মতামত

হামাসের ভবিষ্যৎ কী

খালেদ মেশাল
ফাইল ছবি

তাঁরা ইসরায়েলের দিকে ছুটছেন। যার নেতৃত্বে রয়েছেন মোহাম্মাদ বিন সালমান ও আমিরাতের ক্রাউন প্রিন্স বিন জায়েদ। আর পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ছেন ট্রাম্প ও তাঁর জামাতা কুশনার। কুশনারকে আধুনিক কালের ‘লরেন্স অব অ্যারাবিয়া’ বলা হয়। বাহরাইন, সুদানের পর সর্বশেষ মরক্কো এই পালে যোগ দিয়েছে। পূর্বপুরুষের প্রতিরোধ-সংগ্রামের ঐতিহ্য পরিহার করে তাঁরা ইসরায়েলের দখলদারিকে মেনে নিয়েছে। ত্যাগ করেছে ফিলিস্তিনিদের। তবে এই দেশগুলো এবং ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সংগঠিত পদ্ধতিতে প্রতিরোধের আন্দোলন জারি রাখার ঘোষণা দিয়েছে হামাস। হামাস অন্য আরব দেশগুলোর মতো ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করেছে।

হামাসের সরকার গঠনের এক বছরের মাথায় মার্কিনদের, বিশেষ করে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের অন্যতম রূপকার কন্ডোলিৎসা রাইসের পরামর্শে প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস হামাসের সরকারকে বরখাস্ত করেন।

সোভিয়েতের শেষ সময়ে ইয়াসির আরাফাত সংগ্রাম ছেড়ে আলোচনার পথে হেঁটেছিলেন। আকবর হোসেন ও এডওয়ার্ড সাইদের মতো খ্যাতিমান তাত্ত্বিকেরা তখন এই আলোচনার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। কারণ, আরাফাতের রণক্লান্তিতা এবং সার্বিকভাবে আন্দোলনের অগোছালো অবস্থার দরুন আলোচনার টেবিলে অত্যন্ত সুসংগঠিত পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে পেরে ওঠার সম্ভাবনা দেখছিলেন না এডওয়ার্ড সাইদরা। কিন্তু আরাফাত সাইদের কথায় কান দেননি। সেই যে ফিলিস্তিনিদের হেরে যাওয়া শুরু হয়েছে, তা আজ পর্যন্ত আর থামেনি। ‘আরব রাষ্ট্রগুলোর’ বিদ্বেষ এবং পশ্চিমা বিশ্বের, বিশেষ করে মার্কিন ও ব্রিটিশদের ইসরায়েলের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন ফিলিস্তিনিদের দুর্দশাকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে।
আরাফাতের এই আলোচনার ভবিষ্যৎ আন্দাজ করতে পেরে ফাতাহ ত্যাগ করেন একদল কর্মী, যাঁদের প্রচেষ্টায় ১৯৮৭ সালের প্রথম ইন্তিফাদা–পরবর্তী সময়ে তৎকালীন মুসলিম ব্রাদারহুডের সহযোগিতায় হামাস গাজায় আনুষ্ঠানিক রূপ পায়। ঘোষণা দিয়ে বিভক্ত হয়েছিল উপনিবেশবাদবিরোধী আন্দোলন। পরবর্তী সময়ে কখনোই ফাতাহ ও হামাসের সম্পর্ক জোড়া লাগেনি; বরং বিচ্ছেদ পোক্ত হয়েছে। ২০০৬ সালের নির্বাচনে হামাস ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধকে পুঁজি করে নির্বাচনে আরাফাতের ফাতাহকে হারিয়ে দেয়। নির্বাচনে ১৩২ আসনের মধ্যে হামাস ৭৬টি এবং ফাতাহ ৪৩টি আসন পায়। হামাসের সরকার গঠনের এক বছরের মাথায় মার্কিনদের, বিশেষ করে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের অন্যতম রূপকার কন্ডোলিৎসা রাইসের পরামর্শে প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস হামাসের সরকারকে বরখাস্ত করেন।

২০০৭ থেকে অবরোধের দরুন প্রায় ২০ লাখ মানুষের গাজা সুপেয় পানি, খাদ্য, শিক্ষা ও চিকিৎসার অভাবে পৃথিবীর বৃহত্তম উন্মুক্ত জেলখানায় পরিণত হয়েছে। কিন্তু ইসরাইল থামেনি। থামেনি ইসরায়েলের যুদ্ধযাত্রা। শেষকৃত্যও থামেনি। তবে গত ১০ বছরে হামাসের পরিবর্তন হয়েছে। মার্কিন–ঘোষিত মুসলিম ব্রাদারহুডসহ অন্যান্য ‘সন্ত্রাসী’ সংগঠন থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে নিয়েছে। কিন্তু ফল মিলেনি। অবরোধ ওঠেনি। তবে এবার হামাসকে উৎখাতের সুযোগ কবজা করেছে সৌদি-ইসরাইল-মার্কিন বলয়। সৌদি বলয় যেভাবে ‘স্বাধীন ফিলিস্তিনের’ দাবিকে অজুহাত বানিয়ে ইসরায়েলের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক স্থাপন করেছে, ঠিক একইভাবে অদূর ভবিষ্যতে ‘স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের’ জন্য হামাসই একমাত্র বাধা বলে ইসরাইল ও ফাতাহের মাধ্যমে হামাসকে গাজা থেকে উৎখাতের জন্য সৌদি বলয় সম্ভাব্য মঞ্চ প্রস্তুত করেছে। কয়েক বছর ধরেই এই সম্ভাব্য পরিস্থিতির আশঙ্কা করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা।

দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় ধরে ইসরায়েলি অবরোধের দরুন গাজায় সৃষ্ট মানবিক সংকট হামাসের দীর্ঘমেয়াদি আন্দোলনের জন্য আরামদায়ক হবে না। আর এই আন্দোলনের প্রতিপক্ষ ইসরাইল নয়, বরং ফাতাহ ও সৌদি বলয় হবে। তাই সাধারণ গাজাবাসীর সম্পূর্ণ সহযোগিতা আদায়ে হামাসের বেগ পেতে হবে। সম্ভাব্য এই যুদ্ধের ফলাফল হামাসের পক্ষে না যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।

মূলত, দুটি উপায় অবলম্বন করে সম্ভাব্য এ পরিস্থিতি তৈরি করা হচ্ছে। প্রথমত, সৌদি, কুয়েত, মিসরসহ পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোয় হামাসকে নিষ্ক্রিয় করা। আল–জাজিরার খবরে প্রকাশ, এই পরিকল্পনার দরুন গত কয়েক বছরে হামাসের কয়েক হাজার কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যাঁরা মূলত হামাসের অর্থের বিশাল অংশের জোগানদাতা। দ্বিতীয়ত, মোহাম্মাদ দাহলানকে ফাতাহের প্রধান নিয়োগ। আরাফাত গত হওয়ার পর থেকে ফাতাহের নিয়ন্ত্রণ আব্বাসের হাতে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ট্রাম্পের ‘শতাব্দীর চুক্তি’সহ আরবদের ইসরায়েলের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক স্থাপনকে অবৈধ ঘোষণা নিয়ে সৌদি বলয়ের চক্ষুশূল হয়েছেন আবু মাজেন। যার ফলে পশ্চিমারা আব্বাস–পরবর্তী সময়ে দাহলানকে ফাতাহের নেতৃত্বে চান। দাহলান একসময় ইয়াসির আরাফাতের সহযোদ্ধা ছিলেন। কিন্তু সংগ্রাম থেকে নিজেকে গুটিয়ে মার্কিন আশীর্বাদ নিয়ে দাহলান বর্তমানে আরব আমিরাতের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাড়িতে বসবাসের পাশাপাশি আমিরাতের ক্রাউন প্রিন্সের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছেন।
এই দুরূহ পরিস্থিতিতে হামাসের সামনে কয়েকটি পথ খোলা থাকবে।
প্রথমত, ফাতাহের সঙ্গে শান্তিচুক্তিতে আবদ্ধ হওয়া। সৌদি বলয়ের পক্ষ থেকে সম্ভাব্য সর্বপ্রথম এ শান্তিচুক্তির বিষয় সামনে নিয়ে আসা হবে। দাহলানের অধীনে এ ধরনের চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়ার অর্থই ইসরায়েলের দখলদারি মেনে নেওয়া এবং ইসরায়েলের অঙ্কিত রেখার মধ্যে বন্দী হওয়া, যা প্রায় তিন যুগ ধরে ফাতাহ করে আসছে। ফলাফল শূন্য। পশ্চিম তীর, রামাল্লা এবং নাবলুসের একটি বিশাল অংশ ধীরে ধীরে ইসরাইল দখল করে নিয়েছে।

দ্বিতীয়ত, প্রথম এবং একমাত্র শর্ত না মানলে সৌদি বলয়ের প্রকাশ্য রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবরোধের সম্মুখীন হবে হামাস। আদতে এই অবরোধ স্বল্প পরিসরে এক যুগ ধরেই বিদ্যমান। যদি এ অবরোধ সম্পূর্ণ সক্রিয় হয় এবং আঙ্কারায় ক্ষমতার পরিবর্তন ঘটে, তাহলে দোহার একার পক্ষে হামাসকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। তখন হামাসকে বাধ্য হয়ে সম্পূর্ণ ইরানমুখী হতে হবে, যা সম্পূর্ণভাবে সৌদি-ইসরায়েলের আক্রমণকে বৈধতা প্রদান করবে।
তৃতীয়ত, আন্দোলন জারি রাখা। সম্ভবত সবচেয়ে এই কঠিন কাজ হামাস করবে। কিন্তু দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় ধরে ইসরায়েলি অবরোধের দরুন গাজায় সৃষ্ট মানবিক সংকট হামাসের দীর্ঘমেয়াদি আন্দোলনের জন্য আরামদায়ক হবে না। আর এই আন্দোলনের প্রতিপক্ষ ইসরাইল নয়, বরং ফাতাহ ও সৌদি বলয় হবে। তাই সাধারণ গাজাবাসীর সম্পূর্ণ সহযোগিতা আদায়ে হামাসের বেগ পেতে হবে। সম্ভাব্য এই যুদ্ধের ফলাফল হামাসের পক্ষে না যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
মার্কিন-ইসরাইল বলয় ধীরে ধীরে দখলদারবিরোধী প্রায় সমস্ত আন্দোলনের সব শিকড় উপড়ে ফেলেছে। শুরুটা হয়েছিল ইয়াসির আরাফাতকে আলোচনায় রাজি করানোর মধ্য দিয়ে। তারপর ফাতাহ সংগ্রাম ছাড়ল। এখন আরবরা নিজেদের টিকিয়ে রাখতে দলে দলে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি প্রদান করছে। বাকি রইল শুধুই হামাস। আদর্শিক আন্দোলনগুলোর সম্পূর্ণ বিনাশ হয় না। তবে যেকোনো সময়ে তাজা হয়ে ওঠার সম্ভাবনাকে সঙ্গে নিয়ে দুর্বল হতে পারে। মার্কিন-ইসরাইল-সৌদি বলয়ের প্রবল শক্তিশালী এ স্রোতের বিপক্ষে হামাসের টিকে থাকা না–থাকার মধ্যেই ফিলিস্তিনিদের গত দেড় শ বছরের আন্দোলন–সংগ্রামের ফলাফল এবং আগামীর মধ্যপ্রাচ্যে উপনিবেশবাদবিরোধী আন্দোলনের ভবিষ্যৎ বিদ্যমান।


রাহুল আনজুম আন্তর্জাতিক রাজনীতিবিষয়ক গবেষক।