মতামত

শ্রীলঙ্কায় তামিল, মুসলিম ও সিংহলিদের জাতীয় ঐক্য কতটা সম্ভব?

২০২২ সালে গোতাবায়ে রাজাপক্ষে বিরোধী আন্দোলনে সিংহলিদের পাশাপাশি তামিল ও মুসলিম জনগোষ্ঠীও অংশ নিয়েছিল
ছবি : রয়টার্স

শ্রীলঙ্কা জাতীয় সমঝোতার জন্য কর্মপরিকল্পনার খসড়া তৈরি করছে। জুনের প্রথম ভাগে শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রপতি রনিল বিক্রমাসিংহে সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরগুলোকে এই কাজের গতি বাড়ানোর নির্দেশনা দিয়েছেন। শ্রীলঙ্কার সিংহলি, তামিল ও মুসলমানরা যে ধরনের শান্তি ও স্থিতিশীলতা চান, তার প্রতিফলন ঘটবার কথা রয়েছে এই কর্মপরিকল্পনায়। লিবারেশন টাইগারস অব তামিল ইলম (এলটিটিই) ও শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনীর মধ্যে তিন দশক ধরে চলা গৃহযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে তামিল জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্কে এখনো একটা চাপা উত্তেজনা আছে সিংহলিদের। কর্মপরিকল্পনা এই জায়গায় এসে হোঁচট খাচ্ছে।

গত ১৯ মে শ্রীলঙ্কা শারীরিক ও মানসিক বিপর্যয় সমাপ্তির ১৪ বছরে পা রাখল। ২০০৯ সালের এই সময়ে সামরিক বাহিনী এলটিটিইকে হারিয়ে দিয়ে বন্দুক ও বোমার আওয়াজ থামিয়ে দিয়েছিল। সিংহলিরা এই দিনকে সামরিক বাহিনীর বিজয় হিসেবে উদ্‌যাপন করে, বীরযোদ্ধাদের স্মরণ করে। আর তামিলরা এ দিনকে শোকের দিন বলে বিবেচনা করে। দেশটির উত্তরাংশে প্রকাশ্যে শোক করায় সরকারি নিষেধাজ্ঞা আছে। পাছে এ ধরনের কর্মসূচিতে এলটিটিইর বন্দনা হয়।

৯ জুন এক বৈঠকে প্রেসিডেন্ট বিক্রমাসিংহে আইন, প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম, ভূমি, কারাবন্দীদের মুক্তি ও শক্তির বিকেন্দ্রীকরণ—এই পাঁচ ক্ষেত্রে অগ্রগতি চাইছেন। অর্থনৈতিক সংকটের কারণে গত জুলাইতে প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষের পতন হয়। এরপর থেকে দেশটিতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হচ্ছে। বৈদেশিক বিনিয়োগ শ্রীলঙ্কার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সেদিক থেকে শক্তিশালী এ ধনবাদ তামিল অভিবাসীদের আকৃষ্ট করতে পারলে অর্থনৈতিক সংকট থেকে পুনরুদ্ধার পাওয়া সহজ হতে পারে বলে ধরে নিচ্ছেন অনেকে। এই তামিলরা ১৯৮৩ সালের জুলাইয়ে তামিলবিরোধী দাঙ্গায় দেশ ছেড়েছিলেন। কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র ও সুইজারল্যান্ডের মতো অর্থনৈতিক শক্তির দেশে অভিবাসন, বিনিয়োগনির্ভর প্রকল্পে অর্থায়নের ক্ষমতা থাকার পরও অনেক তামিল শ্রীলঙ্কায় ফিরতে ভয় পান। তাঁরা এলটিটিটির সমর্থক বলে বিবেচিত হতে পারেন এই শঙ্কায় ভোগেন।

সিংহলি বুদ্ধিজীবীদের একাংশ এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। তাঁরা মনে করেন, এতে করে তামিলদের হারিয়ে এ অঞ্চলে যে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তা খর্ব হবে। দেশ ভেঙে যাবে। তামিলরা আবার এ কথার বিরোধিতা করে বলছেন, তাঁরা বিচ্ছিন্ন হতে চান না, তাঁরা চান স্বায়ত্তশাসন। সিংহলিদের মতো হলো, শ্রীলঙ্কায় কখনো জাতিগত বিদ্বেষ নিয়ে সমস্যা ছিল না। ছিল সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বিচ্ছিন্নতাবাদের সমস্যা। অন্যরা মনে করেন, সবার জন্য সমানাধিকার নিশ্চিত করা যায়নি বলেই সন্ত্রাসবাদের পুনরুত্থান ঘটছে।

চার দশক আগে শ্রীলঙ্কা ছেড়েছেন শিভারাজা (ছদ্মনাম)। তিনি বলেন, ‘আমি যখন দেশ ছেড়েছিলাম, তখন আমার বয়স ১৮। আমার পরিবারের বাকি সদস্যদের গুলি করে হত্যা করা হয়। যদিও আমি এখন একজন নামকরা প্রকৌশলী এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিনিয়োগ করেছি, আমি শ্রীলঙ্কায় ফিরতে চাই না।’ শিভারাজার মতো অভিবাসী তামিলদের অনেকেরই শ্রীলঙ্কার তুলনায়, যে দেশে এখন তাঁরা বসবাস করছেন, সে দেশের প্রতি আনুগত্য বেশি। আবার অনেকে আছেন যারা শ্রীলঙ্কায় ফিরে গেছেন এবং নাগরিকদের মধ্যে জাতিগত যে বিভেদ তা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছেন। তাঁরা মনে করছেন, তাঁদের এই উদ্যোগ নীতিনির্ধারকদের প্রভাবিত করবে। তামিলদের কাউকে কাউকে শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনীর সমর্থক, আবার কাউকে কাউকে এলটিটিইর সমর্থক বলে অভিযোগ করা হয়।

যদিও সহিংসতার ইতি ঘটেছে, অপেক্ষাকৃত অল্পবয়স্ক মানুষেরা দেশে ফেরার পক্ষে কোনো যুক্তি খুঁজে পান না। তাঁরা শান্তি প্রতিষ্ঠার কোনো উদ্যোগে যুক্ত হওয়ার তাগিদও অনুভব করেন না। তবে তামিলদের মধ্যে যাঁরা অপেক্ষাকৃত প্রবীণ, তাঁদের আবেগকে কাজে লাগিয়ে দেশে ফেরানোর চেষ্টা চলছে। ড. ভেলাওথাম সার্ভেসওয়ারান শ্রীলঙ্কা এবং যুক্তরাজ্যের দ্বৈত নাগরিক। তিনি পেশায় একজন প্রকৌশলী এবং স্বপ্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। ভেলাওথাম আশির দশকের প্রথম ভাগ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত তীব্র সহিংসতা ও রক্তপাতের প্রত্যক্ষদর্শী। তিনি তাঁর বোন ও পরিবারের অন্য সদস্যদের হারিয়েছেন।

বর্তমান নেতৃত্বের রাজনৈতিক বিবৃতি ঘনিষ্ঠভাবে অনুসরণ করলেও এই প্রকৌশলী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নন। তবে তিনি জাতীয় সমঝোতা নিশ্চিতে তাঁর ভূমিকাটুকু রাখতে চান। সে কারণে তিনি আন্তর্জাতিক নানা দাতা সংস্থার মাধ্যমে পয়োনিষ্কাশন, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য খাতে ব্যয়ের জন্য তহবিল সংগ্রহ করে থাকেন। এই তহবিল সিংহলি ও তামিল নাগরিকদের জন্য ব্যয় হয়। তিনি শ্রীলঙ্কা সরকারের ভিশন-২০২০ নামের যে চোখের যত্নবিষয়ক নীতি আছে, তা বাস্তবায়নেও সহযোগিতা করেছেন। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধিতা রোধে এই কর্মসূচি ২০১০ সালে চালু হয় এবং শেষ হয় ২০১৬ সালে ।  

ভেলাওথাম এখন অনুরাধাপুরা অঞ্চলের বৌদ্ধ ভিক্ষুদের কাছে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন। এই খরাপ্রবণ অঞ্চলে কীভাবে খাবার ও কৃষিকাজে পানি সরবরাহ করার প্রকল্প নেওয়া যায়, তা নিয়ে তিনি তাঁদের (বৌদ্ধ ভিক্ষু) সঙ্গে আলোচনা করতে চান। অনুরাধাপুর ঐতিহ্যগতভাবে বৌদ্ধদের জন্য একটি পবিত্র নগরী। সিংহলি রাজনীতিতে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকেন।

গত জুলাইতে গোতাবায়া রাজাপক্ষের পতনের পর প্রেসিডেন্ট বিক্রমাসিংহে ক্ষমতায় আসেন গত জুলাইতে। এরপর থেকেই তিনি দেশের উন্নয়ন ও দেশবাসীর মধ্যে ঐক্য ফিরিয়ে আনতে তামিলদের বিনিয়োগের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। গত ৮ মে আন্ডারস্ট্যান্ডিং সোশ্যাল চেঞ্জ—সার্ভে ডেটা অ্যান্ড পাবলিক অপিনিয়ন (সামাজিক পরিবর্তনকে বোঝা—   জরিপের উপাত্ত ও মতামত) নামের একটি অনুষ্ঠানে শ্রীলঙ্কার আইনমন্ত্রী উইজেয়াদাসা রাজাপক্ষে জাতীয় সমঝোতার মতো জাতীয় ইস্যুতে উপাত্তনির্ভর গবেষণা করতে বলেছেন। তিনি মনে করেন জনগণের মতামত বুঝতে এই গবেষণা জরুরি। উইজেয়াদাসা রাজাপক্ষে দক্ষিণ আফ্রিকায় তাঁর সাম্প্রতিক সফরের উদাহরণ টানেন। তিনি বলেন, এ ধরনের যোগাযোগ বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের সমাধান খুঁজতে সাহায্য করে। ওই অনুষ্ঠানে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।

এ বছরের জানুয়ারিতে শান্তি ও সমঝোতার পক্ষে নীতিনির্ধারকদের টানতে শ্রীলঙ্কার উত্তরে ভাভুনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ওই অনুষ্ঠানে জাতিগতভাবে সিংহলি ও রুহুনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সুজিয়া আমারাসেনা বলেন, ‘যুদ্ধে জেতা সহজ। কিন্তু শান্তি প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে জেতা কঠিন। শান্তিতে জয়ী হতে হলে সব পক্ষের অবদান প্রয়োজন। আর এই লক্ষ্যেই আমরা কাজ করব।’২০০৯ সালে গৃহযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর থেকেই সংবিধানে পরিবর্তন আনার প্রয়োজনীয়তার কথা উঠেছে বহুবার।

শ্রীলঙ্কার জাতীয় ঐক্যের সরকারের প্রধানমন্ত্রী, যিনি বর্তমান প্রেসিডেন্ট সেই রনিল বিক্রমাসিংহে ২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত নতুন একটি সংবিধানের খসড়া নিয়ে কাজ করেছেন। তামিলদের জাতীয়তা নিয়ে প্রশ্নের একটি স্থায়ী সমাধান খুঁজতে তিনি এই কাজ করেছেন। কিন্তু বহুধাবিভক্ত সিংহলি রাজনৈতিক দলের মতভেদের কারণে সাংবিধানিক সংসদ এগোতে পারেনি।

এ বছরের গোড়ার দিকে রনিল বিক্রমাসিংহে একটি বিবৃতি দিয়েছেন। তিনি বলেন, ১৯৮৭ সালে ইন্দো-লঙ্কা শান্তিচুক্তির আলোকে সংবিধানের যে ১৩তম সংশোধনী আনা হয়েছিল, সেটি বাস্তবায়িত হবে। ওই সংশোধনীতে প্রদেশগুলোকে অনেক বেশি স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হয়েছিল। তামিলরাও চাচ্ছিলেন এই স্বায়ত্তশাসন। এই চাওয়া আবার সিংহলিদের ভীত করে তুলছে। কিন্তু এই প্রসঙ্গ চুক্তি স্বাক্ষরের পর সেভাবে রাজনৈতিক পরিসরে আলোচিত হয়নি।  

সিংহলি বুদ্ধিজীবীদের একাংশ এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। তাঁরা মনে করেন, এতে করে তামিলদের হারিয়ে এ অঞ্চলে যে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তা খর্ব হবে। দেশ ভেঙে যাবে। তামিলরা আবার এ কথার বিরোধিতা করে বলছেন, তাঁরা বিচ্ছিন্ন হতে চান না, তাঁরা চান স্বায়ত্তশাসন। সিংহলিদের মত হলো, শ্রীলঙ্কায় কখনো জাতিগত বিদ্বেষ নিয়ে সমস্যা ছিল না। ছিল সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বিচ্ছিন্নতাবাদের সমস্যা। অন্যরা মনে করেন, সবার জন্য সমানাধিকার নিশ্চিত করা যায়নি বলেই সন্ত্রাসবাদের পুনরুত্থান ঘটছে।

  • ফ্রান্সেস বুলাথসিংহলা শ্রীলঙ্কার লেখক ও সাংবাদিক

ইংরেজি থেকে অনুবাদ শেখ সাবিহা আলম