মঞ্জুর হত্যার দায় নিয়ে সামরিক আইন প্রশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ নয় বছর দেশ শাসন করেছেন। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের গোত্র পিতার মতো ‘হেমন্ত’ আনেন রাজপ্রাসাদ। তিন জোটের রূপরেখা ও জনগণের সম্মিলিত ত্যাগে বাংলাদেশ স্বৈরাচারমুক্ত হয়।
তবু এরশাদ অপসারিত হলে রংপুর বিভাগ জাতীয় পার্টির ঘাঁটি হয়ে ওঠে। রংপুরের কিংবদন্তি রাজনীতিবিদ আফজাল ক্ষমতাসীন অবস্থায় নাকি এরশাদের রংপুরে প্রবেশ ঠেকিয়েছিলেন। ক্ষমতাহীন এরশাদ রংপুরে ক্ষমতাবান এরশাদের চেয়েও শক্তিশালী হন। আফজালের রংপুর এরশাদের রংপুরে পরিণত হয়। একই ঘটনা ঐতিহাসিক চিলমারী ও মুক্তাঞ্চল রৌমারীর বেলায়ও। জাতীয় পার্টির প্রার্থী এরশাদের ভাগনে রুকুনুদ্দৌলার বাড়ি কুড়িগ্রাম শহরে। ১৯৮৬ সালের উপনির্বাচনে তিনি লাঙ্গল মার্কা নিয়ে চিলমারীর স্থানীয় জাসদ নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন ও আওয়ামী লীগ নেতা মনির উদ্দীন পাপ্পু মিয়ার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামেন। জামানত হারানোর পরিস্থিতিতে সরকারি দলের লোকেরা ভোরবেলায় সিল মেরে তাঁকে নির্বাচিত করে। অথচ ক্ষমতা হারানোর পর বামপন্থীদের ঘাঁটিগুলো জাতীয় পার্টির ঘাঁটিতে পরিণত হয়। বৃহত্তর রংপুরবাসী সব সময় বিরোধী দলকেই বেছে নেন!
কিন্তু ২০১৪ ও ২০১৮ সালে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে বাঁধা পড়ে। এই দুই টার্মে সহযাত্রী জাতীয় পার্টির দুর্গ আওয়ামী টার্গেটে পরিণত হয়। আওয়ামী লীগ রংপুরের সিট নিজে নিয়ে অন্যত্র সিট বিনিময় করে বন্ধুত্বের মর্যাদা রক্ষা করেছে! ফলে রংপুর বিভাগ তো ছাড়, জেলাতেও জাতীয় পার্টি নড়বড়ে অবস্থায়। যাঁরা সংসদ সদস্য হওয়ার জন্য জাতীয় পার্টি করতেন, তাঁদের কেউ কেউ চরমোনাইয়ের দলে ঢুকে পড়েছেন। চরমোনাইয়ের দল ইসলামি আন্দোলন বিএনপির জনপ্রিয় নেতাদেরও টোপ দিয়েছে, সেখানে বইঠা পানি পায়নি। এরশাদের ছিল অস্থিরতা ও প্রেমিকের চঞ্চলতা। তাঁর নেতাদেরও হয়তো সেভাবেই গড়ে তুলেছেন। রংপুরে বিএনপির বিশাল সমাবেশ জাতীয় পার্টির মাটি কেড়ে নিল কি না, জনমনে প্রশ্ন তৈরি করেছে।
২.
জাতীয় পার্টির ‘বৃদ্ধাশ্রম’ ও ‘অবসরপ্রাপ্তদের ক্লাবে’ তরুণ সংসদ সদস্য শামীম পাটোয়ারীরা শোভামাত্র। এরশাদের আমলে ৩০ জন মহিলা সংসদ সদস্যকে জাতীয় সংসদের অলংকার বলা হতো। তবু জাতীয় পার্টি আছে। কিন্তু কতদিন থাকবে? অথচ জিয়াউর রহমানের রাজনীতিচর্চার বয়স ছিল মাত্র চার বছরের। অথচ এত কম সময়ে গড়া বিএনপি তাঁর মৃত্যুর পর দেশের অন্যতম বৃহৎ দল। রাজনীতির পণ্ডিতেরা বলছেন, নতুন রাজনৈতিক বয়ান ও উপযুক্ত কর্মসূচির কারণেই দলটি এখনো প্রাসঙ্গিক,যে কর্মসূচি হেঁটে হেঁটে বাংলাদেশের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছিলেন জিয়া।একাকালীন বাম নেতা কাজী জাফরের পরামর্শে উপজেলা ও বর্গা আইনের মতো অর্থনীতির ক্ষেত্রে কাজ করেছেন এরশাদ। কিন্তু নতুন রাজনীতি ছিল না।
এরশাদের পর নেতৃত্বে এখন জি এম কাদের। তিনি অন্যরকম নেতা। এরশাদের একনায়কত্বে তাঁকে চেনা যায়নি। পরিবহন নেতা মসিউর রহমান ওরফে রাঙ্গার করা মামলায় দলীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাঁর ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত। এদিকে জি এম কাদের সংসদে যোগ না দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে কার্ড খেলেছিলেন। তাতে প্রথম রাউন্ডে আওয়ামী লীগ যেমন পরাস্ত হয়েছে, তেমনি মসিউরও চুপসে গিয়েছিলেন। আদালতের রায়ের পর চাঙ্গা। ি নির্বাচন পর্যন্ত জাপা কি মুঠোয় থাকবে সরকারের?
মূলত চেয়ারম্যান জি এম কাদের সংবিধান নিয়ে কয়েকটি প্রশ্ন সামনে এনে রাজনীতিতে নিজেকে ভিন্ন মাত্রায় প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর সর্বময় ক্ষমতা ও সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সংসদে। যদিও তাঁর এই অবস্থান এখনো তাত্ত্বিক স্তরে। এই দাবি নিয়ে গণতন্ত্র মঞ্চের মতো জনগণের কাছে যাওয়া এখনো দৃশ্যমান নয়। জি এম কাদের গণতান্ত্রিক সংবিধান চান, তারই দলের আরেক নেতা সংসদে ক্রসফায়ার চান, তাকি হয়? প্রশ্ন হলো, তরুণদের জন্য দরজা খোলা না রাখলে কীভাবে দল চলবে? দলে গণতন্ত্র চর্চা থাকলে তরুণ নেতৃত্ব তৈরি হতো।
শেরেবাংলা একে ফজলুল হক একই সঙ্গে মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের এবং কৃষক-প্রজা পার্টি ও মুসলিম লীগের নেতা ছিলেন। খোদ ফরিদপুরে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ জনগণ থামিয়ে দিয়েছেন শেরেবাংলার বিরুদ্ধে কথা বলায়। সেই শেরেবাংলা ব্যারিস্টার জিন্নাহর কাছে রাজনীতিতে পরাজিত হলেন। মাওলানা ভাসানী পরাজিত হলেন শিষ্য বঙ্গবন্ধুর কাছে। কেন? কেউ কেউ বলেন, তা হচ্ছে জিন্নাহর পাকিস্তান আন্দোলনের কর্মসূচি আর বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা। অর্থাৎ, উপযুক্ত কর্মসূচি, যা জাতিকে অবরুদ্ধ দশা থেকে মুক্ত করে। এই কর্মসূচি যারা গ্রহণ করবে, জাতির নিয়তি তাদের হাতেই। তা-ই ঘটেছিল।
বঙ্গবন্ধু যখন ছয় দফা নিয়ে পূর্ব পাকিস্তান চষে বেড়িয়েছেন, তখন শ্রমিক-কৃষক-বুদ্ধিজীবীদের সংগঠন তাঁর ছিল না। সব ছিল বামপন্থীদের। মেনন-মতিয়া গ্রুপের ছাত্র ইউনিয়নের তুলনায় ছাত্রলীগ ছিল ম্লান। তবু জনগণ ছয় দফার ছায়াতলে এসেছে। কারণ, তিনি জনগণ যা চায় তা নিয়ে তাদের কাছে গেছেন। সম্প্রতি রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন নামে ছোট্ট একটি সংগঠনের সাত দফা কর্মসূচি প্রথমে চারটি সংগঠন, পরে গণতন্ত্র মঞ্চ, এমনকি বিএনপিও নিয়েছে। এবি পার্টিও নিয়েছে। বছরখানেক বয়সী একটি সংগঠনের কর্মসূচি আজ রাজনীথির গুরুত্বপূর্ণ অ্যাজেন্ডায় পরিণত হয়েছে। কিন্তু জাতীয় পার্টি বিশাল সংগঠন ও একই কর্মসূচি নিয়েও পানি পাচ্ছে না। যদিও এবি পার্টিকে নিয়ে আলাদা জোট করার চেষ্টা করছে। তবু হচ্ছে না, কেন?
জি এম কাদেরের জাতীয় পার্টিকে যদি নিভতে না হয়, তাহলে আগে উপযুক্ত কর্মসূচি ঠিক করতে হবে, তারপর যেতে হবে জনগণের কাছে। আগে রংপুরে, তারপর সারা দেশে। তবে নিভে যাওয়ার বদলে জাতীয় পার্টি জাতীয় দল হয়ে উঠতেও পারে।
নাহিদ হাসান লেখক ও সংগঠক
nahidknowledge1@gmail.com