ধর্ষণ একটি মানবতাবিরোধী অপরাধ। সামাজিক বয়ানে এবং রাষ্ট্রীয় আইনে একটি গুরুতর অপরাধ। কিন্তু এই অপরাধের ক্ষেত্রে অপরাধের শিকার নারী যখন এই অপরাধের বিচার চায়, তখন তাকে যেতে হয় ধর্ষণ প্রমাণের রাষ্ট্রের বাতলে দেওয়া পুরুষালি পথ ধরে। কোনটি ধর্ষণ হিসেবে বিবেচিত হবে আর কোনটি হবে না, সেটির চরিত্রও নির্ধারিত হবে এই সমাজ, এই রাষ্ট্র কোনটিকে ধর্ষণ হিসেবে দেখতে চায় আর কোনটিকে চায় না তার মধ্য দিয়ে।
৯ অক্টোবর ধর্ষণের শিকার ক্ষতিগ্রস্ত নারীর ক্ষেত্রে হাতের দুই আঙুলের মাধ্যমে (টু ফিঙ্গার টেস্ট) ধর্ষণ পরীক্ষার পরিবর্তে একটি নীতিমালা করতে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। হাইকোর্ট এ জন্য একটি কমিটি গঠন করতে বলেছেন। কমিটিকে তিন মাসের মধ্যে খসড়া নীতিমালা আদালতে দাখিল করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। দুই আঙুলের মাধ্যমে ধর্ষণ পরীক্ষা পদ্ধতির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ৮ অক্টোবর ব্লাস্ট, আসক, মহিলা পরিষদ, ব্র্যাক, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন, নারীপক্ষসহ দুই চিকিৎসক রিট আবেদনটি করেন। এতে দুই আঙুলের মাধ্যমে ধর্ষণ পরীক্ষার পদ্ধতিকে সংবিধানের ২৭, ২৮, ৩১, ৩২ ও ৩৫(৫) ও সাক্ষ্য আইনের ১৫৫ ধারার পরিপন্থী দাবি করা হয়।
গত ১৬ এপ্রিল ধর্ষণ ও ধর্ষণের শিকার নারীর বয়স নির্ধারণের জন্য ফরেনসিক পরীক্ষা পুরুষ চিকিৎসক দিয়ে করানোকে কেন অবৈধ ও বেআইনি ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন আদালত। একই সঙ্গে এই বিষয়ে ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ও ফরেনসিক বিভাগের প্রধানকে ২৮ এপ্রিল তলব করেছিলেন আদালত। একে ধর্ষণের অভিজ্ঞতা, তারপর ধর্ষণ প্রমাণ করার পরীক্ষা হিসেবে মেডিকেল পরীক্ষার নিপীড়ন, বিরক্তি, অস্বস্তি কিংবা আপত্তি। কোনো কিছুকেই আমলে নিতে এত দিন অস্বীকৃতি জানিয়ে প্রশ্নাতীতভাবেই জারি রাখা হয়েছিল দীর্ঘদিন ধরে চর্চিত পুরুষালি ধর্ষণ প্রমাণের প্রক্রিয়াটি। গত ১৬ এপ্রিল প্রথম আলোর একটি প্রতিবেদন বলেছে, ‘ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগে কোনো নারী চিকিৎসক, কোনো নারী নার্স এমনকি কোনো আয়াও নেই। এমনকি নারীর শারীরিক পরীক্ষার জন্য কোনো পৃথক কক্ষও নেই। চিকিৎসকদের বসার কক্ষের সামনের বারান্দায় একটি টেবিল রাখা। পুরুষ চিকিৎসক পুরুষ ওয়ার্ডবয়ের সাহায্যে সেই টেবিলের ওপর ধর্ষণের শিকার নারীকে রেখে তাঁর পরিধেয় কাপড় খুলে শারীরিক পরীক্ষা করেন। সবুজবাগ থানার এসআই বিকাশ কুমার ঘোষ আদালতের নির্দেশে বয়স নির্ধারণের জন্য একটি মেয়েকে ফরেনসিক বিভাগে আনলে খোলা বারান্দার টেবিলের ওপর পুরুষ ওয়ার্ডবয় আগত নারীটির কাপড় খুলতে শুরু করলেই তিনি চিৎকার করে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন।’
কেন এই ফিঙ্গার টেস্ট বাতিল হওয়া জরুরি? বলার অপেক্ষা রাখে না যে প্রচলিত ধর্ষণের মেডিকেল পরীক্ষার ফরমেট নিজেই একটি পুরুষালি মতাদর্শিক উৎপাদন। ব্যবহূত টু ফিঙ্গার টেস্ট ধর্ষণের সারভাইভার নারীর যোনিপথের ঘনত্ব পরিমাপ করে, তার হাইমেনের উপস্থিতি-অনুপস্থিতি নির্দিষ্ট করে। চিকিৎসাপদ্ধতি অনুযায়ী পরীক্ষার সময় নারীর হাইমেনকে একটি গোলাকার ঘড়ির ফ্রেম হিসেবে দেখা হয়। ঘড়ির কাঁটার ৩ বা ১০-এর অবস্থানে যদি ধর্ষিতার হাইমেন ছেঁড়া থাকে, তবে চিকিৎসক ধরে নেন, এখানে জোরাজুরি বা অসম্মতির সেক্স হয়নি। আর যদি হাইমেন নিচের দিকে অর্থাৎ ঘড়ির কাঁটার ৫ অথবা ৮-এর দিকে ছিঁড়ে, তবে চিকিৎসক এটা ঘোষণা করেন যে এই হাইমেন ছেঁড়ায় জোরারোপ করা হয়েছে। পাশাপাশি টু ফিঙ্গার টেস্টে ব্যবহূত চিকিৎসকের হাতের আঙুল তাঁর শরীরের আকার, গড়ন ইত্যাদির ভেদে ভিন্ন হওয়াই স্বাভাবিক। ফলে এই ভীষণ সাবজেকটিভ পরীক্ষণপদ্ধতি কখনোই নারী শরীরের ভিন্নতর গঠন বাস্তবতাকে নির্ণয় করার কোনো ক্ষমতা রাখে না। মেডিকেল পরীক্ষার সময় ধরেই নেওয়া হয় যে ধর্ষণ হতে পারে রাতের আঁধারে, অস্ত্রের মুখে, অচেনা মানুষ কর্তৃক এবং ‘হাইমেন অক্ষত থাকা’ সমাজের ‘কুমারী’ নারীর সঙ্গে, যা কিনা নিচের দিকে, নতুন করে হাইমেন ছিঁড়লে এবং যোনিপথ শক্তপোক্ত হলেই কেবল ঘটতে পারে। ফলে যে নারীর হাইমেন আগে ছিঁড়েছে, সে যে কারণেই হোক মেডিকেল এভিডেন্স তার প্রসঙ্গে ‘হাইমেন ওল্ড রেপচার’, ‘হেবিচুয়েট টু সেক্স’ এই বিশেষণগুলো ব্যবহার করবে। আর কোর্টে মেডিকেল পরীক্ষার এই ওল্ড রেপচার, হেবিচুয়েট টু সেক্স বিশেষণগুলো নারীর পূর্বেকার যৌন ইতিহাসের বয়ান হাজির করে, বিচারকক্ষে ধরে নেওয়া হয়, নারীটি আগেও যৌনকাজে লিপ্ত হয়েছে। ফলে তার ‘সতীত্ব’ নেই, পুরুষালি আইনি পরিসর ধর্ষকের তরফ থেকে নারীর ধর্ষণকেন্দ্রিক অসম্মতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করার সুযোগ তৈরি করে দেয়। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, টু ফিঙ্গার টেস্ট কোন বয়সের ধর্ষণের শিকার নারীর সঙ্গে সম্পাদন করা যাবে, এ নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা প্রণীত হয়নি, আর তাই মেডিকেল পরীক্ষার সনদে আট, ছয় এমনকি পাঁচ বছরের মেয়েশিশুও (টু ফিঙ্গার টেস্টের পরে) ‘হাইমেন ওল্ড রেপচার,’ হেবিচুয়েট টু সেক্স—এই বিশেষণে বিশেষায়িত হতে পারে। আর বিবাহিত হলে তো কথাই নেই, সে ক্ষেত্রে ধর্ষণ প্রমাণ করা অত্যন্ত কঠিন বা হাইমেন পরীক্ষার সাপেক্ষে ধর্ষণ প্রমাণ করা সম্ভবই হবে না। হেবিচুয়েট টু সেক্স-এর সঙ্গে ধর্ষণ শব্দটি একেবারেই যেন মানা যায় না।
এখানে মতাদর্শিক বোধটি হলো, ধর্ষণ মামলার মেডিকেল সনদের সামগ্রিক পদ্ধতিগুলো ধর্ষণের শিকার নারীর প্রতি যৌন আক্রমণ, হয়রানি এবং নারীর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের ইতিহাস নয়, বরং নারীর অতীত যৌন ইতিহাস দেখতে আগ্রহী। তাই ধর্ষণ পরীক্ষার মেডিকেল টেস্টের পুরুষালি গলিতে নারীর এত দিনকার অস্বস্তিকর এবং পুনরায় নিপীড়নভিত্তিক বাধ্যতামূলক অবস্থান থেকে মুক্তি পেতে আদালতের এই নির্দেশনা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আমরা মনে করছি।
ফাতেমা সুলতানা ও জোবাইদা নাসরীন: লেখকদ্বয় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক। fatama.suvra@gmail.com, zobaidanasreen@gmail.com