বর্তমান সময়ের একটা বড় আলোচনার বিষয় হচ্ছে ইন্টারনেটের দাম। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ইন্টারনেট এখন অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। পড়াশোনা, চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য, এমনকি বিনোদনের জন্যও ইন্টারনেট লাগছে। কিন্তু এই ইন্টারনেট সেবা দেওয়ার খরচ দিন দিন বেড়ে চলেছে। ডলারের দাম বাড়ছে, ব্যাংকের সুদ বাড়ছে আর তার সঙ্গে বাড়ছে যন্ত্রপাতির দাম। এই পরিস্থিতিতে ইন্টারনেট কোম্পানিগুলো হন্যে হয়ে নতুন নতুন উপায় খুঁজছে, কীভাবে খরচ কমানো যায়।
ইন্টারনেট সেবা দেওয়ার পেছনে সবচেয়ে বেশি খরচ যায় নেটওয়ার্কের যন্ত্রপাতি কিনতে। একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টা সহজে বোঝা যাবে। ধরুন, আপনার বাসায় ইন্টারনেট নিতে গেলে একটা রাউটার লাগে, যার দাম দুই থেকে তিন হাজার টাকা।
এখন ভাবুন, একটা ইন্টারনেট কোম্পানিকে বাসার রাউটার পর্যন্ত পৌঁছাতে কত যন্ত্রপাতি কিনতে হয় লাখ লাখ গ্রাহককে সেবা দেওয়ার জন্য। এই যন্ত্রপাতির দাম শতকোটি টাকা। আর এগুলো কিনতে হয় বিদেশ থেকে, দামি ডলার দিয়ে।
কিন্তু এখন যন্ত্রপাতি তৈরির কোম্পানিগুলো কিছু নতুন টেকনোলজি নিয়ে এসেছে। এটার নাম ভার্চ্যুয়ালাইজেশন বা ভাগাভাগি প্রযুক্তি। এই টেকনোলজির মাধ্যমে একটা যন্ত্রকে এমনভাবে ব্যবহার করা যায় যে সেটা একসঙ্গে অনেকটি কোম্পানির কাজ চালাতে পারে। এই পদ্ধতিকে বলা হয় অ্যাকটিভ নেটওয়ার্ক শেয়ারিং।
আরেকটা সহজ উদাহরণ দিই। ধরুন, আপনার এলাকায় তিনটা ইন্টারনেট কোম্পানি আছে—ক, খ এবং গ। এখন প্রতিটি কোম্পানিকে আলাদা আলাদা পয়েন্ট অফ প্রেজেন্স (পপ) বসাতে হচ্ছে, আলাদা রাউটার-সুইচ লাগাতে হচ্ছে, আলাদা ফাইবার অপটিক কেব্ল টানতে হচ্ছে। এখন এই তিনটা কোম্পানি মিলে যদি একটা বড় ও শক্তিশালী সিস্টেম কেনে, তাহলে খরচ কমে আসবে। এই সিস্টেমটা এমনভাবে তৈরি হবে যেন তিন কোম্পানির কাজ একসঙ্গে চালাতে পারে। ফলে প্রতিটি কোম্পানির খরচ কমে যাচ্ছে এক-তৃতীয়াংশ। শুধু কেনার খরচই নয়, মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের খরচও ভাগ হয়ে যাচ্ছে।
এই সিস্টেমের আরেকটা বড় সুবিধা হলো নেটওয়ার্কের স্পিড বা গতি বাড়ে। কারণ, একটা শক্তিশালী যন্ত্র দিয়ে কাজ করা হচ্ছে। একটা উদাহরণ দিই। আগে যদি আপনি ইউটিউবে ভিডিও দেখতে গিয়ে বাফারিং এর সমস্যায় পড়তেন, এখন সেই সমস্যা অনেক কম হবে। অনলাইন ক্লাস করা, ভিডিও কল করা, গেম খেলা—সবই হবে আরও স্মুথ বা মসৃণভাবে। কারণ, আপনার সাপ্লাই চেইন ব্যান্ডউইডথ কিনবে বাল্কে। ছোট ছোট পাইপে সিস্টেম লস অনেক বেশি।
সব মিলিয়ে অ্যাকটিভ নেটওয়ার্ক শেয়ারিং একটি যুগোপযোগী পদ্ধতি। এর মাধ্যমে ইন্টারনেট কোম্পানিগুলো খরচ কমিয়ে ভালো সেবা দিতে পারছে। গ্রাহকেরাও পাচ্ছেন উন্নত মানের ইন্টারনেট। তবে এই সিস্টেম সফল করতে হলে দরকার ভালো পরিকল্পনা, কোম্পানিগুলোর মধ্যে সহযোগিতা আর সরকারের সহযোগিতা। ভবিষ্যতে এই পদ্ধতি আরও জনপ্রিয় হবে বলে আশা করা যায়। কারণ, প্রযুক্তি যত উন্নত হচ্ছে, যন্ত্রপাতি শেয়ার করার সুযোগও তত বাড়ছে।
নতুন এলাকায় ইন্টারনেট সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রেও এই সিস্টেম খুবই কার্যকর। ধরুন, একটা গ্রামে ইন্টারনেট সেবা দিতে হবে। আগে একটা কোম্পানির পক্ষে সেখানে সেবা দেওয়া আর্থিকভাবে লাভজনক হতো না। কারণ, যন্ত্রপাতির খরচ উঠত না। কিন্তু এখন তিনটা কোম্পানি মিলে সেই গ্রামে সেবা দিতে পারছে। কারণ, খরচ ভাগ হয়ে যাচ্ছে। এতে ছোট কোম্পানিগুলোও বড় কোম্পানির মতো দেশের সব জায়গায় সেবা দিতে পারছে। একইভাবে ফাইভ জি প্রযুক্তির ইন্টারনেট দিতে চাইলে একটা বিটিএস থেকে স্পেকট্রাম ও ডিভাইস শেয়ারিং ইন্টারনেটের দাম কমিয়ে আনতে বাধ্য।
পরিবেশের দিক থেকেও এই সিস্টেম অনেক ভালো। আগে যেখানে প্রতিটি কোম্পানির জন্য আলাদা পপ/বিটিএস লাগত, এখন একটা পপ/বিটিএস দিয়েই কাজ হচ্ছে। ফলে শহরের সৌন্দর্য নষ্ট হচ্ছে না। বিদ্যুৎ খরচও কম হচ্ছে। একটা হিসাব অনুযায়ী, এই সিস্টেমে বিদ্যুৎ খরচ প্রায় ৪০ শতাংশ কম হয়।
আরেকটা সুবিধা হচ্ছে, রেগুলেটরি অনুমতি নিতে হবে কম। কারণ, সরকারের অনুমতি নিয়ে এই কাজ শুরু করতে হয়। একবার অনুমতি পেলে কোম্পানিগুলোকে বারবার সরকারের কাছে যেতে হয় না। এটা একটা বড় সুবিধা। কারণ, এতে সময় বাঁচে, খরচও কম হয়। যখন একটা বড় সিস্টেম অনেক মানুষের জন্য ব্যবহার করা হয়, তখন প্রত্যেক গ্রাহকের পেছনে খরচ কমে যায়। অর্থনীতিতে একে বলে ‘ইকোনমি অব স্কেল’।
তবে এই সিস্টেমে কিছু সমস্যাও আছে। যেমন কোম্পানিগুলোর মধ্যে সমন্বয় করা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। কে কখন কতটুকু সিস্টেম ব্যবহার করবে, খরচ কীভাবে ভাগ হবে—এসব নিয়ে মতভেদ হতে পারে।
ধরুন, ঈদের সময় সব কোম্পানির গ্রাহকেরাই বেশি ইন্টারনেট ব্যবহার করে। তখন সিস্টেম ভাগ করা নিয়ে সমস্যা হতে পারে। গ্রাহকদের তথ্য নিরাপদ রাখাও একটা বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ, একই সিস্টেমে অনেক কোম্পানির তথ্য থাকে। সাইবার সিকিউরিটি বা তথ্য নিরাপত্তার জন্য অতিরিক্ত সতর্কতা নিতে হয়। তবে কোম্পানিগুলোর মধ্যে ঠিক সার্ভিস লেভেল অ্যাগ্রিমেন্ট থাকলে এটা আসলে কোনো সমস্যা নয়।
সব মিলিয়ে অ্যাকটিভ নেটওয়ার্ক শেয়ারিং একটি যুগোপযোগী পদ্ধতি। এর মাধ্যমে ইন্টারনেট কোম্পানিগুলো খরচ কমিয়ে ভালো সেবা দিতে পারছে। গ্রাহকেরাও পাচ্ছেন উন্নত মানের ইন্টারনেট। তবে এই সিস্টেম সফল করতে হলে দরকার ভালো পরিকল্পনা, কোম্পানিগুলোর মধ্যে সহযোগিতা আর সরকারের সহযোগিতা। ভবিষ্যতে এই পদ্ধতি আরও জনপ্রিয় হবে বলে আশা করা যায়। কারণ, প্রযুক্তি যত উন্নত হচ্ছে, যন্ত্রপাতি শেয়ার করার সুযোগও তত বাড়ছে।
রকিবুল হাসান টেলিকম ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাবিষয়ক লেখক ও একটি ইন্টারনেট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের প্রধান কারিগরি কর্মকর্তা