সংঘাতময় বছর অনিশ্চয়তার পথে

অলংকরণ: খলিল রহমান
অলংকরণ: খলিল রহমান

২০২২ শুরু হয়েছিল কোভিডের আতঙ্ক থেকে মুক্তির বার্তা দিয়ে। শেষ হয়েছে ফুটবল বিশ্বকাপের উত্তাপ ছড়িয়ে। এর মধে৵ বছরটি নানা ঘটনা-দুর্ঘটনায় কাটলেও রাজনীতি বরাবরই ছিল সংবাদ শিরোনাম। অনেকটা স্পাই থ্রিলারের মতোই সাসপেন্স, অ্যাকশন আর ভায়োলেন্সে বয়ে গেছে রাজনীতির স্রোতোধারা। এই স্রোত কখনো ঝিমিয়ে পড়েছে, আবার কখনো বা উত্তাপ-উত্তেজনায় চারদিক সয়লাব করে দিয়েছে। 

ভারতে ব্রিটিশ সরকার অনেক ভালো-মন্দ কাজ করেছে। তার মধ্যে একটি ছিল নির্বাচন দেওয়া। এ অঞ্চলের প্রথম সংবিধান হলো ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন। এ আইনের অধীনে সাধারণ নির্বাচন হয়েছে ১৯৩৭ সাল থেকে। এরপর আমরা দুবার স্বাধীন হলাম। ১৯৪৭ সালে প্রথমবার স্বাধীন হয়ে পেয়েছিলাম পরপর দুটি সংবিধান। সেগুলো টেকসই হয়নি। এমনকি পাকিস্তান নামের দেশটিও পুরোপুরি টেকেনি। এরপর বাংলাদেশ হলো ১৯৭১ সালে। ১৯৭২ সালেই স্বল্পতম সময়ে আমরা পেয়ে যাই একটা সংবিধান। সেটি এখনো জারি আছে। তবে এর কাটাছেঁড়া হয়েছে বিস্তর। 

বাঙালি রাজনীতি-অন্তঃপ্রাণ জাতি। সংবিধানের প্রতি তার একধরনের মোহ কিংবা ভালোবাসা আছে। আমরা বড় গলায় বলি—‘পবিত্র সংবিধান’। ইতিমধ্যে দেশে আড়াইবার সামরিক শাসন এসেছে। কিন্তু সংবিধান বাতিল হয়নি। তবে এটি শাসকদের জন্য নানা সময় নানা ধরনের ঝামেলা তৈরি করেছে। তাদের মৌরুসিপাট্টায় হাত দিয়েছে। তখন এর ডালপালা ছেঁটে ফেলা হয়েছে, গত ৫১ বছরে মোট ১৭ বার। স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি আর দূরদৃষ্টি থাকলে এমন হওয়ার কথা নয়। এত ঘন ঘন সংবিধানের ঘষামাজার নজির অন্য কোনো দেশে আছে কি না, জানি না। 

সামরিক সরকার উর্দি ছেড়ে সিভিল পোশাক পরার জন্য সংবিধান বদলেছে দুবার। বাকি ১৫ বার সংবিধান ‘আহত’ হয়েছে অসামরিক জমানায়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। শেষবার সংবিধানে হাত পড়েছিল ২০১৬ সালে। সে সময় সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা তুলে দেওয়া হয়। এরপর থেকে তৈরি হয়েছে একধরনের অস্থিরতা। এ নিয়েই এ দেশের রাজনীতি এখন ঘুরপাক খাচ্ছে। ২০২২ সালে এসে তার একটা ঝাঁকুনি অনুভব করা গেছে। 

দেশটা গত পাঁচ দশকে অনেক এগিয়েছে। আরও এগোতে পারত। এটা আমরা বুঝি চীন, দক্ষিণ কোরিয়া ও ভিয়েতনামের দিকে তাকিয়ে। আমরা অল্প কিছু পেলেই খুশিতে বাকবাক করি। ভাবি, কেল্লা ফতে হয়ে গেছে। অথচ আমাদের আরও ভালো করার সক্ষমতা আছে। কিন্তু
আমরা পেরে উঠছি না। আমাদের রাজনীতিটা অগ্রগতির সহায়ক না হয়ে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। পেছন দিকে টানছে। 

দেশে নানা সমস্যা আছে। পুঁজি গঠন ও বিনিয়োগের সমস্যা, অবকাঠামোর অপর্যাপ্ততা, বৈশ্বিক মন্দা, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত ইত্যাদি সামাল দিতে পারে রাজনীতি, যদি তার লাগাম থাকে দায়িত্বশীল লোকেদের হাতে। দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, আমাদের রাজনীতিবিদদের স্কোরকার্ড সে রকম বলে না। তাদের সব প্রশংসা কেবল পাবলিকের টাকায় ছাপা হওয়া সংবাদপত্রের ক্রোড়পত্রে। 

বছরজুড়ে আমরা দেখেছি রাজনীতির ঘুড়ি ওড়ানোর মচ্ছব, যেখানে নাটাইটা গুটিকয়েক গোষ্ঠীর হাতে। তারা মাঞ্জা দিয়ে মাঠে নেমেছে। শূন্যে লড়াই করছে। একে অপরের ঘুড়ির ওপরে চড়াও হচ্ছে। কে কার সুতা কাটবে, এ নিয়ে চলছে নানা আয়োজন, ফন্দিফিকির। শৈশবে চৈত্রসংক্রান্তির মেলায় ঘুড়ি কাটাকাটির প্রতিযোগিতা দেখেছি। তখন পেয়েছি আনন্দ। এখন চলছে মহাসংক্রান্তি। নাগরিকেরা এখানে দর্শক। তাঁরা আতঙ্কে আছেন, কখন কার মাঞ্জা দেওয়া সুতায় গলা কাটা পড়ে। 

এ দেশে রাজনীতিবিদদের একটাই ধর্ম—জোর যার মুল্লুক তার। মানসিকতা হচ্ছে উৎকট দখলদারির। এটাকে জায়েজ করার জন্য মুখিয়ে থাকেন কিছু মানুষ। তাঁরা ভাড়ায় খাটেন, বন্দনাগীত লেখেন, প্রতিপক্ষের গিবত গেয়ে বেড়ান। গণমাধ্যমে ও সাহিত্যে তার প্রতিফলন দেখা যায়। 

দখলদারির মানসিকতা থেকেই ব্যক্তি ও গোষ্ঠীগত প্রয়োজনে সংবিধান বারবার কাটাছেঁড়া করা হয়েছে। ফলে তৈরি হয়েছে এক দীর্ঘস্থায়ী সংকট। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে নিয়ে আসা হয়েছিল নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সাধারণ নির্বাচনের ব্যবস্থা। এর ফলে নাগরিকেরা পেয়েছিলেন ইচ্ছামাফিক ভোট দিয়ে সরকার বদলের সুযোগ। সেটি তুলে দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে রাজনৈতিক মতৈক্য হয়নি। ২০২২ সালে এসে রাজনৈতিক বিরোধ আরও ঘনীভূত হয়েছে এবং তা আবারও সংঘাতের দিকে যাচ্ছে, যেমনটি আমরা দেখেছিলাম ২০১৪-১৫ সালে। 

বছরখানেক পরেই জাতীয় নির্বাচন। এ নিয়ে তৈরি হয়েছে আগাম উত্তাপ। নির্বাচনী লড়াই সামনে রেখে পক্ষগুলো যার যার ঘর গোছাচ্ছে, শাণ দিচ্ছে নিজ নিজ অস্ত্রে। দেশের রাজনীতিতে প্রধান পক্ষ দুটি। একটি হলো ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। তারা ২০০৯ সাল থেকে একটানা ক্ষমতায় আছে। তাদের মূল প্রতিপক্ষ বিএনপি। তারা ক্ষমতার বাইরে আছে ১৬ বছর। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থেকে যেতে মরিয়া। তাদের অন্যতম অস্ত্র হলো বর্তমান সংবিধান। এটা পবিত্র আমানত, বদলানো যাবে না। বিএনপি চায়, সংবিধানের সংশোধন। বর্তমান ব্যবস্থা চালু থাকলে কিংবা সংবিধান সংশোধন করা হলে তার নতিজা কী হবে, তা উভয় পক্ষ ভালো করেই জানে। সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর এই অবস্থানে সংকট বাড়ছে, জল আরও ঘোলা হচ্ছে। 

অনেক দিন থেকেই ছিল জোটের রাজনীতি। একদিকে ১৪ দল, অন্যদিকে ২০ দল। ২০২২ সালে এসে জোট যাচ্ছে অস্তাচলে। তাদের সভা হয় না বললেই চলে। এ বছর নানান ইস্যুতে আওয়ামী লীগকে একাই কথা বলতে দেখা গেছে। জোটসঙ্গীরা কেউ কেউ মুখ ফসকে উল্টাপাল্টাও বলেছেন। এক শরিক তো জোটকে বর্জনই করেছে। নিজস্ব প্রতীকে নির্বাচন করতে তারা নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন চেয়ে আবেদন করেছিল অনেক আগেই। এখনো সেটি ঝুলে আছে। 

২০–দলীয় জোটে বিএনপির প্রধান অবলম্বন ছিল জামায়াত। তাদের কেউ কেউ এবি পার্টি নাম দিয়ে একটা দল বানিয়েছিলে। প্রশ্ন উঠেছিল, এটা কি জামায়াতের সংস্কার প্রক্রিয়ার অংশ ছিল, নাকি সরকারি প্রজেক্ট। যা–ই হোক, সেটা জমাতে পারেনি। মূল জামায়াতের কোনো নেতাকে তারা নিতে পারেনি। মূল জামায়াতের নেতারা আছেন দৌড়ের ওপর। তাঁরা বলছেন তাঁরা বিএনপির সঙ্গে আর নেই। বিএনপি বিষয়টি এখনো পরিষ্কার করেনি। অন্যদিকে কয়েকটি দল, যাদের পরিচয় ছিল নাগরিক গ্রুপ হিসেবে, তারা বিএনপিকে সমর্থন দিচ্ছে। এদের মুখের কথায় বিশ্বাস করলে বলতে হয়, তাঁরা অনেকেই বিপরীত মেরুর বাসিন্দা হয়েও গণতন্ত্র উদ্ধারের আন্দোলন হিসেবে বিএনপির সঙ্গে ঐক্য করেছেন। তাঁদের কেউ কেউ ২০১৮ সালের নির্বাচনের সময় ‘জাতীয় ঐক্য ফ্রন্টের’ শরিক ছিলেন। সেখানে জামায়াতসহ ২০ দলীয় জোটও ছিল। এটা নির্বাচনী ঐক্যের দিকে না গেলে তাঁরা অচিরেই সরে কিংবা ঝরে পড়বেন। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে এটা বোঝা যাবে। 

বছরজুড়েই ছিল বাগ্​যুদ্ধ। কথাবার্তা, শব্দচয়ন, বাক্যবিন্যাস ও দেহভঙ্গিমায় তাঁরা চার-পাঁচজন নজর কেড়েছেন। আমাদের যথেষ্ট বিনোদন দিচ্ছেন এবং বিরক্তও করছেন। একই রেকর্ড শুনতে কার ভালো লাগে! সময় বদলায়। তাঁদের কথা আর অঙ্গভঙ্গি বদলায় না। 

বছর শেষে রাজনীতি বেশ চাঙা হয়েছে। বিএনপি অনেক দিন প্রায় স্থবির ছিল। তারা বিভাগীয় শহরগুলোয় একের পর এক সমাবেশ করে তাক লাগিয়ে দেয়। সরকারের অনুগতরা নানান ছুতায় বাধা দিলেও সমাবেশগুলো সফল হয়। আওয়ামী লীগের প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হয়েছে, এটা তাদের জন্য উদ্বেগের। মাঠ না বেদখল হয়ে যায়! শুরু হয়ে যায় আওয়ামী লীগের নানান অঙ্গসংগঠনের সম্মেলন, সমাবেশ, মিছিল। 

১০ ডিসেম্বর ঢাকায় বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে খণ্ডযুদ্ধ হয়েছে। তাদের কয়েকজন শীর্ষ নেতা গ্রেপ্তার হয়েছেন। এখন যাঁরা মাঠে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাঁদের অপেক্ষাকৃত নরমপন্থী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বোঝা যাচ্ছে না এটা কি বিএনপির নতুন কৌশল, নাকি কৌশলটা আওয়ামী লীগ তথা সরকারের। ২০১৮ সালের নির্বাচনের সময় বিএনপি সরকারের ফাঁদে পড়েছিল। প্রশ্ন হলো, আবার কি নতুন করে ফাঁদ তৈরি হচ্ছে? বিএনপির হাতে গোনা কয়েকজন সংসদ সদস্য পদত্যাগ করেছেন। এটা কি গণতান্ত্রিক আন্দোলনের একটি ধাপ, নাকি কোনো প্রকল্পের অংশ, তা ভবিষ্যতে জানা যাবে। 

এর মধ্যে জাতীয় পার্টি আলোচনায় শিরোনাম হয়েছে। দলের প্রতিষ্ঠাতার মৃত্যুর পর সেখানে কিছুদিন ছিল দেবর-ভাবির ঝগড়া। পরে একটা আপস হয়েছিল। সেটি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। হাসপাতালের বিছানা থেকে উদয় হয়েছেন দীর্ঘদিন অনুপস্থিত থাকা সংসদে বিরোধী দলের নেতা। এদিকে দলের চেয়ারম্যান কর্তৃত্ব ফিরে পেতে কোর্টে দৌড়াচ্ছেন। জাতীয় পার্টিকে বশে রাখতে নানান অঙ্ক কষছে আওয়ামী লীগ। এসব দেখে শৈশবে মেলার পুতুলনাচের স্মৃতি মনে পড়ে যায়। পর্দার আড়াল থেকে কেউ সুতা ধরে টানে, পুতুলগুলো সুতার টানে নাচে—‘যেমনি নাচাও তেমনি নাচি পুতুলের কী দোষ।’

আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী শুধু নয়, তারা একে অপরের শত্রু। তাদের মধ্যে আগে কয়েকবার মিলমিশ হলেও এখন সমঝোতার সম্ভাবনা ক্ষীণ। এক পক্ষ যদি অনড় হয়, অন্য পক্ষ হয় আত্মসমর্পণ করবে, অথবা লড়াই জারি রাখবে। সে ক্ষেত্রে সমঝোতার সুযোগ আর থাকে না। লড়াইটা যেহেতু রাষ্ট্রক্ষমতার মালিকানা নিয়ে, সেখানে শরিকানার প্রশ্ন ওঠে না। সুতরাং সংঘাত অনিবার্য। সংঘাত এড়াতে দুই পক্ষকেই নমনীয় হতে হবে, অথবা এক পক্ষকে অন্য পক্ষের কথা মেনে নিতে হবে। ভোটাররা এখানে গৌণ। ভোটের রাজনীতির এ এক অগ্নিপরীক্ষা। ২০২৩ সালটি হবে খুবই অনিশ্চিত, স্পর্শকাতর ও আতঙ্কের। 

তারপরও ভোর হবে। নতুন সূর্য উঠবে। আমরা আশায় বুক বাঁধব। আমরা প্রার্থনা করব—সবার সুমতি হোক। 

লেখক: লেখক ও গবেষক