'ক্রসফায়ারের' সংসদজয়ের পরে আর থাকে কী

বাঙালিকে যে যতই বাইপোলার ডিজঅর্ডার তথা দ্বিমেরুতে বিভক্ত জাতি বলুক, জায়গামতো একমত হতে আমরা জানি। এই জাতির সামনে যেকোনো বিষয় ফেলে দিন, তারা তাকে নিমেষে দুই ভাগ করে ফেলবে, নিজেরাও বিভক্ত হয়ে পড়বে। কিন্তু ক্রসফায়ারের বিষয়ে অনেকেই একমত।

সেই ঐকমত্যের প্রতীক হয়েছেন জাতীয় পার্টির নেতা কাজী ফিরোজ রশীদসহ অনেক সংসদ সদস্য। ‘ধর্ষণ মহামারি রূপ নিয়েছে’ বলে ক্রসফায়ারও মহামারি রূপ নিতে হবে বলে দাবি করেছেন তিনি। জাতীয় পার্টির ওই নেতার দাবি সমর্থন করেন আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা তোফায়েল আহমেদসহ আরও অনেকে। সংসদে এখন এঁরাই সরকারি ও বিরোধী দলের আসনে ভাগাভাগি করে বসেন। সংসদের প্রধান দুটি দলের নেতারা যখন ধর্ষককে পাওয়ামাত্র ক্রসফায়ারের পক্ষে, তখন একে জাতীয় ঐকমত্য বলাই যায়। সংসদ অধিবেশনের কার্যবিবরণীতে এই ঐতিহাসিক বক্তব্য লেখা থাকুক।

মাদকের বিরুদ্ধে যদি ‘ক্রসফায়ার’ দেওয়া যায় তাহলে ধর্ষণের বিরুদ্ধে সেই ওষুধ সেবন করা হবে না কেন? এমনটাই তাঁদের দাবি। মাদকের বিরুদ্ধে সেই যুদ্ধের প্রথম ১৩ দিনে ৯১টি লাশ পড়েছে। এর মধ্যে টেকনাফের নিরীহ কাউন্সিলর একরামও আছেন। কেউ কি বুকে হলফ দিয়ে বলতে পারবেন, মাদকের বিস্তার বা ব্যবসা কমেছে। বড় মাদকসম্রাটদের কি কিছু হয়েছে? মৌমাছির চাক অটুট রেখে এদিক-ওদিক কয়েক শ মৌমাছি মারায় রানি মৌমাছি ভয় পায় না। ভুল রাস্তায় জোর কদমে হাঁটাহাঁটি করলে শক্তি খরচ ছাড়া আর কিছু হয় না।

ফেসবুকেও অনেকেই এই ‘মাইরালা’ দাবির পক্ষে। এই ‘অধিকাংশ মানুষ’ জিনিসের দাম কমাতে ক্রসফায়ার চান, দুর্নীতি বন্ধে ক্রসফায়ার চান, ছিনতাই-রাহাজানি-হত্যা-সন্ত্রাস বন্ধেও ওই একই মোক্ষম ওষুধ: ক্রসফায়ারে হত্যা। অধিকাংশ মানুষের মনে কত রকম অনাচার সহ্য করার রাগ। বিচারহীনতার ফাঁদে পড়া মানুষ এখন জলদি বিচার চায়। সাজাপ্রাপ্ত আসামির হাসি কিংবা চিহ্নিত ধর্ষকের জামিনে বেরিয়ে পলায়ন যেখানে ‘স্বাভাবিক’, সেখানে মানুষ সবকিছুতে আস্থা হারায়। স্ববিরোধিতাটা এখানেই, যাঁদের কারণে অপরাধ বাড়ে আর অপরাধী ছাড় পায় তাদের কাছেই আমরা ন্যায্য ‘ক্রসফায়ার’ দাবি করি। যে হাত ন্যায়বিচার করে না, সেই হাত ন্যায্য-হত্যা করবে?

দ্বিতীয়ত, হত্যাতেই সমাধান যদি হতো, তাহলে যে এত ক্রসফায়ারের পরও সমস্যা বাড়ল কেন? দুর্নীতি, সন্ত্রাস, লুণ্ঠন বেড়েছে। বেড়েছে হত্যা ও ধর্ষণের মতো চরমতম অপরাধ। যে বিচারহীনতার সংস্কৃতির জন্য ক্রসফায়ার চাওয়া হচ্ছে, সেই ক্রসফায়ারই কি ঘুরে আবার বিচারহীনতাকে বাড়াচ্ছে না? ক্রসফায়ার তাই সমাধান নয়, বিচারহীনতার সংস্কৃতির বিকল্প নয়, বরং সেটাই হলো বিচারহীনতাকে স্থায়ী করার আরেক হাতিয়ার।

শাস্তি নিশ্চিত করায় কেবল ফল চাইলে হবে না। গাছের গোড়ায় পানিও দিতে হবে। ন্যায্য ও দ্রুত বিচার ক্রসফায়ার দিতে পারে না। কারণ, তা ন্যায্যও না, তদন্তমাফিক বিচারও না, তা হলো দ্রুত জীবন নেওয়ার কৌশল। এরই বেসরকারি রূপ হলো গণপিটুনি। শিশু থেকে নারীদের চোর বা ছেলেধরা সন্দেহে পিটিয়ে মারা হয়। এই কি ক্রসফায়ারেরই প্রতিবিম্ব না?

ন্যায্য বিচার চাইলে সরকার ও ব্যবস্থা অপরাধীর সহায় হতে পারবে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যদি অপরাধ ঠেকাতেই চায়, তাহলে ক্রসফায়ারের প্রয়োজনই হতো না। অপরাধের আগেই তাঁরা তাঁদের দায়িত্বনিষ্ঠা দেখাতেন। তদন্ত যাতে সঠিকভাবে হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে। বিচার যাতে দ্রুত হয়, সেই দায়িত্ব আইন মন্ত্রণালয়ের। গোড়ার এই ধাপগুলো যদি ভাঙা বা অকেজো হয়, সুবিচারের শেষ ধাপে কীভাবে যাব? ক-য়ের অপরাধে খ-য়ের মারা পড়া নিশ্চিতই বা করবে কে? জজ মিয়া বা জাহালমের মতো অসহায় মানুষ বেশি করে ফাঁসবে, উড়ে যাবে টাকা ও কানেকশনঅলা অপরাধীরা।

ক্ষুধার্ত প্রাণীর সামনে খাবার ছুড়ে দিলে তারা যেমন আর সব ভুলে যায়, তেমনি ধর্ষকের প্রতি ঘৃণায় মানুষ আর সব ভুলে তার মৃত্যুই চায়। আগুনের মধ্যে দাঁড়িয়ে মানুষ সবার আগে পানি চায়। ধর্ষণের আগুনে ক্রসফায়ার কি পানি? অন্তত রেকর্ড তা বলে না। ‘ক্রসফায়ার’পন্থী জনতার কেউ কি খেয়াল করেছেন, দেশে ‘ক্রসফায়ার’ যত বাড়ছে, হত্যা-খুন-ধর্ষণ ও দুর্নীতিও তত বাড়ছে? ‘ক্রসফায়ার’ তো বেশ কয়েক বছর ধরে চলছে। তাহলে কেন অপরাধ কমল না? ‘ক্রসফায়ার’ যে মানুষের হাতে মানুষের খুনকে স্বাভাবিক করে তুলেছে, মানুষকে জীবন নেওয়ায় অভ্যস্ত করে তুলেছে, সেই জিনিসটা এই চটজলদি বিচারবাদীরা খেয়াল করেন না। ‘ক্রসফায়ার’ যে এক রক্তপিপাসু জাতি তৈরি করেছে, সেই জাতির এক সন্তান চাপাতি-রামদা দিয়ে খুন করবে আর তার বদলা হিসেবে আরেক সন্তান বন্দুক দিয়ে গুলি করে তাদের মারবে, চোখের বদলে চোখ নেওয়ার এই নীতিতে যে সবাই ক্রমেই চোখ খুইয়ে অন্ধ হয়ে যাচ্ছি, সেই হুঁশ কি আছে?

ক্রসফায়ারের সারমর্ম হলো, অপরাধের তদন্ত ও বিচারকে আদালতের বাইরে নিয়ে যাওয়া। এই কাজ যেসব বাহিনী দিয়ে করা হবে, তারা কি হত্যায় অভ্যস্ত হয়ে উঠবে না? আইনের প্রতি শ্রদ্ধা, আইন নিজের হাতে তুলে না নেওয়ার কঠিন প্রতিজ্ঞা কি তাঁরা আর রাখতে পারবেন? এই প্রক্রিয়ায় প্রথমেই বলি হয় আইন, দ্বিতীয়ত বলি হয় নিরপেক্ষ তদন্ত, তৃতীয়ত নৈতিকতা, চতুর্থত জবাবদিহি। এভাবে কিছু পদাধিকারী ব্যক্তির হাতে যেকোনো মানুষের জান কবচের ক্ষমতা তুলে দেওয়া যায় না। ক্রসফায়ারে যাকে দেওয়া হচ্ছে, তিনিই প্রকৃত অপরাধী কি না, আইন-আদালত ছাড়া তা নিশ্চিত করা যাবে কী করে?

আইনপ্রণেতারা সংসদে গিয়েছেন আইন প্রণয়ন করতে। বিনা বিচারে হত্যা কি আইন সংগত? তাঁরা সংসদে আছেন আইনকে উন্নত ও কার্যকর করতে। অথচ তাঁদেরই নেতৃত্বস্থানীয়রা এখন আইনবিরোধী কথা বলছেন। বলতে হলে সংসদ থেকে পদত্যাগ করেই বলুন। বিনা বিচারে হত্যাই যদি সমাধান, তাহলে সংবিধানের কী হবে? এভাবে সাংসদেরা যদি আইন ও সংবিধানের বাইরে হাঁটতে চান, তাহলে সংসদেরই বা থাকার দরকার কী?

হত্যার অপরাধ দিয়ে ধর্ষণের অপরাধ কমবে, সেই আশা করা মানে বিষ খেয়ে জীবন বাঁচবে বলে বিশ্বাস করা।

বিএনপি আমলের ক্লিনহার্ট-ক্রসফায়ার উন্নয়নের ছোঁয়ায় এখন বন্দুকযুদ্ধ, ‘এনকাউন্টার’ নাম পেয়েছে। প্রায় দেড় যুগ হয়ে গেল, না মাদক কমল না অপরাধ কমল, না ধর্ষণ কমল। আপনি রাজনীতি ঠিক করুন, আপনি ঘরে-বাইরে নিরাপত্তার দায়িত্ব নিন, আপনি পুলিশ প্রশাসনকে দ্রুততম সময়ে নিরপেক্ষ তদন্তে বাধ্য করুন, আপনি আদালতকে গতিশীল করুন, আপনি শাস্তিপ্রাপ্তর সাজা ভোগ নিশ্চিত করুন, তাহলেই পরিস্থিতি অনেক দূর এগিয়ে যাবে। মানব ইতিহাসের অভিজ্ঞতা বলে, ধর্ষণ ও হত্যা কখনোই শতভাগ নির্মূল হবে না। আইন, সভ্যতা, শাসন ছাড়া মানুষ মূলত পশু। এই পশুকে মানবিক করে তোলা ও সামাজিক রাখাটা রাষ্ট্রেরও কাজ, সমাজেরও কাজ। সব দায়িত্ব রাষ্ট্রকে চাপিয়ে সমাজ নিজেকে বাঁচাতে পারবে না। মানুষের অপরাধপ্রবণতা আরও বাড়ে, যখন হত্যার জবাবে হত্যাকেই স্বাভাবিক করে তোলা হয়।

ফারুক ওয়াসিফ: প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক।
faruk.wasif@prothomalo.com