শেখ হাসিনার দেশ ছাড়ার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর রাজধানীতে মানুষের উল্লাস
শেখ হাসিনার দেশ ছাড়ার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর রাজধানীতে মানুষের উল্লাস

মতামত

গণঅভ্যুত্থান-উত্তর অনিশ্চয়তা দ্রুত কাটাতে হবে


একজন স্বৈরশাসকের পতনের পর রাষ্ট্রব্যবস্থা ও সমাজে যে ধরনের পরিবর্তন আশা করা হয়, তা তাৎক্ষণিকভাবে শতভাগ কার্যকর হবে, এমনটা ঘটে না। পরিবর্তনগুলো যদি পরিকল্পিত হয়, তাহলে তার বাস্তবায়ন সহজ হয় এবং দ্রুতই সেগুলো দৃশ্যমান হয়। কিন্তু সে রকম কোনো পরিকল্পনা না থাকার যে সমস্যা, সেটা এখন প্রকটভাবে অনুভূত হতে শুরু করেছে।

৫ আগস্ট শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রীর পদ ত্যাগ করে দেশ ছেড়ে যাওয়ার কথা ঘোষণা করার সময় সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেছিলেন, ‘একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হবে। এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীন দেশের সব কার্যক্রম চলবে।’

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের প্রক্রিয়া কতটা জোরেশোরে হচ্ছে, তা বলা মুশকিল। রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক বিভিন্ন গোষ্ঠীর সঙ্গে আলোচনা ও সমঝোতায় পৌঁছানো কিছুটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আন্দোলনে রাজনৈতিক নেতৃত্বের অভাব এর অন্যতম কারণ। সে জন্য ধৈর্য ধারণের কথাও হয়তো বলা যায়। কিন্তু রাষ্ট্রের অন্য যেসব প্রশাসনিক অঙ্গ, সেগুলোর কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়া অথবা তাদের নিষ্ক্রিয়তা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এ ধরনের নিষ্ক্রিয়তা যে জনজীবনে নৈরাজ্য ছড়াতে পারে, তার আলামত কিন্তু উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে।

সরকারি স্থাপনায় হামলা, রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস করা, নাগরিকদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তায় আঘাত করা, সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর সহিংস প্রতিশোধের ঘটনাগুলো খুবই উদ্বেগজনক এবং নিন্দনীয়। এগুলো বন্ধে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা অনেক প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো সুরক্ষায় এসব বাহিনীর যে ভূমিকা রাখার কথা, তা আকস্মিক ভেঙে পড়া মোটেও স্বাভাবিক নয়।

আন্দোলনকারীদের দাবির মুখে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে যাওয়ার পর গণভবনে বিক্ষুব্ধ মানুষের ঢুকে পড়া ও লুটপাটের যেসব ঘটনা ঘটেছে, তা দুঃখজনক। তবে তার চেয়েও বিপজ্জনক হলো প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় তছনছের ঘটনা।

এসব স্থাপনায় বাসিন্দা বদল হবে ঠিকই, কিন্তু স্থাপনাটি অক্ষত রাখা রাষ্ট্রের জন্য অপরিহার্য ছিল। যাঁরা এগুলোর নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্বে ছিলেন, তাঁরা কীভাবে তাঁদের অবস্থান ছেড়ে চলে গেলেন? তাঁদের তদারকির দায়িত্বে যেসব ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, পদস্থ আমলা, তাঁরাই–বা কোথায় ছিলেন? বিকল্প ব্যবস্থা কেন তাঁরা নিতে পারলেন না? নাকি নিলেন না?

পুলিশের সদর দপ্তরের ক্ষেত্রে বিষয়টি বিশেষভাবে প্রযোজ্য। পুলিশ কেন তাদের সদর দপ্তরকে রক্ষা করতে পারেনি? এর কারণ কি ক্ষমতাচ্যুত রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের প্রতি পুলিশের আনুগত্য? আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা যেভাবে এখন পালিয়ে আত্মরক্ষা করছেন, পুলিশের একটা বড় অংশ কি একই কারণে সেই পথ অনুসরণ করছে? নাকি নতুন অন্তর্বর্তী প্রশাসনকে সহযোগিতা না করার কোনো সংঘবদ্ধ চেষ্টা চলছে?

গত ১০ বছরের দুটি বড় অভিযোগের কথা এখানে স্মরণ করা প্রয়োজন। একটি হচ্ছে, দলীয় রাজনৈতিক আনুগত্যই ছিল নিয়োগ ও পদোন্নতির প্রধান শর্ত; আর অন্যটি হচ্ছে, দুর্নীতির বিনিময়ে চাকরি দেওয়া। প্রথম শর্ত পূরণ না হলে টাকাপয়সার লেনদেনেও কাজ-পদোন্নতি জুটত না। ধারণা করা হয়, এই দলীয় আনুগত্যের কারণেই সরকারবিরোধীদের দমনে পুলিশ বেপরোয়া আচরণ করেছে। দলীয় অস্ত্রধারী নেতা-কর্মীদের সঙ্গে মিলেমিশে বিরোধীদের ওপর চড়াও হয়েছে।

আন্দোলন দমনে পুলিশ যতই নিষ্ঠুর আচরণ করেছে, ততই তারা বিক্ষোভকারীদের ক্রোধের কারণ হয়েছে এবং তার পরিণতিতেই দেখা যাচ্ছে পুলিশের বিরুদ্ধে আক্রোশ এবং প্রতিশোধ নেওয়ার প্রবণতা। পুলিশের যেসব স্থাপনার ওপর হামলা হয়েছে, সেগুলো সমর্থনযোগ্য নয়। কিন্তু এই বিপর্যয় পুলিশ নিজেরাই ডেকে এনেছে।

আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাও এখন একই রকম প্রতিশোধমূলক আক্রোশের শিকার হচ্ছেন, যাতে অনেক ক্ষেত্রেই চরম নিষ্ঠুরতার বহিঃপ্রকাশ ঘটছে। এগুলো মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন এবং অবশ্যই থামানো প্রয়োজন। ক্ষমতায় থাকার সময়ে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা বিরোধী দলের কর্মী-সমর্থকদের যে নিগৃহীত করেছেন, তা–ও যেমন নিন্দনীয়, তেমনি নিন্দনীয় প্রতিশোধের রাজনীতিও। এসব হামলা অবিলম্বে বন্ধ করতে বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দলকে উদ্যোগী হতে হবে।

সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যদের ওপর যেসব হামলা ও হুমকির অভিযোগ উঠেছে, তা–ও গভীর উদ্বেগের বিষয়। ২০০১ সালে নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের সময়েও এমন ঘটনা ঘটেছিল, যার দায় বিএনপিকে এখনো বহন করতে হচ্ছে। সে সময়েও নির্বাচনে বিজয়ী দল সরকার গঠনের আগেই এসব আক্রমণের ঘটনা ঘটেছিল এবং প্রশাসন প্রায় নিষ্ক্রিয় দর্শকের ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে খুব একটা সক্রিয় উদ্যোগ নেয়নি। নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার পালাবদলের অন্তর্বর্তী সময়ের প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তার মতো দর্শকের ভূমিকা বর্তমান সময়েও কাম্য নয়।

সরকার গঠনের অনিশ্চয়তা যত প্রলম্বিত হবে, এ রকম প্রশাসনিক স্থবিরতা ততই জনজীবনকে স্থবির করে ফেলবে, অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং নিরাপত্তাহীনতা বাড়বে। রাজনৈতিক নেতাদের তাই উচিত হবে তাদের সলাপরামর্শ বা দর-কষাকষি আরও নিবিড়ভাবে সম্পন্ন করে দ্রুত একটি সমঝোতা চূড়ান্ত করা।

এই সমঝোতা শুধু অন্তর্বর্তী সরকারে কে থাকবেন আর কে থাকবেন না, তা নিয়ে নয়, একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন এবং স্বৈরতান্ত্রিক অপশাসনের অন্যায়গুলো অবসানের অগ্রাধিকার নির্ধারণের প্রশ্নেও হতে হবে। প্রশাসন, পুলিশ ও বিচার বিভাগকে দলীয় আনুগত্যমুক্ত করা, গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোর ইতি টানা এবং তদন্তের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া এবং অর্থনৈতিক অপরাধ ও দুর্নীতির অভিযোগগুলোর বিচারের প্রশ্নগুলোও সংলাপ ও সমঝোতার অংশ হতে হবে।

শ্রীলঙ্কার গণ-অভ্যুত্থানের আলোচনা এর আগে অনেকেই তুলেছেন। শেখ হাসিনাও তার দৃষ্টান্ত টেনে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ করেছিলেন। কিন্তু শ্রীলঙ্কার ঘটনা থেকে আমাদের রাজনীতিকেরা বা আমরা যে খুব একটা শিক্ষা নিয়েছি, তা মনে হয় না। শ্রীলঙ্কায় রাজাপক্ষে ভ্রাতৃদ্বয় ক্ষমতাচ্যুত হলেও মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ অপশাসনের অন্যান্য অভিযোগের কোনো বিচার হয়নি এবং তাঁরা অল্প কয়েক মাসের মধ্যেই স্বদেশে ফিরে এসেছেন এবং রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তনের পরিকল্পনা করছেন ও প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

  • কামাল আহমেদ সাংবাদিক