দেশে নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে বেশ আলোচনা চলছে। এর মধ্যে সপ্তম শ্রেণির বিজ্ঞান বইয়ের বেশ কিছু অংশ নিয়ে প্রশ্ন এসেছে। কোনো রকম রেফারেন্স ছাড়া অনলাইন সোর্স থেকে সরাসরি বইয়ের একটা অংশের সব তথ্য তুলে দেওয়া হয়েছে। সেটাও আবার ভুলভাল অনুবাদ করা হয়েছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গিয়েছে। এ ছাড়া অন্য বইগুলোর নানা তথ্য নিয়ে অসংগতি পাওয়া গিয়েছে বলেও গণমাধ্যমে খবর বের হয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গে যাঁরা জড়িত ছিলেন, তাঁদের মধ্যে দুজন এই দায় স্বীকার করেছেন এবং বলেছেন, ভবিষ্যতে তাঁরা সতর্ক হবেন, যাতে এমন ভুল আর না হয়।
তাঁরা দায় স্বীকার করেছেন, এটি ভালো কথা। কারণ, বাংলাদেশে তো কেউ ভুল করলে সেটা স্বীকারও করতে চায় না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, শুধু ভুল স্বীকার করলেই কি চলছে? আজ হঠাৎ চিড়িয়াখানার সেই পাখির কথা আবার মনে হচ্ছে। এর আগে এ নিয়ে একটা লেখা লিখেছিলাম। আজ আবার লিখতে ইচ্ছা করছে। উত্তর-পূর্ব ইউরোপের দেশ এস্তোনিয়ার একটা পত্রিকায় মাস কয়েক আগে এ পাখি নিয়ে শিরোনাম হয়েছিল।
চিড়িয়াখানায় হর্নবিল ডেন্ডি পাখিটি একটি কয়েন গিলে মারা গিয়েছে। পাখিটির অবস্থা খারাপ হওয়ার পর চিকিৎসকেরা সেটিকে বাঁচাতে পারেননি। পরীক্ষা-নিরীক্ষার করে দেখা যায়, পাখিটির শরীরে একটি ‘বস্তু’ প্রবেশ করেছিল। ময়নাতদন্তে পাখিটির শরীরে কয়েন পাওয়া গিয়েছে। যার কারণে পাখিটির শরীর ঠিকমতো কাজ করছিল না এবং তার বেদনাদায়ক মৃত্যু হয়েছে।
এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বলা হচ্ছে, অনেক সময় পাখিরা নিজেদের খাবার নিজেরা জোগাড় করতে গিয়ে ভুল বুঝে কয়েন গিলে ফেলতে পারে। চিড়িয়াখানার কর্তৃপক্ষ বলছে, এটি হয়তো স্রেফ একটি দুর্ঘটনা। কিন্তু দেশটির সরকার এবং অন্যান্য সংস্থা এটি মানতে নারাজ। তারা চাইছে সঠিক তদন্ত। তারা জানতে চাইছে, কেউ উদ্দেশ্যমূলকভাবে পাখিটির সামনে কয়েন ছুড়ে মেরেছিল কি না? যদি মেরে থাকে, চিড়িয়াখানার লোকজন কেন সঙ্গে সঙ্গেই সেটি সরিয়ে ফেলেনি। প্রশ্ন হচ্ছে, কয়েনটি সেখানে গেল কী করে! তা ছাড়া সবাই এখন ভয়ানকভাবে চিন্তিত তার সঙ্গীকে নিয়ে। তার সঙ্গীও চিড়িয়াখানায়ই থাকে। সে নাকি এখন নিজেকে একাকী মনে করছে।
এমন পরিস্থিতিতে ওই চিড়িয়াখানার পাখিদের দায়িত্বে থাকা সবাই নিজ থেকেই যাঁর যাঁর পদ থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। পদত্যাগ করে তাঁরা বলেছেন, এই পদে থাকার নৈতিক অধিকার তাঁরা হারিয়েছে। একটি পাখির মৃত্যুর জন্য তাঁরা সবাই পদত্যাগ করে বসলেন। এ নিয়ে সরকার তদন্ত কমিটি করেছে। চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ যদি কোনো ভুল করে থাকে, তাদের যেন সঠিক শাস্তির আওতায় আনা যায়।
আর আমাদের দেশে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা যে বই পড়ে বড় হবে, যে বই পড়ে তারা দেশ এবং সমাজের দায়িত্ব নেবে, সেই বইগুলো নানা রকম অসংগতি তুলে ধরার পর দায়িত্বে থাকা মানুষ কিনা স্রেফ দায় স্বীকার করেই নিজেদের দায় সারছেন! কেন আপনাদের মনে হচ্ছে না, এটি একটি অপরাধও? কেন আপনারা নিজ থেকেই সরে দাঁড়াচ্ছেন না? দায়িত্বে অবহেলার জন্য কেন আপনাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া কিংবা তদন্ত হবে না?
সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের অনেককে প্রায় সময়ই বলতে শোনা যায়, আমাদের রাজনীতিবিদেরা দায় স্বীকার কিংবা ভুল করলে পদত্যাগ করেন না। এ চর্চা নাকি আমাদের দেশে নেই। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা নিজেরা কি আদৌ সেই চর্চা করেন? নাকি তাঁরা ভুলত্রুটির ঊর্ধ্বে উঠে গিয়েছেন? তাহলে আমাদের পথ দেখাবে কারা? পদে থেকে আপনারা আপনাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেননি। সেটি আপনাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার পর আপনারা স্বীকার করেছেন—ভুল হয়েছে। তাহলে তো আপনাদের সেই দায়িত্বে থাকা উচিত নয়। আপনারা যে ভবিষ্যতে আপনাদের কাছে দেওয়া দায়িত্বগুলো সঠিক ভাবে পালন করবেন, সেই নিশ্চয়তা কি করে আপনারা দেবেন?
ড. আমিনুল ইসলাম জ্যেষ্ঠ প্রভাষক, এস্তোনিয়ান এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ ইউনিভার্সিটি। ই-মেইল: tutul_ruk@yahoo.com