কিশোর-অপরাধ ও পুনর্বাসন

'শিশু জেলখানায় যাইবেন, স্যার?'

কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের নির্যাতিত এক কিশোরের চিঠি (প্রথম আলো, ১৪ ফেব্রুয়ারি)
কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের নির্যাতিত এক কিশোরের চিঠি (প্রথম আলো, ১৪ ফেব্রুয়ারি)

১০-১১ বছর আগে কিশোর অপরাধীদের সংশোধনের জন্য ‘অলটারনেটিভ মেজারস’ বা ‘বিকল্প ব্যবস্থা’বিষয়ক একটি গবেষণাকাজের জন্য আমাকে যশোরে যেতে হয়েছিল। দড়াটানা মোড়ের পাশের একটি আবাসিক হোটেলে রাত কাটিয়ে সকালবেলা যশোরের তৎকালীন ডিসির সঙ্গে দেখা করলাম। ডিসি অফিস থেকে বেরিয়ে এক রিকশাচালককে জিজ্ঞাসা করলাম, তিনি পুলেরহাট কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে যাবেন কি না। তিনি বুঝতে পারলেন না। তাঁকে যখন বুঝিয়ে বললাম যে আমি কিশোর অপরাধী ও অবাধ্য কিশোরদের যেখানে রাখা হয় সেখানে যেতে চাই, তখন তিনি বুঝলেন। রিকশাচালক মাথা নেড়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘শিশু জেলখানায় যাইবেন, স্যার?’
রিকশাচালকের ওই কথাটি আমার কানে কাঁটার মতো বিঁধে আছে। কথাটি আবারও মনে পড়ে গেল টঙ্গীর কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের কিশোরদের আকুতি শুনে। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোর শেষ পৃষ্ঠায় টঙ্গীর কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের কিশোরদের দুর্দশা নিয়ে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল ‘মা গো মা, আমার জামিন করাও না।’
বাংলাদেশে টঙ্গী ও যশোরে দুটি কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র এবং গাজীপুরের কোনাবাড়ীতে একটি কিশোরী উন্নয়ন কেন্দ্র আছে; জয়পুরহাটে আরেকটি কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র নির্মাণাধীন। কিশোর বা কিশোরী উন্নয়ন কেন্দ্রকে আগে বলা হতো সংশোধন কেন্দ্র। কিন্তু সংশোধনের কথা বলা হলে মনে হতে পারে, কোমলমতি শিশুরা হয়তো ভয়ানক কোনো অপরাধ করে ফেলেছে অথবা সংশোধন কেন্দ্রের কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে ‘গিল্টি ফিলিং’ জমাট বাঁধতে পারে। এ জন্য আন্তর্জাতিক কিছু সংগঠন ও বেসরকারি সংস্থার চাপে বা প্রভাবে ‘সংশোধন কেন্দ্রগুলো’ হয়ে গেল ‘উন্নয়ন কেন্দ্র’। কিন্তু নামই শুধু পরিবর্তন হলো, না হলো কিশোর-কিশোরীদের উন্নয়ন, না বদলাল কেন্দ্রগুলোর চরিত্র। ১০-১১ বছর আগে আমি উন্নয়ন কেন্দ্রগুলোর যে অবস্থা দেখে এসেছিলাম, এখনো সেই অবস্থাই বিরাজমান। প্রথম আলোতে প্রকাশিত প্রতিবেদন সে সাক্ষ্যই দিচ্ছে।
যেসব কিশোর-কিশোরী অপরাধ করেছে, বা স্বাভাবিক জীবন থেকে বিচ্যুত হয়েছে, অথবা যাদের নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না, তাদেরকে উন্নয়ন কেন্দ্রে এনে রাখা হয়। এসব উন্নয়ন কেন্দ্রের লক্ষ্য কিশোর আদালত কর্তৃক দেওয়া রায় মানবিকতার সঙ্গে কার্যকর করা। বিচ্যুত, অবাধ্য বা দণ্ডপ্রাপ্ত কিশোর-কিশোরীদের সংশোধনের মাধ্যমে সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সুযোগ করে দেওয়া। উন্নয়ন কেন্দ্রগুলোতে যেসব বিচ্যুত, অবাধ্য ও দণ্ডপ্রাপ্ত কিশোর-কিশোরী আছে, তাদের পর্যাপ্ত খাদ্য দিয়ে, খেলাধুলা ও বিনোদনের ব্যবস্থা করে, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দিয়ে এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে, যেন তারা আবার সমাজের সুস্থ-স্বাভাবিক ধারার সঙ্গে মিশে যেতে পারে। কিন্তু যে মুহূর্ত থেকে তাদেরকে উন্নয়ন কেন্দ্রে আবদ্ধ করে রাখা হয়, সেই মুহূর্ত থেকে তারা যেমন ওই স্থানটিকে কারাগার মনে করে, তেমনি সমাজের সাধারণ মানুষের কাছে সেটি হয়ে যায় ‘শিশু জেলখানা’! এ জন্যই উন্নয়ন কেন্দ্র বা কোথাও আবদ্ধ না রেখে বিচ্যুত, অবাধ্য ও লঘু অপরাধে দণ্ডপ্রাপ্ত কিশোর-কিশোরীদের প্রবেশন কর্মকর্তা, মহিলা সমাজকল্যাণ কর্মকর্তা অথবা কোনো মহানুভব ব্যক্তির তত্ত্বাবধানে বৃহত্তর সমাজের মধ্যে রাখা উচিত। এতে করে বিচ্যুত, অবাধ্য ও লঘু দণ্ডপ্রাপ্ত কিশোর-কিশোরীদের দ্রুত সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সম্ভাবনা তৈরি হবে। এসব কিশোর-কিশোরীকে মুক্ত সমাজের সুস্থ পরিবেশের পরিবর্তে উন্নয়ন কেন্দ্রের আবদ্ধ ও অসুস্থ পরিবেশে রেখে পুনর্বাসনের চেষ্টা হলে পুনর্বাসন তো হবেই না, বরং তারা ওই কেন্দ্রগুলো থেকে বেরিয়ে পুরোদস্তুর অপরাধীতে পরিণত হয়ে যেতে পারে। আর যে স্বল্পসংখ্যক কিশোর বা কিশোরীকে কিশোর আদালত হত্যা, ধর্ষণ, ডাকাতির মতো ভয়াবহ অপরাধের জন্য দণ্ড প্রদান করবেন, শুধু তাদেরই কোনো স্থানে আবদ্ধ করে রাখা যেতে পারে। তবে ওই স্থানটিকে দণ্ডপ্রাপ্ত কিশোর-কিশোরীদের সত্যিকার পুনর্বাসনকেন্দ্রে পরিণত করতে হলে খাদ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা, বিনোদন, প্রশিক্ষণসহ তাদের প্রাপ্য সব অধিকার যেমন নিশ্চিত করতে হবে; সাধারণ মানুষের মানসিকতাও বদলাতে হবে।
কিশোর, কিশোরী, যুবক, প্রবীণ, বৃদ্ধ যেই হোক, তাকে যদি লোহার গ্রিল দেওয়া কোনো কামরায় বন্দী করে রাখা হয় অথবা বিশাল বিশাল পাঁচিলের মাঝখানে দিনের পর দিন আবদ্ধ করে রাখা হয়, তাহলে ওই ব্যক্তি আস্তে আস্তে মানসিকভাবে পঙ্গু হয়ে যেতে থাকে। তদুপরি ওই ব্যক্তি যদি পেট ভরে খেতে না পায়, রাতে ছারপোকার যন্ত্রণায় ঘুমোতে না পারে, অসুখে চিকিৎসা না পায়, জেল কর্মকর্তা বা তত্ত্বাবধায়কের প্রহারে আহত হয়, তাহলে কীভাবে তার সংশোধন হবে, আর কীভাবেই বা ধরা যাবে ‘উন্নয়ন’-এর সোনার হরিণ?
সভ্য ও গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে দণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধীদের কারাগারে আবদ্ধ করে না রেখে প্রবেশন, প্যারোলসহ নানা বিকল্প ব্যবহার করা হচ্ছে। ‘ক্রিমিনাল জাস্টিস’-এর ক্ষেত্রে সারা বিশ্ব অপরাধীদের মুক্ত সমাজে রেখে সংশোধন ও পুনর্বাসনের চেষ্টা করছে, অথচ আমরা এখনো কারাগারকেন্দ্রিক ‘পেনাল পলিসি’ নিয়ে অপরাধ প্রতিরোধ ও নির্মূলের চেষ্টা করছি। ‘ক্রিমিনাল জাস্টিস’-এর ক্ষেত্রে যখন শাস্তির চেয়ে সংশোধন ও পুনর্বাসন প্রধান হয়ে উঠেছে, তখন শিশু-কিশোর (জুভেনাইল জাস্টিস) ক্ষেত্রে বিষয়টা তো আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, শিশু-কিশোরেরাই সমাজের ভবিষ্যৎ। তারা যদি বিচ্যুত হয় বা অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে, তাহলে তাদের কোনো স্থানে (সংশোধন বা উন্নয়ন কেন্দ্র যা-ই বলি না কেন) আটকে না রেখে বরং মুক্ত সমাজে রেখে পুনর্বাসনের চেষ্টা করা উচিত, যাতে তারা সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে। বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালের শিশু আইনে অনেক ইতিবাচক বিধান ছিল, কিন্তু তা সঠিকভাবে প্রয়োগ করা যায়নি। ২০১৩ সালে যে আইনটি হয়েছে, সেটির যথাযথ প্রয়োগ হবে কি না, সে ব্যাপারেও সন্দেহ থেকে যায়। দারিদ্র্য, মাদক ও অস্ত্রের সহজলভ্যতা, সামাজিক রূপান্তর, দ্রুত শিল্পায়ন, নগরায়ণ, বিবাহবিচ্ছেদ, পরিবার ভেঙে যাওয়া, মা-বাবা ও সন্তানের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের অভাবসহ নানা কারণে দেশে কিশোর অপরাধ বাড়ছে।
ক্ষমতাসীন, ক্ষমতাপ্রত্যাশী ও তাদের সমর্থকেরা রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত, বাবা-মা অফিস-আদালত বা ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত। মানুষ ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে টাকা আর ভোগের পেছনে। শিশুদের দিকে তাকানোর কেউ নেই, কিশোর-কিশোরীদের দুঃখ-কষ্ট, আনন্দ-যন্ত্রণা বোঝার কেউ নেই। ফলে তাদের অনেকে বিচ্যুত হচ্ছে সুস্থ-স্বাভাবিক জীবন থেকে, অনেকে জড়িয়ে পড়ছে নানা রকমের অপরাধের সঙ্গে। শিশু-কিশোরদের এ চিত্র কি গভীর কোনো সামাজিক সংকট উন্মোচিত করছে না? আমরা কি সঠিক পথে এগোচ্ছি?
শেখ হাফিজুর রহমান: সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
hrkarzon@yahoo.com