মতামত

ছাত্রলীগের অপরাধে বহিষ্কার কি শাস্তি নাকি পুরস্কার

গত মাসে ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেনের সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় তিনি খুব স্মার্টলি ছাত্রলীগের নেতিবাচক ভাবমূর্তির দায়টা সংবাদমাধ্যমের ওপর চাপিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর ভাষ্য হলো, ছাপা পত্রিকা, টেলিভিশন কিংবা অনলাইনগুলো ছাত্রলীগের ইতিবাচক কোনো ঘটনাকে সংবাদ হিসেবে মূল্য দেয় না। যত দিন পর্যন্ত সেটা না দেবে, তত দিন পর্যন্ত এ ধরনের ‘রাজনৈতিক দুর্ঘটনা’ ঘটতে থাকবেই।

সাদ্দাম হোসেনের সাক্ষাৎকার নেওয়ার পর এক মাস পেরিয়ে গেছে। কিন্তু এই এক মাসে ছাত্রলীগ নিয়ে যে পরিমাণ খবর সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে, সেটা আর কথিত ‘রাজনৈতিক দুর্ঘটনার’ পর্যায়ে নেই, রাজনৈতিক বিপর্যয়ের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। সংগঠনের কোনো পর্যায়ে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ছিটেফোঁটা নিয়ন্ত্রণ আছে কি না, এটাই এখন একমাত্র প্রশ্ন।

সম্প্রতি ভিন্নমত চর্চা করে—এমন অভিযোগ তুলে শিক্ষার্থীদের পিটিয়ে আইসিইউতে পাঠানো, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, ছাত্রলীগ নেত্রীদের অনুমতি না নিয়ে হলে ওঠায় নবীন শিক্ষার্থীকে নির্যাতন ও বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ, নাগরিকদের মারধর, হেনস্তা ও যৌন নিপীড়নের মতো ভয়াবহ অপরাধে জড়িয়ে পড়ার খবর ছাত্রলীগ নিয়ে হয়েছে। শুধু নেতিবাচক ঘটনা নয়, এর সব কটিই সুস্পষ্ট ও গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ। এ ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের এত বেশি খবর সংবাদমাধ্যমের পাতা সয়লাব হয়ে পড়েছে যে নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হচ্ছে ছাত্রলীগ। সংবাদমাধ্যমে একের পর এক বিবৃতি পাঠিয়ে অপরাধে জড়িত নেতা–কর্মীদের বহিষ্কারের খবর জানানো হচ্ছে। কিন্তু পরিস্থিতি এতটাই শোচনীয় যে সংগঠন থেকে এ ধরনের বহিষ্কারাদেশ কাউকেই অপরাধে জড়িয়ে পড়া থেকে নিবৃত্ত করতে পারছে না।

১৩ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোর খবরে জানা যাচ্ছে, এ ধরনের ৯টি ঘটনায় ২১ নেতা-কর্মীকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে ছাত্রলীগ জানিয়েছে, সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সংগঠনবিরোধী, শৃঙ্খলাপরিপন্থী, অপরাধমূলক এবং সংগঠনের মর্যাদা ক্ষুণ্নকারী কার্যকলাপে জড়িত থাকার অপরাধে তাঁদের বহিষ্কার করা হয়েছে। এরপর ১৪ ফেব্রুয়ারি আরও তিনজনকে বহিষ্কার করা হয়।

বিবৃতিতে একটি ভিন্ন বিষয় নজরে এসেছে। বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ কর্তৃপক্ষ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে এসব ঘটনায় পদক্ষেপ বা ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছে ছাত্রলীগ। অপরাধে জড়িত নেতা–কর্মীদের সংগঠন থেকে বহিষ্কারের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজ কর্তৃপক্ষ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে ব্যবস্থা নেওয়ার যে দাবি জানিয়েছে ছাত্রলীগ, সেটিকে  স্বাগত জানাই। কিন্তু অতীতে এ রকম বহু নজির আছে, ঘটনাকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য অভিযুক্ত নেতাকর্মীদের বিবৃতি দিয়ে বহিষ্কার করা হয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এলে বহাল তবিয়তে তাঁদের প্রত্যাবর্তন ঘটেছে। ফলে অপরাধের বিপরীতে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের বহিষ্কার শেষ পর্যন্ত শাস্তি না হয়ে পুরস্কারই হয়ে উঠেছে।

গত সাত দিনে ছাত্রলীগ যে অপরাধ ও অপকর্মের কারণে প্রথম আলোর শিরোনাম হয়েছে, তার কয়েকটি একনজরে দেখে নেওয়া যাক:  ‘ইবির হলে ছাত্রীকে সাড়ে ৪ ঘণ্টা আটকে রেখে নির্যাতন’, ‘ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে পরীক্ষার হল’, ‘ছিনতাই, মারধর, হেনস্তা, চাঁদাবাজি: ৯ ঘটনায় ছাত্রলীগের ২১ নেতা-কর্মীকে বহিষ্কার’, ‘চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ: নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দ্বন্দ্ব, শিকার সাধারণ ছাত্র’, ‘চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ: টর্চার সেলে চার ছাত্রকে নির্যাতন’, ‘ছাত্র অধিকারের মিছিলে ছাত্রলীগের হামলা’, ‘সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দম্পতিকে মারধর ও স্বর্ণালংকার ছিনতাই: ছাত্রলীগের দুই নেতাকে বহিষ্কার’, ‘শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়: ছাত্রলীগ নেতাকে আরেক নেতার সমর্থকদের বহিষ্কার’, শহীদ মিনার এলাকায় মারধর ও ছিনতাই: সূর্য সেন হল শাখা ছাত্রলীগের সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা’।

এর মধ্যে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী নির্যাতনের যে ঘটনা ঘটেছে, তার নিষ্ঠুরতা রীতিমতো শিউরে ওঠার মতো। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির মাত্র কয়েক দিনের মাথায় ছাত্রলীগ নেত্রীদের অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এক ছাত্রী। নেত্রীদের কথা না শোনার অভিযোগে তাঁকে সাড়ে চার ঘণ্টা ধরে নির্যাতন করা হয়। মারধর, অকথ্য ভাষায় গালাগালি ও বিবস্ত্র করে নির্যাতন করা হয়। ভয়াবহ এই নির্যাতনের ঘটনা কাউকে বললে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়। ভয়ে সেই শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে বাড়ি চলে যান।

বাংলাদেশের বাস্তবতায় একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারাটা রীতিমতো যুদ্ধ জয়। আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকার সুযোগ না পেলে বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন পূরণ করা সম্ভব নয়, সেটাও একটা ভয়াবহ অর্থনৈতিক বাস্তবতা। বাস্তবতা হলো, এ সুযোগকেই কাজে লাগিয়ে গণরুম বানিয়ে ছাত্রলীগ বা ছাত্রদলের রাজনীতি টিকে থাকে। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীটি তাঁর পরিচিত আরেক শিক্ষার্থীর কক্ষে অতিথি হিসেবে উঠেছিলেন। উঠেই যে ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মুখে তাঁকে পড়তে হয়েছে, তাতে উচ্চশিক্ষাই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এর দায় কে নেবে?

ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের  সহসভাপতি সানজিদা চৌধুরী ও তাঁর অনুসারীরা এ নির্যাতনে জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছে। অথচ নির্যাতনের শিকার শিক্ষার্থী লিখিত অভিযোগ দেওয়ার পর উল্টো তাঁর বিরুদ্ধে মানহানির অভিযোগ তুলে মিছিল করেছে। প্রশ্ন হলো, সবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ওঠা একজন শিক্ষার্থীর ঘাড়ে কয়টা মাথা আছে যে দুর্দণ্ড প্রতাপশালী ছাত্রলীগের নেত্রীদের বিরুদ্ধে ‘অহেতুক’ অভিযোগ করে বসলেন। নির্যাতনের শিকার শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবনের নিরাপত্তা কে দেবে?

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) শাখা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা ভিন্নমতের রাজনীতিতে জড়িত থাকার অভিযোগে চার শিক্ষার্থীকে ‘টর্চার সেলে’ নিয়ে গিয়ে এমন নির্যাতন করেছেন যে তাঁদের দুজনকে হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) ভর্তি করতে হয়েছিল। দুজন বাড়ি চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। রাত থেকে শুরু করে পরদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত দফায় দফায় তাঁদের ওপর নির্যাতন করা হয়।

আহত শিক্ষার্থীদের একজন ঘটে যাওয়া নির্যাতনের যে বর্ণনা দিয়েছেন, তা সংবেদনশীল কারও পক্ষেই সহ্য করা সম্ভব নয়। সহপাঠীদের সঙ্গে এতটা নিষ্ঠুর আচরণ কীভাবে কেউ করতে পারে? ‘টিউশনি থেকে আসছি বলার সঙ্গে সঙ্গে আমাকে ক্রিকেটের স্টাম্প দিয়ে আঘাত করে ইমতিয়াজ আলম। তারপর আমাকে বেঁধে ফেলে এবং সে অবস্থায় মুখে পানি ঢালতে থাকে। একপর্যায়ে নিশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলে পানি ঢালা বন্ধ করে। এরপর তালিকা ধরে কয়েকজনের নাম বের করে বলে, আমরা কোথাও (রেটিনা কোচিং সেন্টার) ক্লাস নিই কি না? আমি আমারটা উত্তর দিলাম, না। অন্যদেরটা জানি না। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় স্টাম্প, প্লাস্টিকের পাইপ, কাঠের তক্তা—এসব দিয়ে মারপিট। একপর্যায়ে মাটিতে শুয়ে পড়লে দুই মিনিট চেয়ারে বসিয়ে পানি খাওয়ানো হয়। এরপর আবার জয়েন্টগুলোয় স্টাম্প দিয়ে আঘাত করতে থাকে।’ আহত শিক্ষার্থীদের ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিতে হয় যে আরেকটি আবরাব ফাহাদ ট্র্যাজেডির পুনরাবৃত্তি হয়নি।

এ ঘটনার ক্ষেত্রেও শুধু মেরে আইসিইউতে পাঠানোর পরও কোনো অনুশোচনা দেখা যায়নি নির্যাতনে জড়িতে ছাত্রলীগ নেতাদের; বরং আইসিইউ থেকে মর্গে পাঠানোর হুমকি তাঁরা দিয়েছেন।

ছাত্রলীগ সভাপতির সঙ্গে আলাপকালে তিনি দাবি করেছিলেন, নেতা-কর্মীদের অপকর্মের ব্যাপারে সংগঠন জিরো টলারেন্স অবস্থানে রয়েছেন। কিন্তু সংগঠনটির নেতা–কর্মীরা যেসব ভয়ংকর অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন, শিক্ষার্থীদের যে নিষ্ঠুর নির্যাতন করছেন, তাতে এই বক্তব্যের আদৌ কি কোনো যৌক্তিকতা আছে? কতটা আন্তরিক, তা প্রমাণের একমাত্র মাপকাঠি হতে পারে, যদি অপরাধের সঙ্গে জড়িত নেতা-কর্মীদের তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে সোপর্দ করে। ক্যাম্পাসগুলোয় ছায়া প্রশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে যে একচ্ছত্র বা দোর্দণ্ড ক্ষমতার প্রতাপ ছাত্রলীগ প্রদর্শন করে চলেছে, তাতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা আদৌ রাখে?

  • মনোজ দে প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী