ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার বিসিএস প্রস্তুতির কেন্দ্র হয়েছে। এই গ্রন্থাগার খোলে সকাল আটটায়; কিন্তু ভোর থেকে লাইনে ব্যাগ রাখার প্রতিযোগিতা শুরু হয়
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার বিসিএস প্রস্তুতির কেন্দ্র হয়েছে। এই গ্রন্থাগার খোলে সকাল আটটায়; কিন্তু ভোর থেকে লাইনে ব্যাগ রাখার প্রতিযোগিতা শুরু হয়

বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কি বাজারের দাসত্ব করছে

বাজারের তেলেসমাতি এমন যে সেটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস ও কারিকুলাম, এমনকি চিন্তাজগতেও হাত দিয়ে ফেলেছে। বিশ্ববিদ্যালয় আজ স্বেচ্ছাধীন নয়, বাজারের ইচ্ছাধীন। বাজার, বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চশিক্ষার পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে লিখেছেন সৌমিত জয়দ্বীপ

বাংলাদেশের প্রথম উচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আরও একটু ‘বয়স্ক’ হলো। পৃথিবীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস মাপতে গেলে, এই বয়সকে অবশ্য অনেক নস্যি মনে হবে। তবু ‘সামান্য’ এ বয়সেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ইতিহাস, তা নিতান্তই ক্ষুদ্র নয়। এ বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের সব আশা-আকাঙ্ক্ষা ও জাতিগঠনে পীঠস্থানের ভূমিকা পালন করে এসেছে শতবর্ষ ধরে।

এ কথা বলাবাহুল্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেই প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠান, যার চৈতন্যের অন্দরে জন্ম হয়েছে বাংলাদেশ নামের জাতিরাষ্ট্রের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেই প্রতিষ্ঠান, যাকে অনুসরণ করে বাংলাদেশের বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও উচ্চ বিদ্যাপীঠ নিজেদের গড়ে তুলেছে। এটুকু অবদান দূরে সরিয়ে রেখে, ভাবার প্রয়োজন আছে, ঠিক কী অবস্থায় আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এ দেশের উচ্চশিক্ষার কাঠামোটি?

আরও সুনির্দিষ্টভাবে, স্বাধীনতার প্রায় ৫৫ বছর পর, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক উচ্চশিক্ষা কোথায় দাঁড়িয়ে আছে এবং সমাজ-রাষ্ট্রে ঠিক কী অবদান এই বিশ্ববিদ্যালয়-ব্যবস্থা রাখতে পেরেছে বা পারছে, তা নিয়ে আলাপ তোলা জরুরি হয়ে পড়েছে।

শিক্ষার চিন্তাপদ্ধতি

বাংলাদেশের শিক্ষাপদ্ধতি ও শিক্ষাব্যবস্থার সমস্যা বহুল চর্চিত। কিন্তু শিক্ষার চিন্তাপদ্ধতির সমস্যা নিয়ে চর্চা প্রায় নেই বললেই চলে। শুধু সনদধারীই শিক্ষিত বা বিদ্বান, সনদহীন-অজ্ঞাতমাত্রই অশিক্ষিত বা অবিদ্বান—এটি একটি ভয়ংকর ঔপনিবেশিক সমস্যাক্রান্ত প্রকল্প। এই প্রকল্প মানলে আমাদের চিরভাস্বর প্রবাদ-কন্যা বিদুষী খনাকে ‘অবিদ্বান’ বলে খারিজ করা যায়। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে সেটি কতটা যৌক্তিক হবে?

১৮৩৫ সালে ভারতের ভাইসরয় লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের প্রশ্রয়ে টমাস বেবিংটন মেকলে এ প্রকল্পের জন্মদাতা, কেননা তাঁর ‘অভিধানে’ শিক্ষা মানেই প্রাতিষ্ঠানিক উপযোগিতা ও শ্রেণিবিভক্ত সমাজ তৈরি করা। এর হাতিয়ার (টুল) হিসেবে মেকলে সাহেব খুব সচতুরভাবে যোগ করে দিলেন ভাষাকে, মানে ইংরেজিকে। ইংরেজি হয়ে উঠল ভারতবর্ষের ‘আধুনিক’ ও পাশ্চাত্যমুখী শিক্ষার বাহন (মিডিয়াম অব ইনস্ট্রাকশন) ও সরকারি ভাষা। ফলে চাকরির বাজারে ঢুকতে হলে ইংরেজি জানা জরুরি হয়ে উঠল।

বিনয় ঘোষ তাঁর বাংলার বিদ্বৎসমাজ গ্রন্থে এই চিন্তাপদ্ধতির সমালোচনা করে বলেছেন, ভারতীয় তথা বাঙালি নিম্নমধ্যবিত্তের প্রথম ইংরেজি জানার দৌড় পকেট ডিকশনারিতে টুকে রাখা কয়েক ডজন ইংরেজি শব্দ। এর অগ্রভাগে ছিল ‘ইয়েস, নো, ভেরি ওয়েল’ এবং তাতেই সে নিজেকে সাহেবের কাছারিতে চাকরি বাগিয়ে নেওয়ার যোগ্যতাসম্পন্ন মনে করতে শুরু করে দিয়েছিল।

শুধু তা-ই নয়। সে ভাবতে থাকল, মনিবের যোগ্য ভৃত্য আমি, এ ধরাধামে আমার চেয়ে উত্তম চাকর আর কে আছে! চাকরি সে চাকর সত্তার ভাবাদর্শ থেকেই করেছে, অহমিকা হিসেবে যোগ হয়েছে মাতৃভাষার অক্ষরজ্ঞান ও ইংরেজি ভাষার ‘ইয়েস-নো-ভেরি ওয়েলে’র ওপর দখল। মুখ্যত, সনদ-সংস্কৃতিকে বিদ্যাশিক্ষার ‘একক ফড়িয়া’ (সোল এজেন্ট) বানানো হয়েছে যে বাজারের স্বার্থে, সেই বাজারের ডাকনামই হচ্ছে চাকরি।

আরও গভীরভাবে দেখলে, শিক্ষা গ্রহণ মানে আদতে ‘শিক্ষিত’ হওয়াও নয়, চাকরি করার প্রাথমিক শর্ত পূরণ করা। অর্থাৎ চাকরি করার যোগ্য তিনিই, যিনি সনদধারী-শিক্ষিত। এভাবেই শিক্ষা হয়ে উঠল চাকরির সমানুপাতিক। ফলে যিনি কৃষক বা শ্রমিক, তাঁর বিশেষায়িত কিন্তু অপ্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান অস্বীকৃত রয়ে গেল এবং তিনি হয়ে উঠলেন শ্রেণি-আধিপত্যের মর্মন্তুদ শিকার।

■ শিক্ষা গ্রহণ মানে আদতে ‘শিক্ষিত’ হওয়াও নয়, চাকরি করার প্রাথমিক শর্ত পূরণ করা। অর্থাৎ চাকরি করার যোগ্য তিনিই, যিনি সনদধারী-শিক্ষিত। 

■ শ্রেণিবিভক্ত সমাজে শিক্ষা মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্তের কাছে শৌখিন কোনো বিষয় নয়। এ হলো তার অর্থ উপার্জন ও ‘গাড়ি-ঘোড়ায় চরা’র দরজা।

যে কৃষক শ্রমে-ঘামে ফসল ফলান, যে শ্রমিক কলকারখানায় উৎপাদনপ্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত, সে কৃষক বা শ্রমিকের জ্ঞান ‘অপাঙ্‌ক্তেয়’। কেননা তিনি প্রথাগত শ্রেণিকক্ষ-সংস্কৃতির অংশ হতে পারেননি কখনো। আফসোস! আজও শিক্ষার চিন্তাপদ্ধতির এ নীতিবোধই সমাজ ও রাষ্ট্রকে খামচে ধরে রেখেছে।

বলাবাহুল্য, শ্রেণিবিভক্ত সমাজে শিক্ষা মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্তের কাছে শৌখিন কোনো বিষয় নয়। এ হলো তার অর্থ উপার্জন ও ‘গাড়ি-ঘোড়ায় চরা’র দরজা। শিক্ষা গ্রহণ তাই তার কাছে বিনিয়োগ। ফলে প্রতি-ঔপনিবেশিক লড়াইয়ের স্বার্থেই প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থাকে মহিমান্বিত করার খুব প্রয়োজন নেই। জ্ঞানার্জন নয়, এ ব্যবস্থা বড়জোর প্রচলিত বাজারব্যবস্থায় পকেট ভারী করার হাতিয়ারমাত্র। বাংলাদেশে যার চরম পরিণতি দেখা যায়, উচ্চশিক্ষা সমাপনের ইতিকথায়। 

বাজার ও তার বিষবৃক্ষ

বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) তার উচ্চশিক্ষার ২০ বছর মেয়াদি (২০০৬-২০২৬) কৌশলপত্র প্রণয়ন করেছিল বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে। এই কৌশলপত্রের পথ ধরেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ঢুকে গেল ‘হেকাপ’ নামের এক লোভনীয় প্রকল্প। এটি সেই কৌশলপত্র, যেখানে মৌলিক তথা লিবারেল আর্টসের অনেক বিষয়ের চেয়ে বাজারে বিনিয়োগযোগ্য বিষয়ের ওপর শুধু জোরই দেওয়া হয়নি, মৌলিক বিষয়গুলো বন্ধ করারও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। 

বাজারের তেলেসমাতি এমন যে সেটা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস ও কারিকুলাম, এমনকি চিন্তাজগতেও হাত দিয়ে ফেলেছে। বিশ্ববিদ্যালয় আজ স্বেচ্ছাধীন নয়, বাজারের ইচ্ছাধীন। বাজার কী চায়, উচ্চশিক্ষাকে সে কোথায় দেখতে চায়, এর সহজ উত্তর হলো, বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠবে ঔপনিবেশিক মডেলের ভাবধারায় করণিক বা কেরানি তৈরির করাতকল। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা শিখে গেছে সাফল্যের জীয়নকাঠি লাভের সংক্ষিপ্তপন্থা (শর্টকার্টওয়ে)-সিলেবাস-ক্লাস-পরীক্ষা চুলোয় যাক, চাকরির পড়া মুখস্থ করো।

বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে বাজারের সবচেয়ে সোনার হরিণটির নাম সরকারি চাকরি। সুনির্দিষ্টভাবে বিসিএস (বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস), যা এক বিষবৃক্ষে পরিণত হয়েছে। দুঃখজনকভাবে বিশ্ববিদ্যালয় এই বিষবৃক্ষের বপনকারী ও জোগানদাতা। বাংলাদেশে মূলত যৌথভাবে ‘পাঠন ও গবেষণা’ (টিচিং অ্যান্ড রিসার্চ) বিশ্ববিদ্যালয়-ব্যবস্থা চালু আছে। এই পঠনপাঠন নামের বিশেষায়িত যন্ত্র থেকে বের হয় সম্ভাবনাময় বিসিএস ক্যাডার, আর গবেষণার মাঠ থেকে বড়জোর বের হয় একেকজন সম্ভাবনাময় ‘বে-নজির’ গবেষক!

এই তো মোটাদাগে বাংলাদেশে বিভাগ-বিভাজিত বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক উচ্চশিক্ষার বিদ্যায়তনিক অবদান, বাজারের দাসত্ব করাই যার প্রধান অভিপ্রায়! 

সাহিত্যে পড়ে ব্যাংকার, বিবিএ পড়ে ‘ক্যাডার-স্যার’

মাত্র দুই বছর আগের একটি চাঞ্চল্যকর সংবাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করি। ২০২২ সালের ৪ জুলাই জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের অধীন বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম ইনস্টিটিউট বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয়। কিন্তু প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তার পদে যোগ্য কেউ আবেদন না করায় ওই পদে পরীক্ষাই নিতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি (প্রথম আলো, ২৮ অক্টোবর ২০২২)। বাংলাদেশে গবেষণার অবস্থা এতটাই খারাপ যে সংশ্লিষ্ট পদে একজন পিএইচডিধারী গবেষক পাওয়া যায় না! 

চলমান পাঠন ও গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয় মডেলেও বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের প্রধান কাজ হলো গবেষণা করা ও গবেষক জন্ম দেওয়া। কিন্তু বাজারব্যবস্থার দাসত্বে ভরপুর স্নাতক (স্নাতকোত্তরসহ) ও অচল পিএইচডিধারী ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে চিন্তার জগৎ বদলে দেওয়ার মতো তেমন কোনো জ্ঞান উৎপাদনকারী নেই। এই স্নাতক-স্নাতকোত্তর সনদধারীরা ‘বিসিএস-জ্বরে’ আক্রান্ত, তাঁদের অগ্রজেরা আজকের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের যুগের সবচেয়ে বড় সেলিব্রিটি।

ফলে বিশ্ববিদ্যালয় পরিণত হয়েছে এমন এক কারখানায়, যেখানে ক্লাস-পরীক্ষা ও বুদ্ধিবৃত্তিক সাংস্কৃতিক চর্চার লেজেগোবরে অবস্থা। ‘দামি’ বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদের দাম যেহেতু বাজারে চড়া, ফলে প্রথম বর্ষ থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার ও আবাসিক হলগুলো ‘গাইড বইধারী’দের দখলে চলে গেছে।

এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন জ্ঞান সৃজন ও বিতরণের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে কেউ আসে না। আসে বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ট্যাগ’ (তকমা) লাগাতে। লেগে গেলে তারপর বাজারের শূলে ওঠার প্রস্তুতি নিয়ে একদিন সে ‘সফল করণিক’ ও সেলিব্রিটিতে পরিণত হয়।

একে তো বিভাগ-বিভাজিত ও বিভাগ-বিশেষায়িত উচ্চশিক্ষাব্যবস্থায় আন্তর্বিদ্যক (ইন্টারডিসিপ্লিনারি) জ্ঞানান্বেষণের পরোয়া আর নেই। সনদধারীরা বড়জোর একটা চাকরি চান, বিশেষত বিসিএস ক্যাডার হতে চান। আরও সূক্ষ্মভাবে বললে, প্রশাসন-পররাষ্ট্র-পুলিশ-কর প্রভৃতি ‘লোভনীয়’ ক্যাডার, কিংবা ধরুন, নিদেনপক্ষে ব্যাংকার হতে চান। মেডিকেল বা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়েও লক্ষ্য হলো এই ক্যাডারগুলোয় ঠাঁই পাওয়া। ফলে কলা-মানবিক-সামাজিক বিজ্ঞান কি বিজ্ঞান-বাণিজ্য-প্রযুক্তি-বিশ্ববিদ্যালয় যে অনুষদের যে বিভাগেই শিক্ষার্থীদের পড়াক না কেন, তার এই বিদ্যায়তনিক ক্রিয়াকলাপ তো একটা ব্যর্থ ব্যবস্থার আস্ফালন বৈ কিছু নয়।

সাহিত্য বা দর্শন বা ইতিহাস পড়ে যে স্নাতক ডিগ্রিধারী ব্যাংকার হন, বিবিএ বা ফার্মেসিতে পড়ে যিনি হন প্রশাসনের বড় ‘ক্যাডার-স্যার’, তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ে এতগুলো বছর পড়িয়ে জনগণের করের টাকার শ্রাদ্ধ করা ছাড়া রাষ্ট্র আর কী করছে, এই প্রশ্নের কোনো সদুত্তর পাওয়া যাবে না। কর্তৃপক্ষের কাছে এর থেকে নিদান পাওয়ারও কোনো টোটকা নেই। এটাই হলো বিভাগ-বিভাজিত পঠনকেন্দ্রিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষার ব্যর্থতা।

বিশ্ববিদ্যালয় যে গুণে-মানে স্বায়ত্তশাসিত হওয়ার কথা ছিল, মানে রাষ্ট্রীয় ও সরকারি-ক্ষমতাকাঠামোর বাইরে থেকে সে মুক্তচিন্তা করবে, সেটা তো হারিয়ে গেছেই, উল্টো তার উত্তরপ্রজন্ম সরকারি চাকরি করার দাসত্ব গ্রহণে আজ মরিয়া—মেকলে এমনটাই তো চেয়েছিলেন!

জেলায় জেলায় ‘বিশ্ববিদ্যালয়বাজি’ প্রকল্পের বিরোধিতা তাই অসাড় নয়। যে দেশে বিশ্ববিদ্যালয়-ব্যবস্থা তার মৌলিক বিদ্যায়তনিক কর্তব্য পালনে প্রায় সিংহভাগ ব্যর্থ হয়েছে, সে দেশে এর খলনলচে বদলের আন্দোলন না করে, শুধু উন্নয়নবাদী বয়ান তৈরি করা অযৌক্তিক ও অর্থহীন। এই বিশ্ববিদ্যালয়-ব্যবস্থা ক্ষয়িষ্ণু, মৃতপ্রায় ও অচল। এর মৃত্যুই শ্রেয়, অনেকের কাছে এমনটা মনে হতে পারে! 

খোলনলচে বদলাতে হবে, কিন্তু কীভাবে

চলমান বাজারপ্রিয় চাকরিমুখী এই ব্যবস্থার চরম দুর্বলতা হলো, অচিরেই বিশ্ববিদ্যালয় মানসম্পন্ন শিক্ষক-সংকটে পড়বে (এখনই পড়েছে কি না, তা নিয়ে যে কেউ প্রশ্ন তুলতেই পারেন!)। প্রকৃতির নিয়মে শূন্যস্থান পূরণ করতে হবে বলে এই গাইডমুখী চাকরিপন্থী তথা বিসিএসপন্থী প্রজন্ম থেকেই কেউ না কেউ শিক্ষক (নাকি উন্নত চাকুরে?) হবেন। 

‘উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত’ এ প্রজন্মের প্রায় সিংহভাগ যখন গবেষণার জন্য অপরিহার্য তত্ত্ব, ফেমওয়ার্ক কিংবা দর্শনকে বোঝাপড়া করার চেয়ে ‘তথ্যবাজ’ হওয়াই অধিকতর শ্রেয় মনে করে, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের মৌলিক ধারণা তাদের কাছে কীভাবে নিরাপদ থাকবে, ভাবতে পারছেন কি?

একে তো বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের পদ্ধতি ও প্রক্রিয়াটি ভয়ানক দুর্বল ও ত্রুটিযুক্ত। উপরন্তু এই তথ্যবাজ-অধ্যুষিত নবাগত সংকটটি উচ্চশিক্ষাকে এক বিপর্যস্ত অচলায়তনে বাক্সবন্দী করে ফেলবে। প্রকৃত অবস্থা এতই করুণ-কাতর যে, তা আলাদা সমালোচনা ও মনোযোগ দাবি করে।

এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, একটি রাষ্ট্র ও তার উচ্চশিক্ষা-ব্যবস্থা এতটাই দীনহীন হয়ে পড়েছে যে শুধু শিক্ষার্থীদের দায় দিয়ে পাড় পাওয়া যাবে না। রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসক ও শিক্ষকদের তুলনারহিত আন্তরিকতার অভাব, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, দলবাজি, বিদ্যায়তনিক দস্যুপনা ও অসততা শিক্ষার্থীদের এমন তথ্যবাজ হতে বাধ্য করেছে।

শিক্ষার্থীরা বাজারে নিজেদের বিক্রি করার লড়াইয়ে নেমেছেন। কেননা তাঁরা জেনে গেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়-ব্যবস্থায় তাঁদের আর কোনো নিরাপদ জায়গা নেই, যেখানে তাঁরা নিঃসংশয়ে নিরপেক্ষভাবে মূল্যায়িত ও সমাদৃত হবেন। এ রকম অবস্থায় উন্নয়ন মার্কা ‘বিশ্ববিদ্যালয়বাজি’ ও উচ্চশিক্ষার কাঠামোগত এই সংকট থেকে আমাদের মুক্তির পথ একটাই—চলমান কাঠামোর খলনলচে বদলে ফেলা।

পরের লেখায় এই খোলনলচে বদলে ফেলার জন্য একটি ইশতেহার তুলে ধরার আশা রাখি। 


ড. সৌমিত জয়দ্বীপ সহকারী অধ্যাপক, স্কুল অব জেনারেল এডুকেশন, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়।