কোটা বিতর্ক

২০ ভাগ কোটা ৮০ ভাগ মেধা

বিসিএস পরীক্ষায় কোটার পক্ষে-বিপক্ষে নানা ধরনের বিতর্ক চলছে। আমি কোটার বিপক্ষে এ কারণে যে সর্বত্রই মেধার প্রতিযোগিতা থাকা দরকার। বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে এগিয়ে যেতে হলে প্রতিদ্বন্দ্বিতার বোধ রাষ্ট্রের সর্বত্রই থাকতে হবে। যারা যোগ্য, দক্ষ ও মেধাবী, তারাই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকবে এবং যোগ্যতা, দক্ষতা ও মেধার ভিত্তিতেই তারা সবচেয়ে ভালো চাকরি পাবে এবং রাষ্ট্রকে তারা এগিয়ে নিয়ে যাবে। চাকরির বাছাই-প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে চাকরি প্রাপ্যতা—সবই হওয়া উচিত মেধার ভিত্তিতে।
কিন্তু আবার কিছু ক্ষেত্রে আমি কোটার পক্ষেও। আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজকাঠামো এখনো শ্রেণীবিন্যস্ত। এখানে নারী-পুরুষে বৈষম্য রয়েছে, জাতিতে জাতিতে বৈষম্য আছে। কাজেই যতক্ষণ পর্যন্ত রাষ্ট্র ও সমাজকে আমরা বৈষম্যমুক্ত করতে না পারব, ততক্ষণ এ শ্রেণীবিন্যস্ত সমাজব্যবস্থায় কিছু ক্ষেত্রে কোটাব্যবস্থা রাখতে হবে, যারা পিছিয়ে পড়েছে অথবা যাদের পিছিয়ে রাখা হয়েছে, তাদের জন্য কোটা থাকা উচিত, যেমন আদিবাসী।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার পক্ষ থেকে এ বিষয়ে একটি গবেষণা করতে গিয়ে আমি জানার চেষ্টা করেছিলাম, আদিবাসীদের পিছিয়ে পড়ার কারণ কী? দেখেছি তারা খুবই প্রান্তিক অবস্থায় থাকে; একটি প্রান্তিকতা হলো তাদের অর্থনৈতিক সমস্যা বা অর্থনৈতিক দুরবস্থা আর অন্যটি হলো আদিবাসীরা যে অঞ্চলে বসবাস করে, সেটা অনেক দূরবর্তী ও দুর্গম অঞ্চল। সেখানে ভালো স্কুল, কলেজ নেই, ভালো শিক্ষকেরা সে অঞ্চলে যেতে চান না, ফলে ওই অঞ্চলের আদিবাসী ছেলেমেয়েরা দুর্বল স্কুল থেকে দুর্বল শিক্ষা নিয়ে বেরিয়ে আসে। কাজেই যত দিন পর্যন্ত রাষ্ট্র সবার জন্য প্রতিযোগিতার সমান সুযোগের জায়গা তৈরি না করবে, তাদের প্রতি সংবেদনশীল না হবে, তত দিন আদিবাসীদের জন্য কোটাব্যবস্থা থাকা উচিত এবং সেটি ৫ থেকে ১০ শতাংশে উন্নীত করা যেতে পারে।
আরেকটি কোটা থাকা দরকার, সেটি হলো নারী কোটা, তবে বেশি দিনের জন্য নয়। আদিবাসী কোটা যদি আরও ৩০ বছরের জন্য দরকার হয়, তাহলে নারী কোটা আমার মতে আর সর্বোচ্চ ১০ বছরের জন্য লাগবে। কারণ, নারীরা ইতিমধ্যে অনেকটা এগিয়ে আসা শুরু করেছে। এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় ছেলেদের তুলনায় তারা ভালো ফল করছে। পাসের হার নারীদের বেশি; ফলাফলের দিক দিয়েও তারা ছেলেদের চেয়ে ভালো করছে। গেল তিনটি বিসিএস পরীক্ষায় পর পর তিনবার প্রশাসন ক্যাডারে নারীরা প্রথম হয়েছেন।
আরেকটি কোটা থাকা যুক্তিসংগত, সেটি হলো প্রতিবন্ধী কোটা। কারণ, একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী তার হুইলচেয়ারে বসে এ দেশের প্রচলিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষা গ্রহণের জন্য যেতে পারে না। আবার একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীর জন্যও শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়নি। তাই কমপক্ষে ৫ শতাংশ প্রতিবন্ধী কোটা বিসিএস চাকরিতে থাকা উচিত। সব মিলিয়ে বলা যায়, আদিবাসী ১০ শতাংশ, প্রতিবন্ধী ৫ শতাংশ এবং নারী কোটা ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশে নিয়ে আসা যায়। অর্থাৎ সব মিলিয়ে সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ কোটাব্যবস্থা বিসিএস পরীক্ষায় থাকা উচিত, আর বাকি ৮০ শতাংশ আসন মেধার ভিত্তিতে পূরণ করা উচিত।
জেলা কোটা ও মুক্তিযোদ্ধা-পোষ্য কোটার বিরুদ্ধে আমার অবস্থান। জেলা কোটা জরুরি ভিত্তিতে বন্ধ করা উচিত এবং সবচেয়ে বিতর্ক যে কোটা নিয়ে, তা হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধা-পোষ্য কোটা, সেটাও বন্ধ করে দেওয়া উচিত। এখন মুক্তিযোদ্ধা কোটা নামে যে কোটা রাখা হয়েছে, এটা আসলে মুক্তিযোদ্ধা কোটা নয়, এটা মুক্তিযোদ্ধা-পোষ্য কোটা। মুক্তিযোদ্ধার ছেলেমেয়ের পর তাঁর ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনি—এভাবে বংশপরম্পরায় এ ব্যবস্থা চলতে থাকলে তা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যই অবমাননাকর হবে বলে মনে করি; যাঁরা দেশ স্বাধীন করেছেন এমন অনেক বড়-বিখ্যাত মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে আমি কথা বলে জেনেছি, তাঁরাও এ কোটা চান না। মুক্তিযোদ্ধাদের বড় পুরস্কার স্বাধীন বাংলাদেশ—কোটা বা এ রকম তুচ্ছ বিষয় তাঁদের জন্য পুরস্কার হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না। তাঁদের জন্য যেটা করা উচিত তা হলো, যে মুক্তিযোদ্ধারা এখনো বেঁচে আছেন তাঁদের রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ সম্মান দেওয়া, তাঁদের জন্য বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা, ভাতা দেওয়া, রাষ্ট্রীয়ভাবে শহীদ পরিবারের সদস্যদের জন্য বাড়তি কিছু করা, তাঁদের জায়গা-জমি দেওয়া হোক, কারও কোনো আপত্তি থাকবে না। কিন্তু তাঁদের ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনিদের জন্য এভাবে কোটাব্যবস্থা রাখা আত্মঘাতী হবে এবং মেধার প্রতি অশ্রদ্ধা করা হবে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আকবর আলি খানসহ কয়েকজন বিশেষজ্ঞ কোটা নিয়ে গবেষণা করেছেন। তাঁরা গবেষণায় পেয়েছেন, জেলা কোটা রাখার যৌক্তিকতা নেই। কিন্তু তাঁদের গবেষণায় এমন ৩৮টি উপজেলা পাওয়া গেছে, যেখান থেকে বিসিএসে চাকরিপ্রার্থীরা ভালো করছেন না এবং এটিও হয়েছে দুর্গম, প্রত্যন্ত তথা আঞ্চলিক প্রান্তিকতার কারণে। তাই জেলা কোটা বাদ দিয়ে পিছিয়ে পড়া এ ৩৮টি উপজেলাকে কীভাবে অন্তর্ভুক্ত করা যায়।
কোনো কোটা পূরণ না হলে অন্য জায়গা থেকে এনে কোটা পূরণ করা যাবে না—পিএসসির এ সিদ্ধান্তকে আমি সাধুবাদ জানাই। তবে শুধু কোটা রাখলেই চলবে না, কোটাগুলোর পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে হবে। যেমন প্রতিবছর কিছু কিছু করে যদি কোটা খালি থেকে যায়, তবে পাঁচ বছর পর পর সে কোটা পূরণের জন্য বিশেষ বিসিএস পরীক্ষা নেওয়া যেতে পারে। রাষ্ট্রকে সামনে তাকাতে হলে রাষ্ট্রের সর্বত্রই প্রতিদ্বন্দ্বিতার বোধ নির্মাণ করতে হবে; যোগ্য, দক্ষ ও মেধাবীদেরই সুস্থ প্রতিযোগিতায় নির্বাচন করতে হবে।
রোবায়েত ফেরদৌস: সহযোগী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
robaet.ferdous@gmail.com