সফর আমাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। আমাদের জীবনের যাবতীয় কাজ ইবাদত। সফরকে ইবাদতে পরিণত করার জন্য রয়েছে কিছু আদব ও সুন্নত। দুনিয়ার সফর যেন আখিরাতের সফরের পাথেয় হয়, সে জন্য কোরআন কারিম ও হাদিস শরিফে সফরের বিধিবিধান বিস্তারিত বর্ণিত হয়েছে। সম্ভব হলে বৃহস্পতিবার ও সকাল বেলা সফর শুরু করা উত্তম। কাআব ইবনে মালিক (রা.) হতে বর্ণিত, নবী কারিম (সা.) তাবুক অভিযানে বৃহস্পতিবার বের হলেন। (বুখারি: ২৯৪৯)
একাধিক ব্যক্তি একসঙ্গে সফর করা এবং একজনকে দলপতি নির্ধারণ করা ও তার আনুগত্য করা শ্রেয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যদি লোকেরা জানত যে একাকী সফরে কী ক্ষতি রয়েছে; যা আমি জানি, তাহলে কোনো আরোহী একাকী সফর করত না।’ (বুখারি: ২৯৯৮) রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও বলেন, ‘যখন তিন ব্যক্তি সফরে বের হবে, তখন তারা যেন তাদের একজনকে আমির বানিয়ে নেয়।’ (তিরমিজি: ১৬৭৪)
সফরে অকারণে বিলম্ব করা বা অহেতুক সফর দীর্ঘায়িত করা উচিত নয়। সফর থেকে ফেরার আগে বাড়িতে সংবাদ দেওয়া জরুরি। সম্ভব হলে সকাল বেলা বাড়ি ফেরা উত্তম। রাতে বাড়িতে না ফেরা বাঞ্ছনীয়
সফরে চলা, বিশ্রাম নিতে অবতরণ করা, রাত কাটানো এবং সফরে ঘুমানোর রয়েছে কিছু আদব-কায়দা। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমরা রাতে সফর করো। কেননা, রাতে জমিনকে গুটিয়ে দেওয়া হয় (রাস্তা কম মনে হয়)।’ (আবু দাউদ: ২৫৭১) সফরে অচেনা স্থানে বিচ্ছিন্নভাবে বিক্ষিপ্ত ঘোরাফেরা সমীচীন নয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমাদের এসব গিরিপথ ও উপত্যকায় বিক্ষিপ্ত হওয়া শয়তানের কাজ।’ এরপর সাহাবিগণ যখনই কোনো মঞ্জিলে অবতরণ করত, তখনই একে অপরের সঙ্গে মিলেমিশে থাকত। (আহমাদ: ২৭২৮২)
কোথাও অবতরণ করলে বা অবস্থান করার সুযোগ থাকলে নফল নামাজ পড়া উত্তম। সফরের সঙ্গীকে সাহায্য করা অতি উত্তম আমল। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যার বাড়তি সওয়ারি আছে, সে যেন তা তাকে দেয়; যার সওয়ারি নেই এবং যার অতিরিক্ত সফরের সম্বল রয়েছে, সে যেন সম্বলহীন ব্যক্তিকে দেয়।’ অতপর তিনি আরও কয়েক প্রকার মালের কথা বললেন। এমনকি শেষ পর্যন্ত আমরা ধারণা করলাম যে বাড়তি মালে আমাদের কারোর কোনো অধিকার নেই। (আহমাদ: ১০৯০০)
রাসুলুল্লাহ (সা.) সফরে (সকলের) পেছনে চলতেন। তিনি দুর্বলকে সাহায্য করতেন এবং তাঁকে (বাহনের) পেছনে বসিয়ে নিতেন ও তাঁর জন্য দোয়া করতেন।’ (আবূদাঊদ: ২৬৩৯) সওয়ারি বা যানবাহনে চড়ার সময় দোয়া পড়া সুন্নত। রাসুলে আকরাম (সা.) যখন সফরের জন্য উটের পিঠে স্থির হয়ে বসতেন, তখন তিনবার ‘আল্লাহু আকবার’ বলে এই দোয়া পড়তেন, ‘সুবহানাল্লাযী সাখ্খরা লানা হা-যা ওয়া মা কুন্না লাহু মুকরিনীন।
ওয়া ইন্না ইলা রাব্বিনা লামুনকলিবূন।’ অর্থাৎ পবিত্র ও মহান যিনি একে আমাদের বশীভূত করে দিয়েছেন যদিও আমরা একে বশীভূত করতে সমর্থ ছিলাম না। অবশ্যই আমরা আমাদের প্রতিপালকের নিকট প্রত্যাবর্তনকারী।
সফরে দোয়া কবুল হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তিন ব্যক্তির দোয়া সন্দেহাতীতভাবে গৃহীত হয়-নির্যাতিত ব্যক্তির দোয়া, মুসাফিরের দোয়া এবং সন্তানের জন্য মাতা-পিতার দোয়া।’ (তিরমিজি: ১৯০৫) মানুষ বা অন্য কিছু থেকে ভয় পেলে পড়ার দোয়া: ‘আল্লাহুম্মা ইন্না নাজআলুকা ফী নুহূরিহিম ওয়া নাঊযু বিকা মিন শুরূরিহিম।’ অর্থাৎ হে আল্লাহ! আমরা আপনাকে ওদের ঘাড়ে স্থাপন করছি এবং ওদের অনিষ্টতা থেকে আপনার নিকট পানাহ চাচ্ছি। (আহমাদ: ১৯২২০)
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন: ‘যে ব্যক্তি (সফরের) কোনো মঞ্জিলে অবতরণ করে এই দোয়া পড়বে, ‘আঊযু বিকালিমাতিল্লা-হিত্ তা-ম্মাতি মিন শার্রি মা খলাক’ (অর্থাৎ আল্লাহর পরিপূর্ণ বাণীগুলোর অছিলায় তাঁর সৃষ্টির অনিষ্ট থেকে আমি আশ্রয় চাই) তাহলে সে মঞ্জিল থেকে অন্যত্র রওনা হওয়া পর্যন্ত কোনো কিছু তার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। (মুসলিম: ২৭০৮)
সফরে অকারণে বিলম্ব করা বা অহেতুক সফর দীর্ঘায়িত করা উচিত নয়। সফর থেকে ফেরার আগে বাড়িতে সংবাদ দেওয়া জরুরি। সম্ভব হলে সকাল বেলা বাড়ি ফেরা উত্তম। রাতে বাড়িতে না ফেরা বাঞ্ছনীয়। নিকটে কোনো আত্মীয়বাড়ি থাকলে ফেরার পথে আগে সেখানে যাওয়া সুন্নত।
বাড়ি প্রবেশের পূর্বে মসজিদে গিয়ে নামাজ আদায় করা ও সুযোগ থাকলে মসজিদে যাত্রী যাপন করাও সুন্নত। (বুখারি: ১৮০১, ১৮০০, ৩৭১, ২৭৫৮, মুসলিম: ১৩৩৯, তিরমিজি: ১০৭০, দাউদ: ১৭২৩, ইবনু মাজাহ: ২৮৯৯, মুসনাদে আহমাদ: ৭১৮১, মুআত্তা মালিক: ১৮৩৩)।
মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী
যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম
smusmangonee@gmail.com