শনিবার পুরো দিনটি তোলা ছিল নারীদের জন্য, যেমন বছরের একটি দিন তোলা থাকে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য, যদিও এ দুই দিন নারী ও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের অবস্থার কোনো হেরফের হয় না। শনিবারজুড়ে নারীরা অত্যাচার সয়েছেন ঘরে, অপমান সয়েছেন বাইরে, অধিকারবঞ্চিত হয়েছেন ঘরে ও বাইরে। অবশ্য এদিন তাঁদের নিয়ে নানা অনুষ্ঠান হয়েছে, গোলটেবিল-টক শো হয়েছে। অনেক ভালো কথা বলা হয়েছে, অনেক আশাবাদ ব্যক্ত হয়েছে। কিন্তু দিনশেষে নারীরা রয়ে গেছেন সেই পুরোনো তিমিরেই। ভালো কথার প্রয়োজন যে নেই, তা নয়; যথেষ্টই আছে। কিন্তু যাঁরা ভালো কথা বলেন, তাঁদের বেশির ভাগই তা কাজে প্রমাণ করার সুযোগ পান না। যাঁদের সে সুযোগ আছে, তাঁরা কাজ থেকে কথা বলাটাকেই বেশি পছন্দ করেন। ফলে কাজের সঙ্গে কথার সংযোগটা হয় না। এই না হওয়াটা আর দশটা ক্ষেত্রেই যেখানে প্রায় একটা প্রথায় দাঁড়িয়ে গেছে, সেখানে নারীদের উন্নয়নে কোনো কাজ না হওয়াটা তো আর অস্বাভাবিক কিছু নয়। বলা যায়, আমাদের প্রকৃতিগত অসামর্থ্যের মধ্যেই তা এখন পড়ে গেছে।
এই শনিবার (৮ মার্চ), আর সব বছরের মতো নারীদের ওপর জোরালো আলো ফেলেছে মিডিয়া। তাঁদের অবস্থা নিয়ে শিরোনাম হয়েছে। ‘কেমন আছেন নারীরা’ অথবা ‘নারীমুক্তি কত দূর’—এ রকম প্রতিবেদন-নিবন্ধ ইত্যাদি লেখা হয়েছে, আলোচনা অনুষ্ঠান হয়েছে। এসবের বাইরে ছিল নারীদের অবস্থা তুলে ধরে কিছু পরিসংখ্যান। এ দেশে পরিসংখ্যান মোটামুটি নারী-অবান্ধব বলেই প্রমাণিত। কিন্তু এতটা পিলে চমকানো হবে কিছু পরিসংখ্যান, ভাবতে পারিনি। প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠায় একটি খবরের শিরোনাম ‘স্ত্রীকে মারার অধিকার পুরুষের আছে’! ভেতরের খবর হলো, আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণাকেন্দ্র, বাংলাদেশের এক গবেষণায় দেখা গেছে, শহর-গ্রামনির্বিশেষে পুরুষদের বিশ্বাস (গ্রামে ৮৯%, শহরে ৮৩%), স্ত্রীকে মার দেওয়া যায়। উদরাময় গবেষণাকেন্দ্র আরেকটু খোঁজ নিলে দেখতে পেত, অনেক নারীও বিশ্বাস করেন, তাঁদের প্রহার করাটা স্বামীদের অধিকারের মধ্যে পড়ে। এর একটা কারণও সেই উদর—একটি প্রচলিত প্রবাদে তো বলাই আছে, পেটে খেলে পিঠে সয়। স্বামীর অন্নে উদর একটুখানি পূর্তি হচ্ছে, এখন তাঁর পিঠে কিল-ঘুষি মেরে ফুর্তি করাটা তো স্বামীপ্রবরের বিরাট একটা অধিকার।
উদরাময় গবেষণাকেন্দ্র আরও অনেক পরিসংখ্যান দিয়েছে, যেমন শহরের ৬৯ শতাংশ আর গ্রামের ৭৮ শতাংশ পুরুষ মনে করেন, যৌনতার বিষয়টি নারীর চেয়ে পুরুষের বেশি দরকার। এক নারী বলেছেন, ‘মেয়েমানুষের জীবনে বিয়া একবারই হয়’, যদিও পুরুষের ক্ষেত্রে ওই সীমাবদ্ধতা নেই। তবে শুধু বাংলাদেশে নয়, নারীরা বিপন্ন পশ্চিমেও। রয়টার এক গবেষণার বরাতে জানাচ্ছে, ইউরোপে তিনজন নারীর একজন যৌন হেনস্তার শিকার। সেসব দেশে উদরপূর্তি কোনো সমস্যা নয়, তার পরও অনেক নারীকে হেনস্তা সইতে হচ্ছে। তবে তফাতটা এই, পশ্চিমে আইন আছে, আইনের প্রয়োগ আছে (আমাদেরও আইন আছে, যদিও প্রয়োগ নেই); পশ্চিমে ধর্মের নামে কেউ মেয়েদের ওপর চড়াও হয় না, এবং নির্যাতন সয়ে হাড়মাস কালা না করে একটা সমাধান মেয়েরা নিজেরাই খুঁজে নিতে পারে।
৮ মার্চ প্রথম আলো ৬ মার্চের একটি ছবিকে প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপিয়েছে। ছবিটি বাংলাদেশের মহিলা ক্রিকেট দলের। পাকিস্তানি মেয়েদের দুই খেলায় হারিয়ে এই প্রথম তারা জ্বলে ওঠার পরিচয় দিল। যেদিন বাংলাদেশের ছেলেরা হারল পাকিস্তানের কাছে, সেদিনও মেয়েরা জিতল। কিন্তু পরদিন ওই হেরে যাওয়া ছেলেদের ছবিটাই প্রথম পৃষ্ঠাজুড়ে ছাপা হলো। বিজয়ী মেয়েদের পাঠিয়ে দেওয়া হলো খেলার পাতায়। ছোট্ট একটি ছবি। ভাবটা এমন, মেয়েরা তো! মেয়েরা মেয়েরা খেলেছে, তা আর এমন কী।
আমি আশা করেছিলাম, হারতে হারতে দিশেহারা ছেলেদের খবরটা প্রতিটি পত্রিকায় যাবে খেলার পাতায়, ছোট্ট একটা ছবি ছাপা হবে। আর মেয়েদের ছবিটা থাকবে প্রথম পাতাজুড়ে। কিন্তু এটাও জানি, ছেলেদের খেলা দেখেছে সারা দেশ। এর ‘খবরমূল্য’ অনেক বেশি। কিন্তু এই খবরমূল্য তো আরোপিত। বরং খবরমূল্য নির্ধারকেরা একটু ভাবলেই দেখতেন, মেয়েরা শুধু একটি বিদেশি দলের সঙ্গেই জেতেনি, জিতেছে আরও অসংখ্য প্রতিপক্ষের সঙ্গে। এসব প্রতিপক্ষ পাকিস্তানি মেয়েদের থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী—এর একটি হচ্ছে রক্ষণশীলতা, যার দেয়াল আমাদের মিডিয়াও ভাঙতে পারে না। মেয়ে ক্রিকেটাররা খেলে টাকা পায় না, ছেলেরা পায়। মেয়ে ক্রিকেটাররা ছেলেদের মতো স্পনসরশিপ পায় না। তারা খেলে একটা ব্যক্তিগত ভালোবাসা, নিষ্ঠা ও জেদ থেকে। এই মেয়েগুলো স্কুল-কলেজের কত অসংখ্য মেয়েকে যে অনুপ্রাণিত করেছে, তার একটা হিসাব নিলে অবাক হতে হবে। না, অনুপ্রাণিত এসব প্রত্যেক মেয়েই যে ক্রিকেট খেলবে, তা নয়, তবে তারা বড় বড় প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে জয়ী হওয়ার স্বপ্ন দেখবে। নিশাত-ওয়াসফিয়াকে দেখে অনেক মেয়ে এভারেস্টে চড়ার স্বপ্ন দেখছে; তাদের পাঁচজনও শেষ পর্যন্ত বেস ক্যাম্প অতিক্রম করবে কি না সন্দেহ। কিন্তু নিজেদের জীবনের এভারেস্ট শৃঙ্গগুলো যদি তারা জয় করতে নামে, এবং অর্ধেক অর্জনও যদি তাদের করতলগত হয়, সেটিই হবে অনেক পাওয়া।
অনেকে হয়তো বলবেন, মেয়ে ক্রিকেটারদের ছোট্ট একটি বা দুটি জয়কে এত বড় করে দেখার কী আছে। হয়তো তা-ই, হয়তো মাঠের জয়টা ছোট্টই। দলটা যে ৮ মার্চের টি-টোয়েন্টি খেলায় হেরে গেছে, সেটাও তো ঠিক। কিন্তু অন্যরা যেখানে মাঠের জয় দেখছে, আমি দেখছি ভিন্ন সব জয়। যেসব জয়ের তালিকা এখানে না দিলেও চলে। একটুখানি ভাবলেই সেগুলোর হদিস মিলবে। আমাদের জীবনের প্রতিদিনের বাস্তবতাতেই সেগুলো আছে।
২. পিলে চমকানো পরিসংখ্যান অবহেলা করার সুযোগ নেই। কিন্তু এসব মেনে নিয়ে চুপ করে বসে থাকারও কারণ নেই। এ রকম বসে থাকলে খারাপ পরিসংখ্যানের দৈত্যরা সারা দেশে দাবড়ে বেড়াবে।
এই দৈত্যদের বোতলে ভরতে হবে। এবং সে জন্য একটা পরিবর্তন প্রয়োজন। পরিবর্তনটা অসম্ভব কিছু নয়, কঠিন হলেও। সমাজতত্ত্ববিদ, আইনজ্ঞ, জেন্ডার বিশেষজ্ঞ অথবা অর্থনীতিবিদেরা তাঁদের মতো করে বলবেন এই পরিবর্তনের সম্ভাবনার কথা—সমাজ, আইন, লিঙ্গসমতা অথবা অর্থনীতির ক্ষেত্রে, তৃণমূলের মানুষ বলবেন তাঁদের মতো করে তাঁদের প্রতিদিনের জীবনের অভিজ্ঞতায়। আমি পেশায় একজন শিক্ষক, আমি ধারণা করতে পারি, শিক্ষার কোন জায়গাটাতে পরিবর্তন এলে নারীর জীবনে পরিবর্তন আসতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় পার হতে হতে বদলে যাওয়া—এবং বদলে না যাওয়া—অসংখ্য শিক্ষার্থীকে আমি দেখেছি এবং তাদের মধ্যে ফারাকটা যে কোথায়, মোটামুটি তা ধরতে পেরেছি। এবং ধরতে পেরে ক্রমেই আশাবাদী হচ্ছি।
৮ মার্চ প্রথম আলোর ভেতরের পাতায় একটি ছবি ছাপা হয়েছে ‘আঁধার ভাঙার শপথ’ নামে। শুক্রবার রাত ১২টার পর শনিবার শুরুর এক মিনিটের মাথায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে হাজারো নারী আঁধার ভাঙার শপথ নেন। গভীর রাতে মোমবাতির আলোয় শহীদ মিনার আলোকিত হয়েছিল। তবে এই আলো উজ্জ্বল রাখতে যে বাতিটি শিখা চিরন্তনের মতো জ্বলতে পারে, তা হচ্ছে শিক্ষা। এই একটা জায়গাতেই আমরা সমাধান খুঁজতে পারি, এবং পেতে পারি আমাদের অসংখ্য সমস্যার।
ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগ করেন লাভের জন্য। যদি এমন হয়, লাভ আসবে বিনিয়োগের কয়েক শ গুণ, তাহলে জমি বিক্রি করে, ধার-কর্জ করে বিনিয়োগের টাকাটা তাঁরা জোগাড় করবেন। সেই বিনিয়োগ ফুলে-ফেঁপে লাভ হয়ে ঘরে এলে তা দিয়ে করা যায় আরও বিনিয়োগ। শিক্ষা হচ্ছে তেমন এক জায়গা, যেখানে যা বিনিয়োগ হয়, তা থেকে লাভ আসে হাজার গুণ বেশি। অথচ আমরা সেই বিনিয়োগে কোনো উৎসাহ পাই না। অবাক!
এমন না তো বাঙালি এখনো ব্যবসা বোঝে না, এককালে না বুঝলেও। এখন সংসদে বসেন যাঁরা, অর্ধেকেরই বেশিই তো ব্যবসায়ী। তাহলে এই সহজ সমীকরণটা কেন তাঁরা আমলে আনেন না?
আমাকে যদি তাঁদের কেউ জিজ্ঞেস করতেন, কত বিনিয়োগে কী লাভ, আমি বলতাম, শিক্ষাক্ষেত্রে ‘বরাদ্দ’টাকে প্রথমেই বিনিয়োগ হিসেবে ভাবেন। তারপর অঙ্ক কষে দেখাতাম, যদি প্রতিবছর শিক্ষাক্ষেত্রে বর্তমান বরাদ্দের কয়েক গুণ আমরা বিনিয়োগ করি, তাহলে দুই প্রজন্মের মধ্যেই লাভ আসবে ভরা বর্ষায় মেঘনার স্রোতের মতো। কিন্তু এই স্রোত যে দুই পর্যায়ের নানা অচলায়তন, রক্ষণশীলতার নানা স্থাপনা, বিভাজনের নানা দেয়াল ভাসিয়ে নিয়ে যাবে, সেগুলোর আনুমানিক অর্থমূল্য (বাজার অর্থনীতিতে দেখেছি সন্তানের প্রতি মায়ের যত্নেরও অর্থমূল্য হিসাব করা হয়!) ধরলে এই লাভ তো সারা দেশে উর্বর পলি ছড়িয়ে দেবে। চক্রবৃদ্ধির সুদের কথা শুনেছি, এ লাভ হবে চক্রবৃদ্ধির। পাহাড় থেকে গড়িয়ে নামা বরফের গোলকের মতো, যত নিচে গড়াবে, তত আকৃতিতে বাড়বে।
শুরুটা করতে হবে গোড়াতেই। সেই প্রাথমিক পর্যায়ে। শ্রীলঙ্কার গল্প বলি, শ্রীলঙ্কার গ্রামের স্কুলে গিয়েছি, শহরের স্কুলে গিয়েছি, কোনো পার্থক্য নেই, গ্রামের স্কুলে যে শিক্ষা পায় ছেলেমেয়েরা, তা দিয়ে বিশ্বজয় করতে পারে। সঙ্গে আছে সংস্কৃতির তালিম, ভদ্রতা আর সৌজন্যের পাঠ। বইয়ের প্রতি ভালোবাসা ছড়িয়ে দেওয়া। দেশটির ক্রিকেট দল যে আমাদের ছেলেদের বেধড়ক হারায়, তার মূলে গোড়ার সেই শিক্ষা। আত্মবিশ্বাস, নিয়মানুবর্তিতা। স্থির লক্ষ্যে থেকে নিজের কাজটি করে যাওয়া।
প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিনিয়োগ হোক। সেই বিনিয়োগে কেউ প্রশ্ন না তুলুক। প্রতিরক্ষা, যোগাযোগ, স্বরাষ্ট্র আগে না শিক্ষা আগে, এ নিয়ে কোনো কথা না উঠুক, শিক্ষকদের বেতন দেওয়া হোক সরকারের তথাকথিত ‘সামর্থ্যের’ বাইরে গিয়ে। বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, সাহিত্য-দর্শন শেখানো হোক শিক্ষার্থীদের, আনন্দিত পাঠদান হোক, খেলাধুলা, নিয়মানুবর্তিতা, গান-আবৃত্তি-ছবি আঁকা সব শেখানো হোক। শিশুরা লিঙ্গবিভাজনকে জীবনের প্রথম শর্ত হিসেবে দেখে না, সমাজই একসময় তাদের তা শিখিয়ে দেয় এবং পুরুষেরা যে শ্রেয়, সেই মন্ত্রও। জীবনের শুরুতেই যদি শিশুদের শিক্ষাটাকে আমরা আনন্দময় গ্রহণের এবং ভবিষ্যৎ নির্মাণের লক্ষ্যে জাতির শ্রেষ্ঠ বিনিয়োগ হিসেবে নিশ্চিত করতে পারি, তাহলে একদিন আসবে, যেদিন ৮ মার্চ খারাপ পরিসংখ্যানের দৈত্যগুলোকে সত্যি সত্যি বোতলে ভরতে পারব আমরা। এই বিনিয়োগই হতে পারে আমাদের আঁধার ভাঙার শপথ।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক। অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।