প্রথম আলোর অনলাইন সংস্করণে গত ২৬ মার্চ প্রকাশ করা একটি গ্রাফিক কার্ড নিয়ে সৃষ্ট বড় ধরনের বিতর্কের ফলস্বরূপ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে (ডিএসএ) সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদক ও পত্রিকাটির সম্পাদকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ও সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদককে পাঁচ দিন কারারুদ্ধ অবস্থায় থাকতে হয়েছে। এ ছাড়া পত্রিকাটি ‘দেশের স্বাধীনতাকে ব্যঙ্গ করে’ একটি শুভ দিবসের উদ্যাপন ও সরকারের অর্জনকে ক্ষুণ্ন করার চেষ্টা করেছে—এমন অভিযোগে দৈনিকটির বিরুদ্ধে সমালোচনা ও নিন্দার ঝড় বয়ে গেছে।
প্রথম আলো তাৎক্ষণিকভাবে বিষয়টি পরিষ্কার করে সংশোধনী দেওয়ার পরও প্রতিবাদকারীরা তাঁদের প্রথম আলো বিরোধী অবস্থানে অনড় ছিল। তাঁরা প্রথমে স্বাধীনতা অবমাননার কথা বললেও অচিরেই তাঁরা এ ভাষ্য প্রচার করতে থাকে যে, ‘এটি একটি ঘৃণ্য শিশু নিগ্রহ’ ছিল।
বলা বাহুল্য, গ্রাফিক কার্ডে ব্যবহৃত উদ্ধৃতিটিকে কোনোভাবেই শিশুটির উদ্ধৃতি হিসেবে পরিবেশন করা হয়নি এবং প্রতিবাদের নামে চলা এই প্রহসন ও এক সুরে এই শোরগোল তোলাকে যুক্তিহীন বিভ্রান্তিকর ভাষ্য তৈরির ক্ল্যাসিক ঘটনা বলে মনে হচ্ছে। এই গ্রাফিক কার্ডের ঘটনা সামাজিক ও রাজনৈতিক মহলে এবং সংবাদমাধ্যমে তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি করেছে।
স্বাধীনতার চেতনা এবং দেশের ভাবমূর্তিকে নিজেদের মতো করে ব্যাখ্যা করা সরকারপন্থী ভাষ্যকারেরা রাষ্ট্রপক্ষের এ সংক্রান্ত প্রতিক্রিয়ায় অনেকাংশেই সহমত দেখাচ্ছে। তবে সরকারের অনুগত এই বুদ্ধিজীবী বলয়ের বাইরে থাকা অন্যরা মনে করেন, প্রথম আলোর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের নেওয়া পদক্ষেপগুলো গণতান্ত্রিক শৃঙ্খলার পরিপন্থী এবং গণমাধ্যম ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার একটি অংশকে ছেঁটে দেওয়ার শামিল।
বিশ্লেষকদের এই অংশটি মনে করে, পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বী দৃষ্টিভঙ্গিকে ঠিকভাবে উপস্থাপন করার লক্ষ্যে জনগণ ও গণমাধ্যমকে প্রভাবিত করা বিষয় নিয়ে আলোচনা করা ও বিতর্ক তোলায় উৎসাহ দেওয়ার মধ্যেই প্রকৃত স্বাধীনতার চেতনা নিহিত থাকে।
এই গ্রুপটি মনে করে, (একটি নির্দিষ্ট ভাষ্যের প্রচার চালিয়ে) পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা ধারণ করার বদলে রাষ্ট্রের উচিত নাগরিকদের (গণমাধ্যম ও বাক স্বাধীনতাসহ) অধিকার পুরোপুরি ভোগ করতে দেওয়াটা নিশ্চিত করা যেটি কিনা প্রজাতন্ত্রের সংবিধান সংরক্ষণ করে থাকে।
সরকারপন্থী ও তাদের বাইরে থাকা এই গ্রুপ দুটির মধ্যে ভেতরে-ভেতরে যে চিড় বা ফাটল ছিল প্রথম আলোর এই ঘটনা সেটিকে সামনে নিয়ে এসেছে।
প্রথম আলোর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার পর বাক্স্বাধীনতা প্রশ্নে সরকার যখন আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পড়ে, তখন তড়িঘড়ি করে শিশু শোষণের বিষয়টিকে অভিযোগের কেন্দ্রস্থলে নিয়ে আসা হয়। শাসক দলের সাধারণ সম্পাদক ও মন্ত্রিসভার একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য এ বিষয়ে বলেছেন, ‘অনেকে বলেছেন, এটা তাদের একটা ভুল। আমি তাদের উদ্দেশে বলতে চাই, স্বাধীনতা দিবসের দিনে বাঙালি জাতির ৫২ বছরের অর্জন মর্যাদা নিয়ে তামাশা করা সাধারণ ভুল নয়। একটি ফৌজদারি অপরাধ।’ তিনি বলেছেন, ‘যে কোনো উন্নত গণতন্ত্রের দেশে এই ধরনের শিশু শোষণের ঘটনা ঘটলে সেই মিডিয়ার লাইসেন্স বাতিল করা হতো’।
তথ্যমন্ত্রী দাবি করেছেন, প্রথম আলোর প্রতিবেদনটি জাতিসংঘের শিশু অধিকার সংস্থা ইউনাইটেড নেশনস কনভেনশন অন দ্য রাইটস অব দ্য চাইল্ড (ইউএনসিআরসি)-এর সনদ লঙ্ঘন করেছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গত ১ এপ্রিল ইস্যু করা একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সৃষ্ট সংকটের ওপর প্রতিবেদন করার জন্য প্রতিবেদককে গ্রেপ্তারির কথা প্রত্যাখ্যান করেছে। বিবৃতিতে দাবি করা হয়, ‘শিশুকে ব্যবহার ও শোষণ করার’ এবং ‘মহান স্বাধীনতা দিবসে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে খর্ব করার চেষ্টা করার’ জন্য ওই প্রতিবেদককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে জোর দিয়ে বলা হয়, ‘এই কাজগুলো নিশ্চিতভাবেই শাস্তিযোগ্য অপরাধের শামিল’ এবং সেখানে সবাইকে এ কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়, ‘এই ধরনের প্রতারণামূলক কাজ করে সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি করা সৎ সাংবাদিকতার চেতনার পরিপন্থী’।
বিবৃতিতে বলা হয়, ইউএনসিআরসি-তে সাক্ষরকারী একটি পক্ষ হিসাবে সরকার শিশু শোষণের মতো কোনো কাজ বরদাশত করবে না। তবে সরকার শিশু শোষণের যে অভিযোগ তুলেছে তার ভিত্তিকে অত্যন্ত দুর্বল বলে মনে হচ্ছে। রমনা থানায় প্রতিবেদক শামসুজ্জামান শাসসের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫ (২), ৩১ এবং ৩৫ ধারায় একটি মামলা হয়। উল্লেখিত তিনটি ধারার সঙ্গে ডিএসএর ২৬(২) ও ২৯ নম্বর ধারা যোগ করে তাঁর বিরুদ্ধে তেজগাঁও থানায় আরেকটি মামলা হয়। খুবই কৌতূহলোদ্দীপক বিষয়, এই পাঁচটি ধারার কোনোটির সঙ্গেই শিশু নির্যাতন বা শিশুকে ব্যবহার করার সম্পর্ক নেই।
শুধু তাই নয়, রমনা থানায় দায়ের করা এফআইআর-এ শামস, সম্পাদক মতিউর রহমান এবং অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের চেষ্টায় প্রিন্ট, অনলাইন ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া ব্যবহারের অভিযোগ আনা হলেও সেখানেও কোনো ধরনের শিশু নিগ্রহের কিংবা শিশুকে কোনো শোষণমূলক কাজে ব্যবহার করার কথা বলা হয়নি।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহলের ক্রমবর্ধমান উদ্বেগ ও সমালোচনা এড়াতে মন্ত্রীরা, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের কর্মকর্তারা অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে তাড়াহুড়ো করে চাপানো অভিযোগ আমলে নিতে ব্যর্থ হয়েছেন। তাঁরা শিশু শোষণ ও শিশুকে ব্যবহার করার সংশোধিত অভিযোগকেও সবার কাছে বিশ্বাসযোগ্য হিসেবে দাঁড় করাতে ব্যর্থ হয়েছেন।
একটি স্বনামধন্য জাতীয় দৈনিকের অনিচ্ছাকৃত প্রযুক্তিগত ত্রুটিকে ধরে রাষ্ট্রের ডিএসএ-র আশ্রয় নেওয়ার ঘটনা আজকের বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং সংবাদমাধ্যমের সীমাবদ্ধতাকেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে।
রাষ্ট্র এবং শাসক দলের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের বক্তৃতা এবং তাদের অনুগত বুদ্ধিজীবী ও সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীগুলোর বিবৃতি কেবলই স্বার্থান্বেষী মহলের ষড়যন্ত্রকে সামনে আনে যা তাঁদের সম্ভাব্য জনবিচ্ছিন্নতার বোধকে সবার সামনে প্রকাশ করে দেয়।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহলের ক্রমবর্ধমান উদ্বেগ ও সমালোচনা এড়াতে মন্ত্রীরা, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের কর্মকর্তারা অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে তাড়াহুড়ো করে চাপানো অভিযোগ আমলে নিতে ব্যর্থ হয়েছেন। তাঁরা শিশু শোষণ ও শিশুকে ব্যবহার করার সংশোধিত অভিযোগকেও সবার কাছে বিশ্বাসযোগ্য হিসেবে দাঁড় করাতে ব্যর্থ হয়েছেন।
এই অবস্থায় যে কারও মনে হতে পারে, প্রথম আলোর এই গ্রাফিক কার্ড ইস্যুকে অস্ত্র বানিয়ে রাষ্ট্রের ইউএনসিআরসিকে মহিমান্বিত করার চেষ্টা শেষ পর্যন্ত হালে পানি পাবে না। কিন্তু এই হাতিয়ারের মাধ্যমে শাসকগোষ্ঠী এই বার্তা দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছে যে, শুধু প্রথম আলো নয়, বরং সরকারের সমালোচক সব সংবাদমাধ্যম ও চিন্তকদের মধ্যে যারা রাষ্ট্রের কর্তৃত্বকারীদের আদেশের বাইরে গিয়ে প্রজাতন্ত্রের সাংবিধানিক অধিকার চর্চা করতে যাবে তাদের বিরুদ্ধে তারা অধিকতর কঠোর ডিএসএ প্রয়োগ করতে মোটেও পিছ পা হবে না। বিষয়টি যদি তাই হয়ে থাকে তবে তা খুবই দুঃখজনক।
ড. সি আর আবরার শিক্ষাবিদ ও মানবাধিকার সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আগ্রহী।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
ডেইলি স্টার–এর সৌজন্যে