বাংলাদেশে গণমাধ্যম, এর স্বাধীনতা ও সাংবাদিকতা নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে নানা মহলে আলোচনা হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে এসব আলোচনায় অতিসাধারণীকরণ এবং খুব সহজেই বড় ধরনের উপসংহার টানার প্রবণতাও দেখা যায়। এসব বিষয়ে দেশ ও দেশের বাইরে দীর্ঘদিন ধরে যেসব আলোচনা হয়েছে, তার ওপর ভিত্তি করে সংবাদমাধ্যমের চারটি দিক নিয়ে চার পর্বে লিখেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর আলী রীয়াজ। আজ শেষ কিস্তি।
বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোর, তথা সাংবাদিকতার, স্বাধীনতার প্রশ্ন নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই; ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দল, সাংবাদিক ও সিভিল সোসাইটির সদস্য, সাধারণ পাঠক, এমনকি রাজনৈতিক দলের সর্বনিম্ন পর্যায়ের কর্মী পর্যন্ত এই বিষয়ে একমত যে গণমাধ্যমের এবং নাগরিকের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকা অবশ্যই দরকার। বাংলাদেশের সংবিধানে এই বিষয়ে যে স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে, তা শর্তসাপেক্ষ এবং তা নিয়ন্ত্রণের জন্য রাষ্ট্রের হাতে বেশুমার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, যার পরিধি অস্পষ্ট।
মতপ্রকাশের স্বাধীনতাবিষয়ক আলোচনায় একটি বিষয় প্রায়শই উঠে আসে। এটা হলো মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সীমা থাকার প্রশ্ন। বাংলাদেশে গত ৫০ বছরে যাঁরা যখনই ক্ষমতায় এসেছেন, তাঁরা দাবি করেন যে দেশে মতপ্রকাশের অবাধ স্বাধীনতা আছে, এমনকি তা আগের চেয়ে অনেক বেশি; তবে বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষাপটে তাঁরা এ-ও বলেন যে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা অবাধ হতে পারে না। এই দুইয়ের মধ্যে একটি বিরোধ আছে। এটা হয় তাঁরা উপলব্ধি করতে অপারগ অথবা সেটা স্বীকার করতে অনীহ। লক্ষণীয়, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সীমার বিষয়ে কেবল ক্ষমতাসীন এবং তাঁদের সমর্থকদেরই নয়; বাংলাদেশে, অন্য অনেক দেশেও, যাঁরা ধর্মীয় বিশ্বাসকে সমাজজীবনে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন, তাঁরাও একই রকম মনে করেন। তাঁদের একটি পার্থক্য হচ্ছে কোনো বিষয়ে কথা বলার ক্ষেত্রে সীমা থাকা দরকার, কিন্তু কখনো কখনো তাঁদের মধ্যে ঐকমত্যও প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশে গত চার-পাঁচ বছরে ইসলাম ধর্ম বিষয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে সরকার এবং ইসলামপন্থী ও সামাজিক জীবনে ধর্মের ভূমিকায় বিশ্বাসীদের একধরনের ঐকমত্য লক্ষণীয়।
দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে প্রধান বাধা কী এবং কোথা থেকে সেই বাধা আসে? ক্ষমতাসীন এবং তাঁদের সমর্থকদের ভাষ্য হচ্ছে, বাধাটি আসে রাষ্ট্রের বাইরে থেকে, তাঁরা বরং সেই বাধা মোকাবিলায় সবাইকে সাহায্য করছেন। রাষ্ট্রের আইন ও আচরণ নিয়ে প্রশ্ন তোলাকেই তাঁরা মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অপব্যবহার বলে চিহ্নিত করেন।
মতপ্রকাশের স্বাধীনতা
সাংবাদিকতার স্বাধীনতা বা ফ্রিডম অব প্রেস নিয়ে বিস্তর আলোচনা হলেও এটি যে কোনো রকম বাধানিষেধ, এমনকি সরকারি সেন্সরশিপ ছাড়া যেকোনো নাগরিকের মতপ্রকাশের স্বাধীনতারই অংশ, সেই বিষয়ে কোনো রকমের ভিন্নমত নেই। যার অর্থ হচ্ছে, একটি দেশে নাগরিকের মতপ্রকাশের অধিকার যদি সংকুচিত হয়, তবে সেখানে গণমাধ্যম আলাদা করে স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে না। সারা পৃথিবীতে মতপ্রকাশের অধিকার এবং সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার ওপর নজর রাখে, এমন সব আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের হিসাবে দেখাচ্ছে যে কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে সেই অধিকার সংকুচিত হয়েছে। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্সের হিসাবে ২০২০ সালে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫২, যা আগের বছরের তুলনায় এক ধাপ পেছনে। বাংলাদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা দক্ষিণ এশিয়ার অন্য সব দেশের চেয়েও খারাপ। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের হিসাবেও বাংলাদেশে মতপ্রকাশের অধিকার ক্রমেই সংকুচিত হয়েছে।
এই রকম একটা প্রেক্ষাপটেই যখন গণমাধ্যমের কোনো একটি বিশেষ সংবাদের অনুপস্থিতিকে কেন্দ্র করে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে, তখন দেখা যাচ্ছে যে আলোচনাটি কার্যত অসম্পূর্ণই থাকছে। কেননা, আলোচনায় গণমাধ্যমের মালিকানার বিষয়টিকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে, যেন এসব প্রতিষ্ঠানের মালিক হয়ে ওঠা এবং রক্ষা করা কেবল বাণিজ্যিক বিষয়, যেন এগুলো স্বায়ত্তশাসিত এবং মালিকানার প্রশ্নটির সঙ্গে রাষ্ট্র ও সরকারের কোনো রকমের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ নেই। ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকেরা যে এভাবেই বিষয়টি বিবেচনা করবেন, তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। এ বছরের ৪ মে তুরস্কের বার্তা সংস্থা আনাদোলু এজেন্সিকে প্রধানমন্ত্রীর সাবেক তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলেন যে গণমাধ্যমগুলোর মালিক হচ্ছেন করপোরেট হাউস, ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদেরা। সেই জন্য সাংবাদিকেরা কথা বলা এবং লেখার স্বাধীনতা ভোগ করছেন না; তাঁর ভাষ্য অনুযায়ী সরকারের কোনো ‘সেন্সরশিপ নেই’, গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলো তাঁদের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। তিনি এ-ও বলেছেন যে যেহেতু সাংবাদিকদের চাকরি হারানোর ঝুঁকি থাকে, তাই এই অবস্থার সূচনা হয়েছে।
কিন্তু এই ধরনের বক্তব্য বিভ্রান্তিকর। কেননা, সারা বিশ্বে যেখানেই গণতন্ত্রের ক্ষয় হয়েছে, কর্তৃত্ববাদী শাসনের দিকে দেশ অগ্রসর হয়েছে, সেখানে গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণের যেসব নতুন কৌশল বেছে নেওয়া হয়েছে, তার অন্যতম হচ্ছে এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকানাকে নিয়ন্ত্রণ করা। স্টিভেন লেভিটস্কি এবং লুকান ওয়ে তাঁদের প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক কর্তৃত্ববাদবিষয়ক বইয়ে উল্লেখ করেছেন, অনেক দেশে গণমাধ্যমের ওপর শাসকদের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ থাকে না। তার পরিবর্তে ক্ষমতাসীনেরা বেসরকারি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠার অনুমতি দেন; তবে প্রচ্ছন্ন মালিকানা, পৃষ্ঠপোষকতা এবং অন্যান্য অবৈধ উপায়ে প্রধান গণমাধ্যমগুলো শাসক দলের সঙ্গে যুক্ত থাকে।
আইরিয়া পুয়োসা লাতিন আমেরিকার কয়েকটি দেশের কথা উল্লেখ করে গ্লোবাল আমেরিকান নামের এক সাময়িকীতে ২০১৯ সালে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে লিখেছেন, ‘সরকারি তহবিলে (ভর্তুকি ও বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে) সহানুভূতিশীল গণমাধ্যম পরিচালিত হয়। একই সময়ে স্বাধীন এবং সমালোচনামূলক মাধ্যমগুলো কাগজ সরবরাহের ওপর নিয়ন্ত্রণ এবং ট্যাক্স আইনের চূড়ান্ত প্রয়োগসহ বিভিন্ন ধরনের হুমকির সম্মুখীন হয়।’ অনুগত সমর্থক এবং ব্যবসায়ীদের গণমাধ্যমের লাইসেন্স সরবরাহ করা হয়। আর বিরোধী এবং স্বতন্ত্র গণমাধ্যমগুলো যাবতীয় সমস্যার মুখোমুখি হয়। (বিস্তারিত আলোচনার জন্য দেখুন, আলী রীয়াজ, নিখোঁজ গণতন্ত্র, প্রথমা, ২০২১)।
এগুলো যে বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও একইভাবে প্রযোজ্য, মোহাম্মদ সাজ্জাদুর রহমান এবং আমি এক গবেষণায় দেখানোর চেষ্টা করেছি। সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের (সিজিএস) পৃষ্ঠপোষকতায় অক্টোবর ২০১৯ থেকে ডিসেম্বর ২০২০ পর্যন্ত সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে করা সমীক্ষা ২০২১ সালে জানুয়ারি মাসে ‘হু ওউনস দ্য মিডিয়া ইন বাংলাদেশ’ নামে প্রকাশিত হয়েছে, যাতে দেখা যায় বাংলাদেশের গণমাধ্যমের মালিকদের দলীয় সংশ্লিষ্টতা সুস্পষ্ট।
‘দুঃস্বপ্নের বাস্তবতা’
গণমাধ্যমের স্বাধীনতার পথে মালিকানার এই ধরন যে এক বিশাল বাধা, সেটি নিঃসন্দেহে বলা যায়; এই বিষয়ে ভিন্নমতের অবকাশ নেই। কিন্তু এই মালিকানার ধরন বোঝার জন্য রাষ্ট্র এবং ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক কিংবা ক্রমাগতভাবে গণতন্ত্রের পথ থেকে উল্টো যাত্রা যে এই পটভূমিকা তৈরি করে, তাকে এড়ানোর অর্থ মূল জায়গায় নজর না দেওয়া। এই ব্যবস্থাই গণমাধ্যমের পরাধীনতাকে লালন করে সেটা বিস্মৃত হওয়ার সুযোগ নেই, যদি না আমরা তাকে আড়াল করতে চাই।
গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে সরকার এবং রাষ্ট্রের ভূমিকা কেবল মালিকানা নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়ে কার্যকর হয় তা নয়। আইনি এবং আইনবহির্ভূতভাবে সরকার ও ক্ষমতাসীনেরা মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে সীমিত করেন। আমাদের গবেষণায় আমরা অন্ততপক্ষে কুড়িটি আইন শনাক্ত করেছি, যেগুলো গণমাধ্যমের জন্য প্রযোজ্য। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট ২০১৮। এর আগে ২০১৩ সাল থেকে আইসিটি অ্যাক্ট, বিশেষ করে ৫৭ ধারা ব্যবহৃত হয়েছে। এই সব আইনের দুটি দিক আমাদের স্মরণে রাখতে হবে। প্রথমত, এগুলো কেবল গণমাধ্যমের জন্যই প্রযোজ্য নয়। দুই আইনেরই পরিধি এতটাই ব্যাপক যে তা গোটা সমাজেই একটি ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করেছে। এই আইনের প্রয়োগ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে যে পরিস্থিতি তৈরি করেছে, তাকে সম্পাদক পরিষদ বলেছে ‘দুঃস্বপ্নের বাস্তবতা’ (প্রথম আলো, ২০ মে ২০২০)। এই আইনের প্রয়োগ হিসেবে দেখা যাচ্ছে, এ থেকে কারোরই রেহাই নেই (আলী রীয়াজ, ‘ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট কীভাবে প্রয়োগ হচ্ছে’, সিজিএস, এপ্রিল ২০২১)। দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে যে আইন এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যাতে সরকার প্রত্যক্ষভাবে এই আইন ব্যবহার না করলেও তা এমনভাবে ব্যবহৃত হয়, যা ভিন্নমত প্রকাশের জন্য হুমকি হয়ে ওঠে। সরকার-সমর্থকেরা এইভাবেই এই আইনের ব্যবহার করছেন।
আইনের এই সব দিকের বাইরেও যে রাষ্ট্র যেকোনো ব্যক্তিকে ভীতিগ্রস্ত করতে পারে, তাঁর কণ্ঠস্বর রুদ্ধ করতে পারে, সেই বিষয়ে বিস্তারিত বলার দরকার নেই। রাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থা কী ভূমিকা রাখছে, নাগরিকের সাংবিধানিক রক্ষাকবচগুলো যেসব প্রতিষ্ঠানের রক্ষা করার কথা, তারা কী করছে, সেটাও লক্ষ করা দরকার। আইনি ও আইনবহির্ভূত ব্যবস্থাদি সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে স্ব-আরোপিত সেন্সরশিপ বা সেলফ-সেন্সরশিপের প্রপঞ্চকে স্বাভাবিক করে তুলেছে।
জবাবদিহিহীন রাজনৈতিক ব্যবস্থায় নাগরিকের অন্যান্য অধিকার, বিশেষ করে মতপ্রকাশের অধিকার যখন সীমিত হয়ে যায়, তখন সংবাদপত্রের স্বাধীনতা আলাদাভাবে টিকে থাকে না; সাংবাদিকেরা আলাদা করে স্বাধীনতা ভোগ করবেন, এমন আশা করার কারণ নেই। ফলে স্বাধীন সাংবাদিকতার বাধাগুলোকে চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে দরকার বিরাজমান রাজনৈতিক ব্যবস্থা, শাসনের ধরন, তার রাজনৈতিক অর্থনীতি একত্রে বিবেচনা করা।