ‘জবরদস্তিমূলক অভিগমন’-এর কারণে। বিগত কয়েক বছরে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ, হামলা-মামলা, তাদের জায়গা-জমি দখল যেন জ্যামিতিক হারে বাড়ছে। রামুতে বৌদ্ধমন্দির জ্বালিয়ে দেওয়া, পাবনার সাঁথিয়ায় হিন্দুদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও বসতবাড়িতে হামলা, দিনাজপুরের কান্তজিও মন্দির উচ্ছেদের চেষ্টা, চিরিরবন্দরে হিন্দু উপাসনালয়ে আক্রমণ, শ্রীশ্রী অনুকূল ঠাকুরের আশ্রমের দুজন সেবায়েতকে হত্যা—তালিকা দীর্ঘ—এ রকম বহু নজির আমাদের স্মৃতিতে এখনো জ্বলজ্বলে। রামমন্দির-বাবরি মসজিদ দাঙ্গার কথা আমরা জানি, দাঙ্গার ধাক্কা বাংলাদেশেও লেগেছিল—বহুসংখ্যক হিন্দু মানুষ তখন দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছিলেন। ২০০১-এর নির্বাচনে বিএনপি জেতার পর দেশের হিন্দু নারী-পুরুষের ওপর যে সাম্প্রদায়িক নিপীড়ন নেমে এসেছিল, তা নিশ্চয়ই কেউ ভোলেনি।
সত্য বটে, প্রবৃদ্ধি বাড়ছে, সমান্তরালে চাপাতির কোপও বাড়ছে, এটাও সমান সত্য। জীবনের নিরাপত্তা যদি না থাকে, কী করব এই প্রবৃদ্ধি-জিএনপি-জিডিপি দিয়ে? কী লাভ পার-ক্যাপিটা-ইনকামের হিসাব কষে? আমরা যে ধর্মাবলম্বীই হই না কেন, প্রতিক্রিয়াশীলের চাপাতির কোপের রেঞ্জের বাইরে আমরা কেউই নই। টার্গেট যেন সবাই! সবার নামেই মৃত্যুপরোয়ানা জারি করা আছে; অপেক্ষা কেবল কার্যকরের! এ যেন ‘জন্ম মানেই আজন্ম মৃত্যুদণ্ড বয়ে বেড়ানো’।
একদিকে শাহবাগের গণজাগরণ, অন্যদিকে শাপলা চত্বরে হেফাজতের সমাবেশ—দুই জায়গাতেই লাখো তরুণের সমাবেশ ঘটেছিল। শাহবাগের গণজাগরণ যদি হয় ‘থিসিস’, তবে শাপলা চত্বরে হেফাজতের সমাবেশ হচ্ছে ‘অ্যান্টিথিসিস’—পরস্পরবিরোধী দুটি শক্তিই বাংলাদেশের সমাজে বিরাজমান। এই দুটি শক্তিকে কীভাবে ‘সিনথেসাইজ’ করা যায়, অজয় রায় আমাদের সেই শিক্ষাই দিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু আমরা তা কতটা আত্মস্থ করতে পেরেছি? মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আজ ভূলুণ্ঠিত। বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও সমাজে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র এখন পরিত্যক্ত। জাতীয়তাবাদের নতুন ব্যাখ্যা দেওয়া হয় বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের প্রবর্তনে—যেখানে বাঙালি মুসলমানের জাতীয়তাবাদকেই বোঝানো হয়েছে—যেখানে অবাঙালি কিংবা অমুসলিম কারও স্থান নেই। রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার এখন প্রবল। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীরাও রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হয়েছে কয়েকবার। সামরিক শাসনের কবলেও পড়তে হয়েছে রাষ্ট্রকে একাধিকবার। সংবিধানে ইসলামকে করা হয়েছে রাষ্ট্রধর্ম। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে রাষ্ট্রধর্মকে উচ্ছেদ করতে পারেনি, হয়তো চায়ওনি।
অজয় রায় গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক, বৈষম্যমুক্ত আর মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন রাষ্ট্র ও সমাজ নির্মাণের যে চেষ্টা করেছেন, তা কি ব্যর্থ হয়েছে? তবে কি তাঁর সারা জীবনের আত্মত্যাগ বৃথা গেছে? সেটা বোধ হয় বলা যাবে না। কারণ, শ্রীমদ্ভগবতগীতা বলছে, ‘ন হন্যতে হন্যমানে শরীর’—শরীরের পতন আছে, দেহের মৃত্যু আছে কিন্তু মানুষের যে চেতনা, তার মৃত্যু নেই। কারণ, আপাত পেছনে হাঁটলেও, বাংলাদেশের মুক্তি ওই চেতনার বাস্তবায়নেই, যে চেতনা মুক্তিযুদ্ধের, যে স্পিরিট অজয়দার চিন্তা ও মননে সারা জীবন জাগরূক ছিল।
বাংলাদেশ ও বাকি বিশ্বের বাস্তব পরিস্থিতিতে তার কিছু রূপান্তর ঘটতে পারে কিন্তু মূল ধারণাগুলোকে অবিকৃতভাবেই আমাদের গ্রহণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, মুক্তিযুদ্ধই আমাদের মূল বাতিঘর, আসল ঠিকানা, সেখানেই আমাদের ফিরতে হবে।
জন্মদিনে আজ অজয় রায়ের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।
রোবায়েত ফেরদৌস: সহযোগী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
robaet.ferdous@gmail.com