প্রকৃত সত্যের চেয়েও মানুষের আবেগ ও ব্যক্তিগত বিশ্বাস যখন জনমত তৈরিতে বেশি কার্যকর ভূমিকা রাখে, সেই সময়টাকে বলা হচ্ছে সত্য-উত্তর যুগ বা পোস্ট-ট্রুথ এরা। পোস্ট-ট্রুথ ২০১৬ সালের সবচেয়ে আলোচিত শব্দ হিসেবে আবির্ভূত হলে পরে অক্সফোর্ড ডিকশনারির সম্পাদকমণ্ডলী ২০১৭ সালে এই ব্যাখ্যাটি দিয়েছিল। কেমব্রিজ ডিকশনারি তা আরও সহজ করে বলেছে পোস্ট-ট্রুথ হচ্ছে এমন একটি পরিস্থিতি, যেখানে মানুষ আসল ঘটনা বা সত্যের বদলে তাদের আবেগ ও বিশ্বাসের ওপর নির্ভর করে কোনো একটি যুক্তিকে গ্রহণ করে নেয়। সত্য যেখানে গৌণ, সে রকম রাজনৈতিক পরিবেশের আলোচনাটা যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নির্বাচনের সময় থেকে শুরু হলেও তার অভিজ্ঞতা যে আমাদের দেশে নেই তা নয়। বরং, দিন দিন তা প্রকট হচ্ছে।
সত্য গৌণ হলে গুজব, অর্ধসত্য এবং নিরেট মিথ্যার রমরমা প্রসার ঘটতে বাধ্য। সাম্প্রতিক ছাত্র আন্দোলনের পটভূমিতে গুজব একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। তবে সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের কথাবার্তা এবং কাজে মনে হচ্ছে এই গুজবেরও দুটো শ্রেণি বা ধরন আছে। একটা হচ্ছে ‘ভালো’ গুজব, আরেকটা ‘মন্দ’ গুজব। এখানে একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ৬ আগস্ট স্বল্প প্রচারিত একটি দৈনিক প্রথম পাতায় জিগাতলায় ৪ আগস্টের হামলার দৃশ্য হিসেবে একটি ছবি ছাপিয়ে বলল হামলাকারীরা ছাত্রদলের সদস্য। কিন্তু যখন প্রমাণিত হলো ছবিটি ২০১২ সালের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষের, তখন পত্রিকাটি তা প্রত্যাহার করে নিল। তবে ইতিমধ্যে সরকারের একজন মন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনে ছবিটি দেখিয়ে বিএনপির ষড়যন্ত্রের প্রমাণ বলে দাবি করেছিলেন, তিনি ভুলটার কথা বললেন না। তাঁর অনুসারীরা কিন্তু ওই ছবিটিকে ঠিকই ভাইরাল করেছে। সুতরাং, যে গুজবে বিরোধী দলের কর্মীদের হেয় করা যায়, সেটি নিশ্চয়ই ‘ভালো’?
এ রকম উদাহরণ আরও ভূরি ভূরি দেওয়া সম্ভব। ছাত্রদের নিরাপদ সড়কের আন্দোলনে বিএনপি-জামায়াত অর্থায়ন করেছে, আলোকচিত্রী শহিদুল আলম সরকার উৎখাতের আহ্বান জানিয়েছিলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যে জঙ্গিরা ছিল কিংবা মার্কিন রাষ্ট্রদূত বার্নিকাট ষড়যন্ত্রে জড়িত-এ রকম গুজবে ইন্টারনেট সয়লাব হয়ে আছে। অনেক অনলাইনে এসব গুজব খবরের মতো করে ছাপা হচ্ছে। কিন্তু সরকার এসব গুজব বন্ধের কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে বলে শোনা যায়নি। কেননা, এতে সরকারের কোনো ক্ষতি নেই। বরং, বিরোধীদের হেয় করা গেলে সরকারের লাভ। এগুলো নিশ্চয়ই ‘ভালো’ গুজব?
জিগাতলায় আওয়ামী লীগের অফিসে হামলার চেষ্টা, সেখানে ছাত্র মারা যাওয়া, তেজগাঁওয়ে ধর্ষিতার মরদেহ পাওয়ার বানোয়াট ছবি প্রচারের মাধ্যমে যে উত্তেজিত আন্দোলনকারীদের আরও উত্তেজিত করার চেষ্টা হয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে অসৎ উদ্দেশ্যে এ ধরনের ছবি ভাইরাল করার চেষ্টা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। তবে সরকারি গুজব বন্ধের চেষ্টায় মোটা দাগে তিনটি সমস্যা আছে। প্রথমত, অবাধ তথ্যপ্রবাহে বাধা বা নিয়ন্ত্রণ আরোপের চেষ্টা। সাংবাদিকদের ওপর সরকার সমর্থক হেলমেট বাহিনীর হামলা সে রকমই একটা বাধা। দ্বিতীয়ত, বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলোর সরাসরি সম্প্রচার এবং মতপ্রকাশের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের চেষ্টা। এটাকে মানুষ হামলাকারীদের পরিচয় এবং ঘটনার তীব্রতা বা নৃশংসতার বীভৎসতা আড়াল করার চেষ্টা হিসেবেই দেখে। ফলে তারা যতটা জানতে পারে, অনেক সময়েই ধারণা করে তার চেয়ে অনেক বেশি তাদের জানানো হচ্ছে না। অতএব কানকথাই তখন প্রধান ভরসা হয়ে ওঠে। তৃতীয়ত, সরকারের পক্ষপাত ও দলীয় সংকীর্ণতা জনমনে সন্দেহ বাড়ায়। যেসব গুজব সরকারের পক্ষে যায় বা বিরোধীদের হেয় করে, সেগুলো বন্ধের চেষ্টা না করে বরং সেগুলোকে উৎসাহিত করতে দেখলে এ ধরনের সন্দেহ তৈরি হওয়াই স্বাভাবিক। পক্ষপাতের কারণে গুজবের পাশাপাশি সরকার যেসব তথ্য প্রচার হতে দিতে চায় না, সেগুলোর সবই তাদের কাছে হয়ে যাচ্ছে ‘মন্দ’ গুজব।
যা কিছু খারাপ তার সবই বিএনপি-জামায়াতের ষড়যন্ত্র, এমন তত্ত্বের বিশ্বাসযোগ্যতা কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় থেকেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে আছে। ফলে বছরের পর বছর যে পুলিশ বিএনপিকে সভা-সমাবেশ করতে দেয় না, সেই পুলিশের প্রহরায় যে হেলমেটধারীরা ত্রাস সৃষ্টি করল তারা বিএনপি-জামায়াতের দুর্বৃত্ত, এমন অবিশ্বাস্য দাবি যাঁরা করেন তাঁরা কার্যত নিজেদের বিশ্বাসযোগ্যতাকে জলাঞ্জলি দিচ্ছেন। সাম্প্রতিক সিটি নির্বাচনগুলোতেও এ ধরনের দুর্বৃত্তরা যখন ভোটকেন্দ্র দখল এবং ভুয়া ভোটে ব্যালট বাক্স ভরেছে, তখনো পুলিশ তাদের প্রশ্রয় দিয়েছে। অবশ্য ওই সব নির্বাচনের সময়েও ক্ষমতাসীন দলের কেউ কেউ বলেছেন যে আওয়ামী লীগকে হেয় করতে বিএনপি-জামায়াতের লোকেরা নৌকার ব্যাজ পরে এ ধরনের অপকর্ম করেছে। আসল তথ্য বা সত্যকে আড়াল করার এই কৌশলকে পোস্ট-ট্রুথ রাজনীতির আলামত ছাড়া আর কী বলা যাবে?
সব ধরনের গুজবের সম্ভাব্য বিপদ থেকে সবাইকে সুরক্ষা দেওয়ার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ সন্দেহ নেই। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ন্যায়নিষ্ঠভাবে সেই দায়িত্ব পালন করবে সেটিই প্রত্যাশিত। কিন্তু রামু এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, তাঁরা যে শুধু সময়মতো সেই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন তা-ই নয়, পরবর্তী সময়ে দলীয় পক্ষপাতের কারণে অপরাধীদের অনেকেই ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছেন। সাম্প্রতিক দুটি ছাত্র আন্দোলনকে ঘিরে অনলাইনে নজরদারি এবং তথ্যপ্রযুক্তি আইন প্রয়োগেও সেই দলীয় পক্ষপাত দৃশ্যমান। দুদিন আগে দাইয়ান নাফিস প্রধান নামে বুয়েটের একজন ছাত্রকে ফেসবুকে বিভিন্ন পোস্ট দেওয়া ও শেয়ারের জন্য ছাত্রলীগের অভিযোগের ভিত্তিতে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তাঁকে চার দিনের রিমান্ডেও নেওয়া হয়েছে (বিডিনিউজ ২৪,৮ আগস্ট ২০১৮)। ছাত্রলীগের নতুন নেতা গোলাম রব্বানী ৯ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবেশে বলেছেন যে ছাত্রলীগ সাত শ ফেসবুক আইডি শনাক্ত করেছে, যেগুলো তাঁর ভাষায় গুজব ছড়ানোয় জড়িত ছিল। তিনি তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রীর প্রতি এসব অ্যাকাউন্টের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন (সারাবাংলা ডট নেট, ৯ আগস্ট ২০১৮)। ছাত্রলীগ ও পুলিশের এই পারস্পরিক সহযোগিতার সম্ভাবনা পুলিশি প্রহরায় মিরপুর, ধানমন্ডি, রামপুরা ও বসুন্ধরায় হেলমেটধারীদের তাণ্ডবের স্মৃতিকেই স্মরণ করিয়ে দেয়।
তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক মন্ত্রীও বলেছেন যে ফেসবুকে ছাঁকনি (ফিল্টার) বসানোর প্রযুক্তি আনা হচ্ছে এবং তা ব্যবহার করা হবে। চিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করার এই বিপজ্জনক উদ্যোগের ভয়াবহতা আদৌ সবাই বুঝতে পারছেন কি না, সেটা অবশ্য একটা বড় প্রশ্ন। অন্তত সে রকম কোনো প্রতিক্রিয়া এখনো চোখে পড়েনি। অথচ সরকারের বিরোধিতা বা সমালোচনাকে ইতিমধ্যে রাষ্ট্রদ্রোহের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা হয়েছে। এ ধরনের ছাঁকনি যেসব দেশ প্রয়োগ করে, সেগুলো হয় কর্তৃত্ববাদী নয়তো স্বৈরতান্ত্রিক অথবা রাজতান্ত্রিক দেশ। চীন, উত্তর কোরিয়া, কম্বোডিয়া কিংবা সৌদি আরবের সারিতে বাংলাদেশকে দাঁড় করানোর চিন্তা কোনোভাবেই সমর্থন করা যায় না।
সাংবাদিক নেতাদের ভাষ্যমতে, হেলমেটধারী এবং পুলিশের হামলায় এবার অন্তত ২৪ জন সংবাদকর্মী আহত ও লাঞ্ছিত হয়েছেন। তথ্যমন্ত্রী অবশ্য এসব আহত সাংবাদিকের চিকিৎসার দায়িত্ব সরকার গ্রহণ করবে জানিয়ে হামলাকারীদের চিহ্নিত করে বিচারের আশ্বাস দিয়েছেন। তবে হামলাকারীদের কয়েকজনের পরিচয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলেও কেউ গ্রেপ্তার হননি। অতীতের অভিজ্ঞতার কারণে এ ক্ষেত্রে আশাবাদী হওয়া যাচ্ছে না। তবে হামলা এবং হামলাকারীদের বিচারের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে তা হচ্ছে অবাধ তথ্যপ্রবাহে বাধা সৃষ্টি এবং নিয়ন্ত্রণ আরোপের চেষ্টা। বেসরকারি চ্যানেলগুলোর ওপর যে নির্দেশনা জারি হয়েছে, কেউ কি তার প্রতিবাদ জানিয়েছেন? তা প্রত্যাহার দাবি করেছেন? নাকি অনুগ্রহনির্ভর লাইসেন্স রক্ষাই এখন সবচেয়ে বড় বিষয়? গণমাধ্যমের মালিক এবং সংবাদকর্মীরা দলগত বিভাজনের ঊর্ধ্বে উঠতে না পারলে নিয়ন্ত্রণের এই বাঁধন ক্রমেই আরও শক্ত হবে।
ব্রিটিশ দার্শনিক ও লেখক এ সি গ্রেলিং বলছেন পোস্ট-ট্রুথ বুদ্ধিবৃত্তিক সততাকে দুর্নীতিগ্রস্ত করে। আমাদের দেশেও তা একেবারে বিরল কিছু নয়। গ্রেলিং হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন পোস্ট-ট্রুথ বাস্তবতা গণতন্ত্রের পুরো কাঠামোকে ধ্বংস করে দিতে পারে। গণতন্ত্রকে বাঁচাতে হলে কথিত ভালো গুজবকেও প্রশ্রয় দেওয়া ভুল হবে।
কামাল আহমেদ: সাংবাদিক