হুন্ডিওয়ালাদের কেন জেলের ভাত খাওয়ানো হবে না

বর্তমানে দেশের অর্থনীতির ‘১ নম্বর’ সমস্যায় পরিণত হয়েছে দেশ থেকে বিদেশে পুঁজি পাচার। পুঁজি পাচারের পুরোনো তিনটি প্রধান পদ্ধতি ছিল—আমদানি বাণিজ্যে ওভারইনভয়েসিং, রপ্তানি বাণিজ্যে আন্ডারইনভয়েসিং এবং রপ্তানি আয় দেশে ফেরত না এনে সেগুলো দিয়ে বিদেশে ঘরবাড়ি ও ব্যবসাপাতি ক্রয়। কিন্তু এখন এসব ছাড়িয়ে গেছে হুন্ডি পদ্ধতিতে পাঠানো প্রবাসীদের রেমিট্যান্সের বৈদেশিক মুদ্রা (প্রধানত ডলার) ক্রয়ের মাধ্যমে দেশ থেকে প্রধানত ব্যাংকঋণ বিদেশে পাচার। এই পদ্ধতিতে যেহেতু প্রবাসীদের কাছ থেকে বিদেশেই হুন্ডিওয়ালার এজেন্টরা বৈদেশিক মুদ্রা ক্রয় করে বিদেশে রেখে দেন, তাই এই বৈদেশিক মুদ্রা (প্রধানত ডলার) দেশে আসে না।

দেশের ১ কোটি ৫৫ লাখ অভিবাসীর অধিকাংশই এখন আর ফরমাল চ্যানেলে দেশে রেমিট্যান্স পাঠান না। হুন্ডিওয়ালাদের কাছে বেশি দাম পেয়ে তাঁদের কষ্টার্জিত বৈদেশিক আয় হুন্ডিওয়ালাদের বিদেশি এজেন্টের কাছে তাঁরা বিক্রি করে দিচ্ছেন বলে অকাট্য প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে।

সম্প্রতি ৭ মে, ২০২৪ তারিখে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক ‘ক্রলিং পেগ’ পদ্ধতিতে ডলারের দাম নির্ধারণ বাজারের কাছে ছেড়ে দেওয়ায় এক ডলারের দাম একলাফে ১১০ টাকা থেকে ১১৭ টাকায় নির্ধারণের সঙ্গে সঙ্গে ডলার মার্কেটে হু হু করে এক ডলারের দাম পাগলা ঘোড়ার মতো লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে কয়েক দিনের মধ্যে ১২৭ টাকায় পৌঁছে যাওয়ায় ব্যাপারটা প্রমাণিত হয়েছে (বিভিন্ন এক্সচেঞ্জ হাউসের পক্ষ থেকে বাজার থেকে ডলার উধাও হয়ে যাওয়ার অভিযোগও শোনা যাচ্ছে)। আমার ভয় হচ্ছে, ডলারের দামের এই ক্রম-উল্লম্ফন বাংলাদেশ ব্যাংক সহজে থামাতে পারবে না।

আমি বেশ কয়েকটি সাম্প্রতিক কলামে এই ভয়ই জানাচ্ছিলাম যে বাজারের হাতে ডলারের দাম ছেড়ে দিলে হুন্ডি ব্যবসার কারণে ডলারের বাজারে অস্থিরতা বেড়ে যেতেই থাকবে। এখন হাতেনাতে সেটা প্রমাণিত হওয়ায় অর্থনীতি বড় ধরনের সংকটে পড়ে গেল। ৭ জানুয়ারি, ২০২৪ দৈনিক বণিক বার্তায় প্রকাশিত আমার এ-সম্পর্কিত কলামে আমি বলেছিলাম, ‘পুঁজি পাচারের জন্য ডলারের চাহিদাকারীদের দমন না করে শুধু ডলারের দাম বাজারের হাতে ছেড়ে দিলে ডলারের দাম বাজারে যতই বাড়বে, তার চেয়ে ৫-৬-৭ টাকা বেশি দাম দিয়ে হুন্ডিওয়ালারা প্রবাসীদের কাছ থেকে বিদেশে ডলার কিনে নেবেন। কারণ, পুঁজি পাচারকারীদের কাছে তাঁদের অর্থ বিদেশে পাচার করাই মুখ্য উদ্দেশ্য।

অতএব বাজারে ডলারের দামের চেয়ে হুন্ডিতে দাম কত বেশি, সেটা তাঁদের বিবেচ্য নয়। আইনি ঝামেলা ছাড়া নিরাপদে যেহেতু পাচারকারীরা হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে অর্থ পাচার করতে পারেন, তাই হুন্ডিওয়ালার কাছ থেকে তাঁরা বেশি দামে ডলার কিনতে মোটেও অনাগ্রহী হবেন না। এর মানে, বাজারে ডলারের দাম বাড়তে থাকলেও হুন্ডি ব্যবস্থায় পুঁজি পাচার অব্যাহত থাকবে, বাজারে ডলারের একক দাম নির্ধারিত হবে না।’

হুন্ডি প্রক্রিয়াটির ব্যাখ্যা হলো, হুন্ডিওয়ালাদের এদেশীয় এজেন্টদের কাছে পুঁজি পাচারকারীরা টাকার অঙ্কে পাচার করা বৈদেশিক মুদ্রার সমপরিমাণ টাকা জমা করে দিচ্ছেন। হুন্ডিওয়ালাদের বৈদেশিক এজেন্ট ওই পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা পুঁজি পাচারকারীর বিদেশের কোনো অ্যাকাউন্টে জমা করে দিয়ে সহজে পুঁজি পাচার সম্পন্ন করে দিচ্ছেন। এই প্রক্রিয়ায় পুঁজি পাচারে যেহেতু দেশ থেকে বিদেশে কিংবা বিদেশ থেকে দেশে ‘ফিজিক্যালি’ অথবা ফিন্যান্সিয়াল মিডিয়ায় কোনো অর্থ লেনদেন হয় না, তাই দেশের সরকার আইন প্রয়োগের মাধ্যমে এমন অর্থ পাচার ঠেকাতে পারে না। এখন প্রশ্ন উঠবে, পুঁজি পাচারকারীরা যে পরিমাণ টাকা হুন্ডিওয়ালাদের দেশীয় এজেন্টদের কাছে পেমেন্ট করেন, সেটা তাঁরা কোথায় পান?

এই অর্থ পুঁজি পাচারকারীরা নিজেদের দুর্নীতির মাধ্যমে সংগ্রহ করছেন অথবা ব্যাংকঋণ নিয়ে তা পাচার করে দিচ্ছেন। এই ব্যাংকঋণ আর কখনোই ব্যাংকে ফেরত আসবে না, এটা ব্যাংকের খেলাপি ঋণের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাবে। সে জন্যই আমি বারবার বলে চলেছি, খেলাপি ঋণ সমস্যার সঙ্গে এবং দুর্নীতির সঙ্গে পুঁজি পাচারের ওতপ্রোত-সম্পর্ক রয়েছে। এই পদ্ধতিতে পুঁজি পাচার যেহেতু অন্য পদ্ধতিগুলোর তুলনায় অনেক সহজ এবং আইনগত ঝামেলায় পড়ার আশঙ্কামুক্ত, তাই সাম্প্রতিক কালে অন্য তিনটি প্রধান পদ্ধতিকে হুন্ডি পদ্ধতি ছাড়িয়ে গেছে অনায়াসে। এখন হুন্ডি পদ্ধতিতে ব্যাংকঋণ বিদেশে পাচার অর্থনীতির ‘১ নম্বর’ সমস্যায় পরিণত হয়েছে বলেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতিকে ‘বাত্ কা বাত্’ বানিয়ে রেখে পুঁজি পাচার সমস্যার সমাধান পাওয়া অসম্ভব মনে করি। অপর পক্ষে, শুধু প্রবাসীদের রেমিট্যান্সে প্রণোদনাকে ৫ শতাংশে উন্নীত করে হুন্ডি ব্যবসা দমানো যাবে না। আমার মনে হয়, এক্সচেঞ্জ হাউসগুলো কিছুদিনের জন্য বন্ধ করার মতো কঠোর দমনের ব্যবস্থা নিলে আগামী মাসগুলোতে ফরমাল চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়তে শুরু করবে।

প্রবাসীরা ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২১ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার ফরমাল চ্যানেলে দেশে পরিবারের সদস্যদের কাছে রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছিলেন, প্রায় অর্ধেক রেমিট্যান্স এখন হুন্ডি পদ্ধতিতে দেশে আসছে। আমি মনে করি, বাংলাদেশের বেশির ভাগ রেমিট্যান্স প্রেরক হুন্ডি পদ্ধতি ব্যবহার করছেন। অতএব ২১-২২ বিলিয়ন ডলার যদি ফরমাল চ্যানেলে দেশে রেমিট্যান্স আসে, তাহলে আরও ২১-২২ বিলিয়ন ডলার বা তার চেয়ে বেশি রেমিট্যান্স (টাকার আকারে) হুন্ডি পদ্ধতিতে দেশের অর্থনীতিতে ঢুকছে। দেশের বেশির ভাগ প্রবাসী হুন্ডি পদ্ধতিতে রেমিট্যান্স প্রেরণ করায় প্রমাণিত হচ্ছে যে প্রবাসীদের ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের মধ্যে হুন্ডি পদ্ধতির জনপ্রিয়তা ক্রমবর্ধমান।

এ ক্ষেত্রে শুধু দেশপ্রেমের ধোঁয়া তুলে তাঁদের এই ক্রমবর্ধমান আগ্রহকে সহজে দমন করা যাবে না। ফরমাল চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠানোর জন্য সরকার আগে ২ দশমিক ৫ শতাংশ হারে প্রণোদনা প্রদান করত। সম্প্রতি এই প্রণোদনাকে ৫ শতাংশে বৃদ্ধি করা হয়েছে। এতত্সত্ত্বেও প্রবাসীদের ফরমাল চ্যানেলগুলো ব্যবহারে যথেষ্ট উৎসাহিত করা যাবে কি না, তা দেখার বিষয়। বাজারে ডলারের দাম যতই বাড়তে থাকবে, হুন্ডিওয়ালারাও ডলার ক্রয়ের সময় ডলারের দাম আরও ৫-৭-৮ টাকা বাড়িয়ে দিয়ে হুন্ডির আকর্ষণ ধরে রাখার চেষ্টা করবেন।

বহুদিন ধরেই আমি বলে চলেছি, হুন্ডি ব্যবস্থাকে কঠোরভাবে দমন না করলে ফরমাল চ্যানেলে রেমিট্যান্সের প্রবাহ বাড়ানো কঠিন থেকে যাবে। আমার মতে, হুন্ডি পদ্ধতিতে দেশের অর্থনীতিতে যোগ হওয়া রেমিট্যান্স ও অন্যান্য ব্যবস্থায় দেশে নিয়ে আসা বিদেশে উপার্জিত আয়-উপার্জন ২৫-৩০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে যাচ্ছে প্রতিবছর। তার মানে, প্রবাসী বাংলাদেশিদের ফরমাল-ইনফরমাল চ্যানেলে মোট রেমিট্যান্স ও দেশে নিয়ে আসা বৈদেশিক মুদ্রার যোগফল ৪৫-৫০ বিলিয়ন ডলার। এখন দেশ থেকে বিদেশে অর্থ পাচারের বার্ষিক পরিমাণ প্রায় ১৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে গেছে বলে ধারণা করা হয়। ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২২ তারিখে সরকারের ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্টের (সিআইডি) বরাত দিয়ে দেশের পত্র-পত্রিকায় খবর বেরিয়েছিল যে শুধু হুন্ডি প্রক্রিয়ায় দেশ থেকে গড়ে বছরে ৭৫ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে।

মানে, সিআইডির দাবি, ৭৫ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণের বৈদেশিক মুদ্রা দেশেই আসছে না। অথচ এই পরিমাণ টাকা হুন্ডি প্রক্রিয়ায় দেশ থেকে বিদেশে পুঁজি পাচারকারীদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে বৈদেশিক মুদ্রা হিসেবে জমা হয়ে যাচ্ছে)।

যে ‘হুন্ডি ডলার’ বিদেশেই রয়ে যাচ্ছে, সেগুলোর চাহিদা জোগাচ্ছেন প্রধানত দেশের দুর্নীতিবাজ ও কালোটাকার মালিকেরা এবং ব্যাংকের ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়ার ‘কালচার’ সৃষ্টিকারী ব্যবসায়ীরা। রাজনীতিক বলুন, দুর্নীতিবাজ সিভিল আমলা-প্রকৌশলী বলুন, রাঘববোয়াল ঋণখেলাপি বলুন, ডাকসাইটে ব্যবসায়ী-শিল্পপতি বলুন—হুন্ডি ডলারের সহায়তায় গড়ে উঠছে প্রবাসীদের ঘরবাড়ি, ব্যবসাপাতি, কানাডার টরন্টোর বেগমপাড়া, অস্ট্রেলিয়ার সিডনির ফ্রেটারনিটি কিংবা মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোমগুলো। এই ক্রমবর্ধমান পুঁজি পাচারের কারণেই দেশের বৈদেশিক মুদ্রার গ্রস রিজার্ভ ১৯ বিলিয়ন ডলার এবং নিট রিজার্ভ ১৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে গেছে।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতিকে ‘বাত্ কা বাত্’ বানিয়ে রেখে পুঁজি পাচার সমস্যার সমাধান পাওয়া অসম্ভব মনে করি। অপর পক্ষে, শুধু প্রবাসীদের রেমিট্যান্সে প্রণোদনাকে ৫ শতাংশে উন্নীত করে হুন্ডি ব্যবসা দমানো যাবে না। আমার মনে হয়, এক্সচেঞ্জ হাউসগুলো কিছুদিনের জন্য বন্ধ করার মতো কঠোর দমনের ব্যবস্থা নিলে আগামী মাসগুলোতে ফরমাল চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়তে শুরু করবে।

এর পাশাপাশি দেশের শহর কিংবা গ্রামগুলোতে যেখানেই প্রবাসীদের পরিবার পাকা বাড়ি নির্মাণ করবে, তাদের বাড়ির নির্মাণ ব্যয়ের প্রয়োজনীয় অর্থ ফরমাল চ্যানেলে দেশে আনার ‘ফরেন এক্সচেঞ্জ ব্যাংক-স্টেটমেন্ট’ যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে গৃহনির্মাণের পূর্বানুমতির জন্য জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা চালু করতে হবে।

সবচেয়ে গুরুত্ব দিতে হবে অবিলম্বে যথাযথ আইন প্রণয়নের মাধ্যমে হুন্ডিওয়ালাদের দেশীয় এজেন্টদের গ্রেপ্তার করে দ্রুত আদালতের রায়ে তাঁদের জেলের ভাত খাওয়ার ব্যবস্থা করার। অর্থনীতিকে টালমাটাল সংকটে নিক্ষেপ করছে দেশদ্রোহমূলক হুন্ডি ব্যবসা। অতএব হুন্ডি ব্যবসাকে অবৈধ ঘোষণা করে কঠোর দমন কর্মসূচি গ্রহণ করা ছাড়া গত্যন্তর নেই।

  • ড. মইনুল ইসলাম অর্থনীতিবিদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক