বান্দরবানের রুমায় সোনালী ব্যাংকে কেএনএফ সন্ত্রাসীদের হামলার চিত্র
বান্দরবানের রুমায় সোনালী ব্যাংকে কেএনএফ সন্ত্রাসীদের হামলার  চিত্র

বিশ্লেষণ

কেএনএফ কেন পার্বত্য চুক্তি ও জেএসএস বিদ্বেষী

বান্দরবানের রুমা ও থানচিতে ব্যাংকে হামলা চালিয়ে এখন আলোচনায় কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)। পাহাড়ের অপেক্ষাকৃত নতুন এই সশস্ত্র সংগঠন কেন এমন বেপরোয়া হয়ে উঠল। এই হামলার নেপথ্যে কী? কী চায় কেএনএফ? তার আদ্যোপান্ত তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন পার্থ শঙ্কর সাহা। দুই পর্বের এই আয়োজনের আজ থাকছে শেষ পর্ব-

কেএনএফ শুরুতে পাহাড়ে নতুন রাজ্যের দাবি থেকে সরে এসে এখন কেটিসির মতো স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান চায়। এমন মৌলিক একাধিক দাবির ক্ষেত্রে পরিবর্তন হলেও একটি বিষয়ে তাদের অবস্থানের ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন হয়নি, তাহলো জেএসএস এবং আঞ্চলিক পরিষদ বিরোধিতা। পাহাড়ের প্রথম রাজনৈতিক দল জেএসএসের প্রতি তাদের বিদ্বেষ আগে যেমন ছিল এখনও তেমন আছে। সেই সঙ্গে আছে আঞ্চলিক পরিষদ ও চাকমা বিদ্বেষ।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মাধ্যমে পাহাড়ে বিশেষ দুই প্রতিষ্ঠান আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন জেলা পরিষদ গঠিত হয়। বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে এই দুই প্রতিষ্ঠান বিশেষ বলে মনে করেন স্থানীয় সরকারের বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু পার্বত্য চুক্তির সম্পাদন প্রক্রিয়া সহজে হয়নি। দেশের মধ্যেই এর প্রবল বিরোধিতায় নামে তৎকালীন বিরোধী দল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী।

এর ফলে পাহাড় হাতছাড়া হয়ে যাবে বলেও ভয় দেখায় ওই দলগুলো। পুনর্বাসিত বাঙালিদের অনেকে চুক্তির বিরোধিতা করে। পাহাড়িদের একটি অংশ ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) নাম দিয়ে চুক্তির বিরোধিতা করে এবং ‘পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্তশাসনের’ দাবি করে। এসব বিরোধিতার পরও চুক্তি হয়। চুক্তির পর ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় এলেও সেই চুক্তি কিন্তু বাতিল করেনি।

তিন পার্বত্য জেলার গুরুত্বপূর্ণ স্থায়ী ঐতিহ্যবাহী প্রশাসনিক পদ হলো চিফশিপ এবং হেডম্যান। এদের বেশির ভাগই চাকমা, নয়তো মারমা সম্প্রদায়ের। ইউনিয়ন, উপজেলা এবং ব্যবসা, এনজিও, প্রশাসনিক সব পদে হয় চাকমা, নয় মারমা জনগোষ্ঠীর লোকজনের প্রাধান্য। এ নিয়ে চাকমা ও মারমা ছাড়া অন্য গোষ্ঠীগুলোর কিছুটা ক্ষোভও আছে।

কিন্তু আজ পর্যন্ত তিন জেলা পরিষদের কোনো নির্বাচন হয়নি। যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে, তখন তাদের লোক জেলা পরিষদে বসে। আর জেলা পরিষদের নির্বাচন না হওয়ায় আঞ্চলিক পরিষদেরও নির্বাচন হয়নি। চুক্তির ফসল এই আঞ্চলিক পরিষদকে অকার্যকর করে রাখা হয়েছে। চুক্তির পর ভূমি, নিজস্ব পুলিশের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর কোনো সুরাহা হয়নি।

চুক্তি বাস্তবায়নে কমিটির সভা স্থানীয় বাঙালি সংগঠনগুলোর প্রবল বিরোধিতায় একাধিকবার বানচাল হয়ে যায়। তাদের পেছনে বড় শক্তির আশীর্বাদ আছে বলে অভিযোগ করেছেন পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান সন্তু লারমা। তিনি একাধিকবার চুক্তি বাস্তবায়নে সরকারের অনীহার কথা বলেছেন। সরকারের কোনো অংশ ভেতরে-ভেতরে চুক্তির বিরোধিতায় সক্রিয়—এমন অভিযোগও আছে তাঁর।

আঞ্চলিক পরিষদ, জেএসএস এবং চাকমা জাতিসত্তাকে সমান্তরাল বিবেচনা করে তাদের বিরুদ্ধে বিষোদ্‌গার কেএনএফ হয়তো প্রকাশ্যে করেছে। কিন্তু এমন বিদ্বেষ পাহাড়ে নতুন নয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের ১১টি ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মধ্যে চাকমারা সংখ্যাগরিষ্ঠ। শিক্ষাসহ নানা ক্ষেত্রে তারা এগিয়েও।

তিন পার্বত্য জেলার গুরুত্বপূর্ণ স্থায়ী ঐতিহ্যবাহী প্রশাসনিক পদ হলো চিফশিপ এবং হেডম্যান। এদের বেশির ভাগই চাকমা, নয়তো মারমা সম্প্রদায়ের। এ জন্য পাহাড়ে বাঙালি বাদে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মধ্যে ঐতিহ্যবাহী সংগঠন, ইউনিয়ন, উপজেলা এবং ব্যবসা, এনজিও, প্রশাসনিক সব পদে হয় চাকমা, নয় মারমা জনগোষ্ঠীর লোকজনের প্রাধান্য। এ নিয়ে চাকমা ও মারমা ছাড়া অন্য গোষ্ঠীগুলোর কিছুটা ক্ষোভও আছে। তবে পাহাড়ের দুই দশকের আন্দোলন শুধু চাকমাদের ছিল না, সেখানে পাহাড়ের সব জাতিগোষ্ঠীরই অংশগ্রহণ ছিল।

জারলাম বম প্রথম আলোকে বলেন, ‘জেএসএসের প্রতি পাহাড়ের ১১টি জাতিসত্তারই সমর্থন ছিল।’

বান্দরবানে ব্যাংক ডাকাতি ও অস্ত্র লুটের ঘটনায় গ্রেপ্তার আসামিদের আদালতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
‘কেএনএফের তৎপরতা দেখে একটি শিশুও বুঝতে পারবে এর পেছনে আসলে কী বা কারা আছে। পার্বত্য চুক্তির মূল চেতনাকে নস্যাৎ করে দেওয়াই এসব গোষ্ঠীর মূল কাজ। আর পেছন থেকে তাদের তৎপরতায় সায় দিচ্ছে বড় কোনো স্বার্থবাদী গোষ্ঠী।
নিরূপা দেওয়ান, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও নারীনেত্রী

যদিও সেই সময় সংখ্যায় কম কিছু জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে জেএসএস-বিরোধিতা ছিল। যেমন ম্রোদের মধ্যে ‘গরম বাহিনী’ নামে একটি সশস্ত্র গোষ্ঠীর জন্ম দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা সংখ্যায় ছিল নগণ্য। এই বাহিনীর জন্ম হয়েছিল বান্দরবানে, আজ যেখানে বেশি সক্রিয় কেএনএফ। এমন সশস্ত্র গোষ্ঠী গঠিত হয় ২০১৮ সালের নির্বাচনের সময়। ওই সময় বান্দরবানের একটি বড় অংশজুড়ে ‘মগ পার্টি’ নামের একদল সশস্ত্র যুবকের আবির্ভাব ঘটে।

মূলত নির্বাচনের কাজে ব্যবহারের জন্য শাসক দলের বড় কোনো নেতা তাদের একজোট করেছিল বলে ধারণা করা হয়। তবে বান্দরবানের সংসদ সদস্য এবং সাবেক মন্ত্রী বীর বাহাদুর মগ পার্টির পেছনে কোনো ইন্ধনের অভিযোগ একাধিকবার এ প্রতিবেদকের কাছে অস্বীকার করেছেন।

যাহোক, নির্বাচনের পরপর মগ পার্টির চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে বান্দরবান এবং এর লাগোয়া রাঙামাটির রাজস্থলীর মানুষ। তবে একপর্যায়ে এসব তাণ্ডব বন্ধ হয়। ঘটনাক্রমে মগ পার্টির আক্রমণের লক্ষ্য ছিল জেএসএস-সমর্থক পাহাড়ি মানুষ।

পাহাড়ে আরও ‘শান্তি প্রস্তাব’

হঠাৎ করেই ২০২২ সালের জুন মাসে পাহাড়ে চুক্তিবিরোধী সংগঠন ইউপিডিএফ ‘সরকারের কাছে’ একটি ‘শান্তি প্রস্তাব’ উপস্থাপন করে। গত ৯ জুন খাগড়াছড়ির পানছড়ি উপজেলার ২ নম্বর চেঙ্গী ইউনিয়নের বড়কলক এলাকায় এক অনুষ্ঠানে ইউপিডিএফের পক্ষে কেন্দ্রীয় নেতা উজ্জ্বল স্মৃতি চাকমা এ দাবিনামা হস্তান্তর করেন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত এক মেজরের কাছে।

এই কথিত শান্তি প্রস্তাব এক বিস্ময়ের সৃষ্টি করে। কারণ, ইউপিডিএফ কোনো সশস্ত্র আন্দোলনে ছিল না। তাদের নেতা প্রসিত বিকাশ খীসাসহ একাধিক নেতা জাতীয় নির্বাচনগুলোতেও অংশ নিয়েছেন একাধিকবার। তাই সরকারের বাইরের একজন ব্যক্তির কাছে এমন শান্তি প্রস্তাব দেওয়ার বিষয়টি আলোচনার সৃষ্টি করে। আন্তর্জাতিক কোনো কোনো সংবাদমাধ্যমও এ নিয়ে প্রতিবেদন করে। জেএসএস এই তৎপরতা প্রত্যাখ্যান করে। পাহাড়ের অনেকের কাছেই বিষয়টি ছিল অদ্ভুত। এ ব্যাপারে গণমাধ্যম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মন্তব্য চাইলেও তিনি এ নিয়ে কোনো কথা বলেননি। এ নিয়ে কয়েক দিনের আলোচনার পর বিষয়টি ধামাচাপা পড়ে যায়।

কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা কেএনএফের প্রতিষ্ঠাতা নাথান বম
সংখ্যাগরিষ্ঠ পাহাড়িরা পার্বত্য চুক্তির যেমন পক্ষে, আবার আঞ্চলিক পরিষদসহ স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিও তাদের আস্থা কম নয়। এমন পরিস্থিতিতে ‘চাকমা’ কর্তৃত্বের অভিযোগ তুলে কেএনএফ এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে

পার্বত্য চুক্তি প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা?

কখনো মগ পার্টি, কখনো শান্তি প্রস্তাব আবার শেষে কেএনএফের কেটিসি—পাহাড়ি এবং পাহাড় সম্পর্কে ওয়াকিবহাল বাঙালিদের অনেকেরই কথা, মূলত পার্বত্য চুক্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্যই এসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। তাঁরা মনে করছেন, পার্বত্য চুক্তির মাধ্যমে দুই দশকের সশস্ত্র সংঘর্ষের সমাপ্তি ঘটে। কিন্তু এ চুক্তির মূলধারাগুলো এখনো অবাস্তবায়িত থাকার জন্য নতুন নতুন সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে এবং অনেক পক্ষ নানা সুযোগ গ্রহণ করছে।

পাহাড়ের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও নারীনেত্রী নিরূপা দেওয়ান বলছিলেন, ‘কেএনএফের তৎপরতা দেখে একটি শিশুও বুঝতে পারবে এর পেছনে আসলে কী বা কারা আছে। পার্বত্য চুক্তির মূল চেতনাকে নস্যাৎ করে দেওয়াই এসব গোষ্ঠীর মূল কাজ। আর পেছন থেকে তাদের তৎপরতায় সায় দিচ্ছে বড় কোনো স্বার্থবাদী গোষ্ঠী। এসব পাহাড়ে নতুন নয়। কিন্তু সরকারের কখনোই উচিত হবে না তাদের মদদ দেওয়া।’

সংখ্যাগরিষ্ঠ পাহাড়িরা পার্বত্য চুক্তির যেমন পক্ষে, আবার আঞ্চলিক পরিষদসহ স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিও তাদের আস্থা কম নয়। এমন পরিস্থিতিতে ‘চাকমা’ কর্তৃত্বের অভিযোগ তুলে কেএনএফ এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যে অবস্থান নিয়েছে, তাতে কি কোনো বড় শক্তি ইন্ধন দিচ্ছে?

রাষ্ট্রের মতো একটি প্রতিষ্ঠান যখন কোনো চুক্তি করে, তখন তার গুরুত্ব থাকে ভিন্ন রকম। দুর্ভাগ্যজনকভাবে চুক্তি করেও পার্বত্য চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হয়নি। সেটা করা হলে পাহাড়ে এই দুর্বৃত্তপনা বন্ধ হয়ে যেত।

প্রশ্নের জবাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ উদ্দিন আহমেদ বলছিলেন, ‘ভাগ করো ও শাসন করো—এটা যেকোনো শাসকের চেষ্টার অংশ থাকে। কিন্তু বাংলাদেশের সরকার পাহাড়িদের মধ্যে এই বিভেদ আনতে আঞ্চলিক পরিষদের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষমতা খর্ব করার চেষ্টা করছে—এমন ষড়যন্ত্র তত্ত্বের পেছনে উপযুক্ত প্রমাণ আমাদের হাতে নেই।’

কেএনএফের নতুন হামলার পর তাদের আবার শান্তির পথে আসতে বলেছে তাদের সঙ্গে এত দিন আলোচনা করা শান্তি কমিটি। আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, ‘বর্তমান সরকার জনগণের সরকার, জনগণ চাইলে কেএনএফের সঙ্গে আবারও শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির সংলাপ হতে পারে।’

যেকোনো গোষ্ঠীর সঙ্গে শান্তি আলোচনা নিয়ে কারও কোনো মতভেদ নেই। কিন্তু যে গোষ্ঠী এভাবে একের পর এক অযৌক্তিক দাবি এবং সংঘাতের পথে আছে, তাদের সঙ্গে আলোচনায় যেতে হলে আরও ভাবা উচিত বলে মনে করেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান।

তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কেএনএফের দাবি মেনে নিয়ে পাহাড়ে আবার কোনো উগ্র প্রতিষ্ঠানের সৃষ্টি একেবারে অমূলক। বাংলাদেশ রাষ্ট্র ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি করেছে। রাষ্ট্রের মতো একটি প্রতিষ্ঠান যখন কোনো চুক্তি করে, তখন তার গুরুত্ব থাকে ভিন্ন রকম। দুর্ভাগ্যজনকভাবে চুক্তি করেও পার্বত্য চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হয়নি। সেটা করা হলে পাহাড়ে এই দুর্বৃত্তপনা বন্ধ হয়ে যেত।’