‘এই ইলিশ পুলিশও কিনছে, স্যার!’

ইলিশ মাছ
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

এ বছর বর্ষাকাল অনেকটা বৃষ্টিহীন কেটে যাচ্ছে। কিছু জেলা ছাড়া অন্যান্য জায়গায় অতি কম বৃষ্টির কারণে কৃষকেরা রোপা আমন ধানের চারা লাগাতে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করছেন। পানির অভাবে পাট জাগ দিতে পারছেন না। বড় বড় নদীতে পানি কমে গেছে। বঙ্গোপসাগরে নদীর মোহনায় ডুবোচর জেগে উঠেছে। তাই বর্ষাকালে সাগর থেকে ইলিশ মাছ উজানের নদীতে বিচরণ করতে আসার মুখে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে বলে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত হচ্ছে। এ কারণে ইলিশের মৌসুমে দেশজুড়ে ইলিশের আকাল দেখা দিয়েছে।

গত দীর্ঘ দুই মাস নদী-সাগরে ইলিশ ধরায় সরকারি নিষেধাজ্ঞা থাকায় জেলেরা ঘরে বসে-ঘুমিয়ে কাটিয়েছেন। শেষ জুলাইয়ে এই নিষেধাজ্ঞা পার হতেই জেলেরা অতি উৎসাহে নদী-সাগরে জাল নিয়ে নেমে গেছেন। কিন্তু তাঁরা পানিতে নামতে না নামতেই হঠাৎ বৈরী আবহাওয়ার কবলে পড়ে উপকূলে ফিরতে বাধ্য হয়েছেন। পরবর্তী সময়ে আবার জাল ফেলতে গেলে আশানুরূপ মাছ না পেয়ে হতাশ হয়ে ঘরে ফিরে আসছেন। জেলেরা সামান্য পরিমাণ ইলিশ নিয়ে ঘাটে ফিরলে তার দাম হয় খুব চড়া। স্থানীয় বাজারে সেসব মাছের চাহিদা থাকলেও সেগুলো বড় বড় শহরের পাইকারেরা অগ্রিম কিনে নিয়ে আরও চড়া দামে বিক্রি করে দিচ্ছেন। এ কারণে সাধারণ মানুষ এ বছর ইলিশের স্বাদ নেওয়া দূরে থাক, চেহারা দেখারও সুযোগ পাচ্ছে না।

তবে অনেক জায়গায় ছোট ইলিশ বা জাটকা কেনাবেচা চোখে পড়ছে। নিজেদের মাছ ধরার খরচ পুষিয়ে নিতে বাধ্য হয়ে জেলেরা জাটকা শিকার করছেন। প্রতিবছর আষাঢ়ের শেষ দিকে ফেরিওয়ালারা বাড়ি বাড়ি ঘুরে বড় বড় ইলিশ ফেরি করে সস্তায় বিক্রি করতেন। কিন্তু এ বছর ইলিশের ফেরিওয়ালাদের কারও দেখা নেই। তবে তাঁদের কেউ কেউ জাটকা বিক্রি শুরু করেছেন। কাঁচাবাজারের মাছ বিক্রেতারা অনেকেই প্রকাশ্যে জাটকা বিক্রি করছেন।

সেদিন নিউমার্কেট কাঁচাবাজারে মাছের দোকানে দেখা গেল, কিছু দোকানি দীর্ঘদিন ফ্রিজে রাখা বড় দু-একটি সামুদ্রিক ইলিশ নিয়ে বিষণ্ন মনে বসে আছেন। সেগুলোর দামও অনেক বেশি। কেজিপ্রতি দাম হাঁকছেন ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার টাকা। কারও কাছেই নদী থেকে আহরিত নতুন মৌসুমি ইলিশের জোগান নেই। তবে তাঁদের অনেকের কাছে ডালিভর্তি জাটকা। কেউ ডালির মুখ অর্ধেক খুলে রেখেছেন, কেউ পুরোটাই খুলে পলিথিনে বিছিয়ে রেখে হাঁকডাক করে বিক্রি করছেন।

বাজারে প্রকাশ্যে জাটকা বিক্রির হাঁকডাক শুনে মনে হলো, এর নিষেধাজ্ঞা বুঝি তুলে নেওয়া হয়েছে। কৌতূহলবশত একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম, ইলিশের মৌসুমে জাটকা বিক্রি করছেন কেন? এত জাটকা কোথায় পেলে? তার ঝটপট উত্তর, ‘এ বছর নদীতে ইলিশ নেই। জেলেরা নদী থেকে ফিরে আসার আগে ট্রলারের তেলের দাম ও মৎস্যশ্রমিকদের খরচ মেটানোর জন্য ঘানিজাল দিয়ে জাটকা শিকার করে এনে গোপনে বিক্রি করছে। কী করবে বলুন? উপায় নেই তো!’

বললাম, ‘আপনাদের তো খুব সাহস! এত বড় বাজারে খোলা জায়গায় বসে জাটকা বিক্রি করছ, কেউ বাধা দিচ্ছে না? মৎস্য বিভাগ বা পুলিশের লোক তোমাদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে না?’

তার উল্টো উত্তর এবার। বলল, ‘ফ্রিজে রাখা এক বছরের বাসি হওয়া সামুদ্রিক ইলিশের চেয়ে নদীতে ধরা এসব জাটকার স্বাদ বেশি, তাই চাহিদা বেশি। বড় সাহেবরা গাড়ি চড়ে এসে এসব জাটকা ব্যাগভরে কিনে নিচ্ছে, স্যার! কেউ কেউ আমার ফোন নম্বর নিয়ে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসতে বলছে। আমার পুলিশের ভয়ডর লাগে না। তারাও আমার ক্রেতা। আমার কাছে এই ইলিশ পুলিশও কিনছে, স্যার!’

একদিকে ভয়ংকর ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে গৃহীত নিষেধজ্ঞা কর্মসূচি অবজ্ঞা করে একশ্রেণির মানুষ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে জরিমানা গুনছেন, অন্যদিকে জাটকা বিক্রেতারা বলছেন আরেক উল্টো কথা। আমাদের দেশে ছোট-বড়, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ধনী-দরিদ্র সবাই নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে অসহিষ্ণু ও কার্যত বেপরোয়া হয়ে গেলে ইতিবাচক সামাজিক পরিবর্তনের বাহক ও ধারক হবে কে বা কারা? সর্বক্ষেত্রে এমন নেতিবাচক সামাজিক পরিবর্তন ঘটতে থাকলে তার দায়ভার নিতে কে এগিয়ে আসবে? তা না হলে বর্ষাকালে ইলিশ-খিচুড়ি খাওয়ার ইচ্ছার মতো সামান্য ‘শখ’ সর্বসাধারণের কাছে অধরাই থেকে যাবে।

বহুদিন ধরে বাজারে যাওয়ার সুযোগ পাই না। নিউমার্কেটে একটি দোকানে কিছু কাজ ছিল। তাই সেখানে গিয়েছিলাম। তবে তার আগের ঘটনা ছিল এ রকম।

সেদিন সকাল থেকে আকাশটা মেঘলা। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। তবে বেশ গুমোট ভাব ও গরম পড়েছে। ঘরের ভেতরে সেটা অনুভব করতে পারিনি। নাশতা সেরে দ্রুত অফিসে গিয়ে একটি সেমিনারে যাওয়ার তাড়া রয়েছে। এর মধ্যে নাশতার টেবিলে বললাম, বর্ষাকাল চলে যাচ্ছে, আজ আবহাওয়াটা মনে হয় খিচুড়ি খাওয়ার মতো!

আমার কথাটা শেষ না হতেই আমার গিন্নিরও ঝটপট উত্তর শুনতে হলো। গৃহকর্ত্রী বলল, ‘আজ আমার অফিসেও ব্যস্ততা আছে। তুমি একটু আগেভাগে এসে খিচুড়িটা উঠিয়ে দিয়ো। ফ্রিজ থেকে একটা ইলিশ বের করে কেটে লবণ-হলুদ মেখে ম্যারিনেট করে রেখো। আমি রাতে খাবারের আগে ফ্রাই করে দেব। আজ ডিনারে ইলিশ-খিচুড়ি হবে। বড় মেয়েকে জামাইসহ খেতে আসতে বলে দেব। কথাটা মনে রেখো কিন্তু!’ গৃহকর্ত্রী জানে আমি খিচুড়িটা ভালো রাঁধতে পারি। বিদেশে পড়াশোনা করার সময় আমরা দুজন ভাগাভাগি করে রান্না করে খেতাম।

তখন ওই পর্যন্তই। দুপুরে অফিসে ফোন পেলাম। গৃহকর্ত্রী বলল, ‘বাসার ফ্রিজে মনে হয় বড় ইলিশ নেই। তুমি নিউমার্কেটের কাজ সেরে ফেরার পথে দুটো ভালো ইলিশ নিয়ে এসো।’

কিন্তু বাজারে গিয়ে মাছওয়ালা আমাকে জাটকা কেনার জন্য পীড়াপীড়ি করায় কী করব তা ভেবে পাচ্ছিলাম না। অগত্যা ফ্রোজেন সামুদ্রিক ইলিশ কিনে বাসায় ফিরলাম।

দেশে ইলিশের বড় সংকট চলছে। কিন্তু একশ্রেণির মানুষের কাছে সেটা কোনো সমস্যা নয়। সর্বসাধারণের কেনার জন্য আমাদের দেশে খোলা কাঁচাবাজারে সস্তা ইলিশ নেই। কিন্তু সুপারমার্কেটে বিত্তশালীদের জন্য উচ্চমূল্যে ইলিশ বিক্রির সুব্যবস্থা রয়েছে। এসব বিত্তশালীর ইশারায় সাগর-নদী থেকে বড় ইলিশ আহরণ করার আগেই অগ্রিম বেচাকেনার নিয়ম চালু হয়েছে। বাংলাদেশে যখন ইলিশ আহরণে নিষেধাজ্ঞা চলে এবং দরিদ্র জেলেরা বাড়িতে অলস সময় পার করে, তখন আমাদের গভীর সাগরের মাছ প্রতিবেশী দেশের জেলেরা বিদেশি বড় বড় জাহাজ এসে ধরে নিয়ে যায়। যে দামে আমাদের ইলিশ কিনে খেতে হয়, প্রতিবেশী দেশের বাজারে তার চেয়ে সস্তায় ইলিশ বিক্রি হয়।

ইলিশ নিয়ে এত গবেষণা, সরকারি পরিকল্পনা ও বিধিনিষেধ বলবৎ থাকার পরও খোলাবাজারে জাটকা বিক্রি হয় কীভাবে? বাজারের ক্ষুদ্র মাছ বিক্রেতার কথা যদি সঠিক ধরে নেওয়া হয়, তাহলে সরকারি লোকেরাও সরকারি নিষেধাজ্ঞা বা মোটিভেশন অবজ্ঞা করেন কেন?

একদিকে ভয়ংকর ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে গৃহীত নিষেধজ্ঞা কর্মসূচি অবজ্ঞা করে একশ্রেণির মানুষ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে জরিমানা গুনছেন, অন্যদিকে জাটকা বিক্রেতারা বলছেন আরেক উল্টো কথা। আমাদের দেশে ছোট-বড়, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ধনী-দরিদ্র সবাই নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে অসহিষ্ণু ও কার্যত বেপরোয়া হয়ে গেলে ইতিবাচক সামাজিক পরিবর্তনের বাহক ও ধারক হবে কে বা কারা? সর্বক্ষেত্রে এমন নেতিবাচক সামাজিক পরিবর্তন ঘটতে থাকলে তার দায়ভার নিতে কে এগিয়ে আসবে? তা না হলে বর্ষাকালে ইলিশ-খিচুড়ি খাওয়ার ইচ্ছার মতো সামান্য ‘শখ’ সর্বসাধারণের কাছে অধরাই থেকে যাবে।

ড. মো. ফখরুল ইসলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের শিক্ষক। ই-মেইল: fakrul@ru.ac.bd