গত বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই) অফিস শেষ করে এক সহকর্মীর সঙ্গে গিয়েছিলাম ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। তখন রাত সাড়ে ১০টা। এরপরও হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে লোকজনের ভিড়। কয়েক মিনিট বিরতি দিয়ে একের পর এক অ্যাম্বুলেন্স আসছে।
অ্যাম্বুলেন্স থেকে যাঁদের নামানো হচ্ছিল, তাঁদের প্রায় সবার শরীরে আঘাতের চিহ্ন। কেউ রক্তাক্ত, কেউ খুঁড়িয়ে হাঁটছেন, কারও কারও অবস্থা এতই খারাপ যে স্ট্রেচারে করে জরুরি বিভাগে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তাঁদের সঙ্গে থাকা বন্ধু, স্বজন বা উদ্ধারকারীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তাঁরা কেউ পুলিশের ছররা গুলি বা রাবার বুলেটে আহত হয়েছেন, কেউ আবার কেউ ছাত্রলীগ-যুবলীগের হামলার শিকার হয়েছেন।
জরুরি বিভাগ দিয়ে হাসপাতালের ভেতর দিকে যাওয়ার পথেই দেখি, একটি স্ট্রেচার ঘিরে চার থেকে পাঁচজন লোক দাঁড়িয়ে আছেন। কাছে গিয়ে দেখা গেল, স্ট্রেচারে ২৪ থেকে ২৫ বছরের এক তরুণের মৃতদেহ। সেখানে লুঙ্গি-ফতুয়া পরা শ্মশ্রুমণ্ডিত এক লোক বিমর্ষ চেহারায় দাঁড়িয়ে ছিলেন।
কথা বলে জানা গেল, তিনিই সেই মৃত তরুণের বাবা। তাঁদের বাড়ি কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলায়। ছেলেটি ঢাকায় পড়াশোনা করতেন, থাকতেন বাড্ডায়। তিনি সেদিন দুপুরে বাসা থেকে বের হয়েছিলেন। বিকেলে ঢাকা মেডিকেল থেকে কেউ একজন ফোন দিয়ে স্বজনদের মৃত্যুর কথা জানান।
‘কিন্তু স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি কোথায়? এক এক দিনের খবরের কাগজ খুললে মনে হয় স্বাভাবিক মৃত্যুর খবর যেন ছুটি নিয়েছে। যে মৃত্যুর কাহিনী আজ সংবাদপত্রের পাতা জুড়ে থাকে, তাকে একটি একটি করে সাজালে মনে হবে আজ স্বাভাবিক মৃত্যুর জন্যও প্রার্থনা করতে হবে।...’
কয়েক মিনিটের মধ্যে সেই মৃতদেহের কাছে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন ১৮ থেকে ২০ বছর বয়সী এক তরুণী। কথাবার্তায় বোঝা গেল, তিনি সেই তরুণের বোন। তিনি এসে তাঁর বাবাকে হাসপাতাল থেকে কোনো একটা কাগজ তোলার জন্য তাড়া দিচ্ছিলেন।
চলার পথে আমরা সেখানে মিনিট পাঁচেকের বেশি সময় থাকতে পারিনি। এই সময়ের মধ্যে মৃত তরুণের বাবা ও বোনকে উদভ্রান্ত, বিপর্যস্ত ও বিষণ্ন মনে হলেও তাঁদের কাঁদতে বা শোক প্রকাশ করতে দেখিনি। কারণ, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে মৃতদেহ বুঝে নেওয়ার নানা আনুষ্ঠানিকতা সারতেই তাঁদের ছুটোছুটি করতে হচ্ছিল; কাঁদার জন্য, শোকের জন্য তাঁরা কোনো ফুরসত পাচ্ছিলেন না। সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে তবেই তাঁরা কান্নার সুযোগ পাবেন!
এই আমাদের দেশের অবস্থা, যেখানে মৃত্যু আসে এত অবলীলায় যে কান্নার ফুরসত পাওয়া যায় না! যেখানে স্বজন হারানোর শোক নিজের ভেতরেই চেপে রাখতে হয়!
কীভাবে, কেন সেই তরুণের মৃত্যু হলো, সে সম্পর্কে কিছুই জানতে পারিনি। তবে তাঁর মৃত্যু যে স্বাভাবিক নয়, সেটা নিশ্চিত। কয়েক দিন ধরে দেশে যেভাবে গুলি চালানো হলো, রক্ত ঝরল, দমন-পীড়ন চলল, তাতে এ রকম অস্বাভাবিক মৃত্যুর সংখ্যা ঠিক কত, সেটার সঠিক হিসাব এখনো জানা যায়নি। আদৌ কোনো দিন সেটা যাবে কি না, তা নিয়েও রয়েছে সংশয়।
কোটা সংস্কারের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে এক সপ্তাহে (১৬-২২ জুলাই) সারা দেশে নজিরবিহীন প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। প্রথম আলো যে কয়টি সূত্র থেকে তথ্য পেয়েছে, সেই হিসাবে ২৭ জুলাই পর্যন্ত মৃত্যুর সংখ্যা ২০০ ছাড়িয়ে গেছে। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনো আন্দোলন বা বিক্ষোভে এত অল্প সময়ে এত বেশি মৃত্যু এর আগে হয়নি।
বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক একটি আন্দোলন কেন, কীভাবে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ল, কেন এত প্রাণহানি হলো, নীতিনির্ধারকেরা কি এসব প্রশ্নের মুখোমুখি হবেন না? এত মানুষের মৃত্যুতে তাঁরা কি বিচলিত নন? এই দেশের মানুষের কি স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি থাকবে না?
প্রয়াত সাংবাদিক নির্মল সেন ১৯৭৩ সালে ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই’ শিরোনামে লিখেছিলেন, ‘...আমি চাই না যে আমাকে পিটিয়ে হত্যা করা হোক। আমি চাই না আমার সে বিকৃত দেহটা দেখে কাঁদুক আমার স্বজন। অশ্রুর প্লাবন নামুক আমার আপনজনের চোখে। আমি চাই না আততায়ীর গুলি বিদ্ধ করুক আমাকে এক অসতর্ক মুহূর্তে। আমি চাই না যে আমার শুভাকাঙ্ক্ষীরা একদিন থানা-পুলিশ করুক আমার জন্য। আমি চাই না নিরুদ্দেশ তালিকায় ভীড় জমাতে।
‘মৃত্যু অনিবার্য। জন্মিলে মরিতে হয় এ আমি জানি। মৃত্যুর পথ কি কেউ বেছে নিতে পারে—সে প্রশ্ন আজ আমার কাছে গৌণ। আমি স্বাভাবিকভাবে মরতে চাই।...
‘কিন্তু স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি কোথায়? এক এক দিনের খবরের কাগজ খুললে মনে হয় স্বাভাবিক মৃত্যুর খবর যেন ছুটি নিয়েছে। যে মৃত্যুর কাহিনী আজ সংবাদপত্রের পাতা জুড়ে থাকে, তাকে একটি একটি করে সাজালে মনে হবে আজ স্বাভাবিক মৃত্যুর জন্যও প্রার্থনা করতে হবে।...’
৫০ বছরের বেশি সময় আগে নির্মল সেন সদ্য স্বাধীন দেশে স্বাভাবিক মৃত্যুর জন্য প্রার্থনা করার কথা বলেছিলেন। ২০২৪ সালে এসেও আমাদের কেন একই রকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে? এই দেশে মানুষের জীবনের মূল্য কেন এত কম?
মনজুরুল ইসলাম প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক