বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস

আমাদের জনসংখ্যানীতিকে সাজাতে হবে নতুনভাবে

আজ ১১ জুলাই ২০২৩। সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস।

১৯৮৭ সালের এই দিনে বিশ্বের জনসংখ্যা ৫০০ কোটিতে উপনীত হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯০ সালে তারিখটিকে বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয় জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য, ‘জেন্ডার সমতাই শক্তি: নারী ও কন্যাশিশুর মুক্ত উচ্চারণে হোক পৃথিবীর অবারিত সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন’।
২০২২ সালের জনশুমারি থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী আমাদের দেশে নারী ও পুরুষের অনুপাত ১০০: ৯৮.০৪। এবারের প্রতিপাদ্যের আলোকে আমাদের দেশে জেন্ডার সমতা ও নারীর অধিকার সমুন্নত রাখা এবং নারী ও কন্যাশিশুর শক্তিকে কাজে লাগানোর বিষয়টি গণপরিসরে ব্যাপক আসবে, এমনটিই কাম্য।

২০২২ সালের জনশুমারি ও গৃহগণনার তথ্যমাফিক বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার ৬১৬। জনঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১ হাজার ১১৯। মোট প্রজননের হার জাতীয়ভাবে ২ দশমিক ৩ হলেও অঞ্চলভেদে এর তারতম্য রয়েছে। আমাদের বর্তমান জনসংখ্যানীতি ২০১২ সালে গৃহীত হয়। বাংলাদেশ জনসংখ্যানীতি ২০১২-এর উদ্দেশ্যগুলোর মধ্যে মোট প্রজননের হার ২ দশমিক ১ অর্জনের পথেই রয়েছি আমরা।

তারপর এক দশক পেরিয়ে গেছে। বিগত এক দশকের বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে অভ্যন্তরীণ স্থানান্তর, পেশার পরিবর্তন, শিক্ষার হার বৃদ্ধি, কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি ইত্যাদির ফলে জনমিতির প্রবণতায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন লক্ষণীয়। ফলে আমাদের জনসংখ্যানীতি যুগোপযোগীকরণের ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় বিবেচনায় রাখা জরুরি।

জনসংখ্যা ব্যবস্থাপনা

আমাদের জনসংখ্যা কর্মসূচিকে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ধারণার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না; বরং জনসংখ্যা ব্যবস্থাপনার ধারণাটি জনসংখ্যানীতিতে স্পষ্ট হতে হবে। বাংলাদেশ এখন জনমিতির লভ্যাংশ বা পপুলেশন ডিভিডেন্ডের সময় পার করছে। জনসংখ্যাকে জনসম্পদে পরিণত করে এর পূর্ণ সুফল আমাদের নিতে হবে। শহরমুখী মানুষের ঢল থামাতে সুষম আঞ্চলিক উন্নয়ন, কর্মসংস্থান সৃজন ও আঞ্চলিক পর্যায়ে শিক্ষা-চিকিৎসার মতো মৌলিক প্রয়োজনগুলোর নিশ্চয়তা দিতে হবে। ২০২২ সালের জনশুমারির ফলাফল থেকে দেখা যায়, জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার সব বিভাগে এক নয়। বৃদ্ধির হার সর্বোচ্চ ঢাকা বিভাগে ১ দশমিক ৭৪ শতাংশ আর সর্বনিম্ন বরিশালে শূন্য দশমিক ৭৯ শতাংশ। প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ও বদ্বীপ পরিকল্পনার মতো সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তন ও অন্যান্য নিয়ামকের আলোকে নীতি প্রণয়ন করতে হবে।

অধিকারভিত্তিক পরিবার পরিকল্পনা

অধিকারভিত্তিক পরিবার পরিকল্পনা ধারণাটি জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ধারণার চেয়ে বিস্তৃত ও অধিক প্রযোজ্য। পরিবার পরিকল্পনা সেবা পাওয়ার অধিকার আন্তর্জাতিকভাবে একটি মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃত। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি নাগরিকের সেবাপ্রাপ্তির অধিকারকে নিশ্চিত করতে হবে। জবাবদিহি সমতা এবং সেবাকে অধিকার হিসেবে পাওয়ার ক্ষেত্রে জনগণের ক্ষমতায়ন জরুরি। পরিবার পরিকল্পনা সেবাগ্রহীতাদের অবহিত সম্মতি ধারণাটিকে নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে গুরুত্ব দিতে হবে। সেবাগ্রহীতার কাছে সব তথ্য দিতে হবে। পদ্ধতি গ্রহণের ক্ষেত্রে তাঁর স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। তাঁর কাছে পূর্ণ, যথাযথ ও পক্ষপাতহীন তথ্য দিতে হবে।

জনসংখ্যানীতি প্রণয়নে অংশীজনদের মতামত গ্রহণ ও প্রচার

বাংলাদেশের জনসংখ্যানীতি জনপরিসরে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয় না। ফলে এর অভীষ্টগুলো সম্পর্কে জনগণের ধারণা নেই। জনসংখ্যানীতির যুগোপযোগীকরণ প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন অংশীজন, যেমন গবেষক, নীতিনির্ধারক, পরিকল্পনাবিদ, ব্যবস্থাপক, শিক্ষক ও গণমাধ্যমকর্মীদের সংশ্লিষ্ট করতে কর্মসূচি গ্রহণ করেছে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর। সেই সঙ্গে প্রণীত নীতি ব্যাপক প্রচারে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে, যাতে এর উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সবাইকে সক্রিয়ভাবে পাশে পাওয়া যায়।

কর্মজীবী নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য নিশ্চিতকরণ

২০১২ সালের জনসংখ্যা নীতিতে শিল্প মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা আলোচনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, কারখানাগুলোতে কর্মরত নারী ও পুরুষ শ্রমিকদের প্রজনন স্বাস্থ্য নিশ্চিত করার জন্য পরিবার পরিকল্পনা ও প্রজনন স্বাস্থ্য তথ্য ও সেবা প্রদানের ব্যবস্থা করবে। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কিছু ভূমিকার কথা বলা আছে। বর্তমানে তৈরি পোশাকশিল্পের খাতসহ অন্যান্য খাতে শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন ছুটির পরিমাণ অন্যান্য খাতের কর্মচারিদের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। আমাদের শ্রম আইনে কর্মজীবী নারীর মাতৃত্বকালীন ছুটি নির্ধারণ করা আছে চার মাস। আমাদের জনসংখ্যানীতিতে শ্রমিক নারীর মাতৃত্বকালীন সুবিধা, কর্মক্ষেত্রে দিবাযত্ন কেন্দ্র ও দুগ্ধদান কর্নার স্থাপন ইত্যাদি বিষয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা থাকতে হবে।

প্রবাসী নাগরিকদের সার্বিক কল্যাণ

বাংলাদেশের শ্রমশক্তির একটা অংশ বহির্বিশ্বে প্রবাসজীবন বেছে নেয়। ২০১২ সালের জনসংখ্যানীতিতে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা হিসেবে কেবল যৌনরোগ এবং এইচআইভি/এইডস সংক্রমণ নজরদারির কথা বলা হয়েছে। জনসংখ্যানীতিতে আমাদের বিপুলসংখ্যক প্রবাসী নাগরিকের শারীরিক মানসিক স্বাস্থ্য ও দেশের সংস্কৃতির সঙ্গে তাঁদের নিবিড় সম্পৃক্ততা বজায় রাখা ও সাংস্কৃতিক বিকাশে ভূমিকা রাখার সুযোগ তৈরি করতে হবে। তাঁদের আন্তরিকভাবে এ দেশের সঙ্গে সম্পৃক্ত রাখতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, সীমিত সম্পদের ও বিপুল জনঘনত্বের এই দেশে প্রবাসীরা বহুমাত্রিক অবদান রাখছেন। এটি জনমিতিক ব্যবস্থাপনার আঙ্গিকে চিন্তা করার জরুরি।

বয়স্ক জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা

বাংলাদেশে বর্তমানে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতায় বয়স্কদের জন্য ভাতার ব্যবস্থা রয়েছে। জনসংখ্যানীতিতে বয়স্ক জনগোষ্ঠীর কল্যাণ ধারণাটিকে আরও বৃহৎ পরিসরে নিয়ে আসা প্রয়োজন। প্রয়োজন স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান, গণপরিবহন ও অন্যান্য জায়গায় বয়স্কবান্ধব ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। এ জন্য পারিবারিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে বয়স্ক জনগোষ্ঠীর সুরক্ষা বিধানের জন্য সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে হবে।

বাংলাদেশের পরিবার পরিকল্পনা সেবা কার্যক্রম আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি সফল কার্যক্রম। পরিবার পরিকল্পনা, মা-শিশুস্বাস্থ্য ও কৈশোরকালীন প্রজনন স্বাস্থ্য কার্যক্রমে আমাদের দৃশ্যমান সাফল্য রয়েছে। শিশুমৃত্যুর হার হ্রাসে সাফল্যের জন্য গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এমডিজি অ্যাওয়ার্ড ২০১০ অর্জন করেছেন। আগামী দিনে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনের লক্ষ্যে আমাদের জনসংখ্যানীতিকে নতুনভাবে সাজাতে হবে

  • মাহ্দী হাসান খান সরকারি চাকরিজীবী। ই-মেইল: mahdi21c@live.com