সাভার ট্র্যাজেডি

হারানো অধিকার, হারানো জীবন

স্বজনের এ আহাজারি আর কত দিন?
স্বজনের এ আহাজারি আর কত দিন?

ঢাকার বাইরে, সাভারে রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপ থেকে শত শত নারীর লাশ উদ্ধার করে নিয়ে আসা হয়। তাঁদের মৃত্যুর বিবর্ণতার পিঠে উজ্জ্বল হয়ে ফুটে ছিল পরনের সালোয়ার-কামিজ আর শাড়ি। আর তখন রাজধানীতে ইসলামি চরমপন্থীরা বাস পোড়াচ্ছেন, দোকানপাটে লুটতরাজ চালাচ্ছেন এবং হামলা চালাচ্ছেন পুলিশের ওপর। তাঁদের প্রধান দাবি: একটি ইসলামি রাষ্ট্র, যেখানে নারীরা থাকবেন পুরুষ থেকে আলাদা।

কিন্তু তাঁরা অনুধাবন করতে পারেননি যে এসব নারীর মাধ্যমে বাংলাদেশের মূল সম্পদ আসে। বাংলাদেশের মূল আয়ের উৎস পোশাকশিল্প। এর মাধ্যমে এক হাজার ৯০০ কোটি ডলার অর্জিত হয়। আর পোশাকশিল্পের বিশাল অংশজুড়ে রয়েছেন নারী-কর্মীরা। হাড়ভাঙা খাটুনির মাধ্যমে এসব নারী

নিজের জীবিকার বাইরেও অনেকের জীবিকা টিকিয়ে রাখছেন; অথচ তাঁদের শ্রম-নিরাপত্তার রেকর্ড ভীতিকর।

দুই দশকের বেশি সময় ধরে দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব দুই নারীনেত্রীর মধ্যে ঘোরাফেরা করছে। এর পরও দেশটি, যা আমার স্বদেশ, নারীর ক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে।

ইসলামপন্থীরা ‘নাস্তিক ব্লগারদের’ ফাঁসির দাবিও তুলেছেন। এসব বিক্ষোভকারী ৮৪ জন ব্লগারের একটি তালিকা করে তাঁদের বিচার চাইছেন। অথচ বিক্ষোভকারীদের অনেকে কখনো ইন্টারনেটেই প্রবেশ করেননি। এই তালিকায় আরও নাম থাকতে পারত, কিন্তু রাজীব হায়দার নামের এক ব্লগারকে ইতিমধ্যে হত্যা করা হয়েছে। ছুরিকাঘাতে আহত হয়েছেন আসিফ মহিউদ্দিন।

এই ব্লগারদের মাধ্যমেই অনুপ্রাণিত হয়ে শত শত তরুণ রাস্তায় নেমে চরমপন্থীদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছেন। কিন্তু এ পথে নেমে তাঁরা নিজেরাই চরমপন্থীদের মতো আচরণ করছেন। যাঁদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ উঠেছে, তাঁদের সবার মৃত্যুদণ্ড দাবি করছেন তাঁরা। এখানে এসব তরুণ মূল জিনিস থেকে বিচ্যুত। তাঁদের কাছে এটা মনে হয়নি যে দোষী বা নির্দোষ সবার ক্ষেত্রে মানবাধিকার সমানভাবে প্রযোজ্য; এমনকি জঘন্য দুষ্কর্মকারীও একই সুযোগ পাবে।

রাজনৈতিক শ্রেণীর কথা আর কী বলব? প্রধান বিরোধী দল হিসাব-কিতাব করেই ইসলামপন্থীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে পড়েছে। তবে তা হয়েছে ক্ষীণদৃষ্টিসম্পন্ন বিপজ্জনক পদক্ষেপে। সরকারের ভূমিকা যা দেখা যাচ্ছে, তাতে বলছে একটা, করছে আরেকটা। সরকার একটি লৈঙ্গিক সমতার নীতি ঘোষণা করেছে। কিন্তু এ ব্যাপারে যে আইন, তা বৈষম্যে ভরা। তারা ইসলামি চরমপন্থীদের দোষ দিচ্ছে, কিন্তু গ্রেপ্তার করেছে চারজন ব্লগারকে (মহিউদ্দিনসহ)। এ ছাড়া ‘ইসলামের বিরুদ্ধে নেতিবাচক বিষয়ে উসকানি’ দেওয়ার অভিযোগ এনেছে সংবাদপত্রের একজন সম্পাদকের বিরুদ্ধে।

নিরাপত্তা আইনের লঙ্ঘন বা নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে নির্মাণকাজ, এসব দুর্নীতির বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি সরকার। এতে দেশের লাখ লাখ শ্রমিকের জীবন ঝুঁকির মুখে। রানা প্লাজার ভবনধসের ঘটনায় মৃতের সংখ্যা এক হাজার ছাড়িয়েছে (এক হাজার ১২৭ জনে পৌঁছেছে)। এর আগে একটি পোশাক কারখানা ভবনে আগুন লাগার ঘটনায় আটজন বা এর বেশি লোক মারা যান।

জীবনভর মানবাধিকারের পক্ষে কাজ করে আমি যা দেখেছি, তা হচ্ছে—বিভিন্ন সমাজ ও সম্প্রদায়ের মধ্যে জটিলতা যেমন বাড়ছে, এর সূত্র ধরে অধিকার নিয়ে বিভিন্ন ধরনের বিতর্ক তৈরি হচ্ছে। এতে আবার বৈচিত্র্য রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে রাজনৈতিক অধিকার, নারীর অধিকার, শ্রম অধিকার।

বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের অধিকারের মধ্যে যোগসূত্রটি আমাদের চোখের সামনে দৃশ্যমান: নারীর অধিকারের সঙ্গে শ্রম অধিকার, ধর্মীয় স্বাধীনতার সঙ্গে নারীর অধিকার, বিবেকের স্বাধীনতার সঙ্গে ধর্মীয় স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতার সঙ্গে বিবেকের স্বাধীনতা। আরও রয়েছে ব্লগারদের যা খুশি লেখার স্বাধীনতা। রয়েছে জীবনের ভয় না করে নারী ও পুরুষের কাজ করে যাওয়া।

মানবাধিকার বিশ্বজনীন। বাংলাদেশের কি এই দৃষ্টিভঙ্গি, সাহস আর রাজনৈতিক ইচ্ছা আছে—চার দশক আগে স্বাধীনতার সময় তারা যেমনটি করেছিল, সে রকম আজ মানবাধিকার রক্ষার অঙ্গীকার পুরোপুরি সম্পন্ন করবে? ১৯৭১ সালে আমার দেশের মানুষ কেবল ধার্মিকদের জন্যই লড়েনি, অধার্মিকদের জন্যও লড়েছে। ১৯৭১ সালে আমরা কেবল সাম্প্রদায়িক বৈষম্য দূর করার জন্য লড়িনি, লৈঙ্গিক বৈষম্য দূর করতেও লড়েছি। ১৯৭১ সালে আমরা সব মানুষের অধিকারের জন্য লড়েছি।

কিন্তু বাংলাদেশে সবার জন্য অধিকার অর্জিত হয়নি। রানা প্লাজার বিপর্যয় ও ইসলামপন্থীদের সহিংসতা পরস্পর গ্রন্থিত ব্যাধিরই অংশ। এর মধ্যে রয়েছে দুর্নীতি, রাজনৈতিক ফায়দা লোটা ও বিশ্বজনীন মানবাধিকারের অবমাননা। যখন আমি কেবল নিজের অধিকার দেখব, আপনারটা নয়, তখন কোনো মানবাধিকারই নিরাপদ নয়।

ইংরেজি থেকে অনূদিত

ষ আইরিন খান: ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ল অর্গানাইজেশনের মহাপরিচালক; সাবেক মহাসচিব, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।