রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র

স্নেহ বলে সুন্দরবন মাতা, বাহুবলে রাজা

রবীন্দ্রনাথের অমর নৃত্যনাট্য চিত্রাঙ্গদায় পাণ্ডব বীর অর্জুন যখন দস্যু আক্রমণের ভয়ে ভীত গ্রামবাসীকে জিজ্ঞাসা করেন যে তাদের কোনো ‘রক্ষক’ রয়েছে কি না, গ্রামবাসী তখন তাদের রাজকুমারী চিত্রাঙ্গদার নাম করে জানায় ‘তীর্থে গেছেন কোথা তিনি গোপনব্রতধারিণী, স্নেহবলে তিনি মাতা, বাহুবলে তিনি রাজা।’ কবির এই অনিন্দ্য সুন্দর রূপক একটু ঘুরিয়ে আমরা বোধ করি আমাদের সুন্দরবন সম্পর্কেও বলতে পারি। সুন্দরবন  আমাদের মা। কেওড়া, গরান, গেওয়াসহ অসংখ্য গাছের ছায়ায় সুন্দরবন আমাদের উপকূল ছায়াঘন করে রাখে। কখনো তার গোলপাতা দরিদ্র বাওয়ালির ঘরের আচ্ছাদন হয়। মৌয়াল আহরণ করে তার মধু। আবার ‘সিডর’ বা ‘আইলা’র মতো ভয়াবহ সমুদ্রোচ্ছ্বাসের সময় সুন্দরবনের দীর্ঘ যত তরুর সারিই আমাদের উপকূল ও উপকূলবাসীর জীবন-জীবিকার বিপুল ক্ষতি কিছুটা হলেও কমিয়ে দেয়। পুরাণের রাজকুমারী ‘চিত্রাঙ্গদা’র মতোই আমাদের অরণ্য মা তখন একজন বীর হয়ে ওঠেন। একই সঙ্গে বেঙ্গল টাইগার, চিত্রল হরিণ, গাঙ্গেয় ডলফিন বা শুশুক, কুমির, সাপ, বানরসহ নানা প্রজাতির পশু ও পাখির অভয়ারণ্য সুন্দরবনকে সেই ১৯৯৭ সালেই ইউনেসকো বিশ্বের অন্যতম ‘হেরিটেজ’ বা ‘ঐতিহ্যিক উত্তরাধিকার’ এলাকা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।  

সম্প্রতি বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড (পিডিবি) ও ভারতের জাতীয় পারমাণবিক তাপ জ্বালানি করপোরেশনের মধ্যে স্বাক্ষরিত এক যৌথ চুক্তি অনুসারে সুন্দরবনে ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লানির্ভর পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ২০১২ সালের ২৯ জানুয়ারি স্বাক্ষরিত এই চুক্তি অনুসারে রামপালের এই জ্বালানি স্থাপনাকে ‘ইন্দো-বাংলাদেশ মৈত্রী জ্বালানি প্রকল্প’ হিসেবে নামকরণ করা হয়েছে এবং এই প্রকল্পের আওতায় সুন্দরবন থেকে মাত্র ১৪ কিলোমিটার উত্তরে বাগেরহাটের রামপালে এক হাজার ৮৩৪ একর এলাকায় এই জ্বালানি প্ল্যান্ট স্থাপন করা হবে। অবশ্য বাংলাদেশের পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে কাজটি শুরু করার ছাড়পত্র এখনো মেলেনি। এদিকে পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মতে, কোনো অরণ্য ও অরণ্যচারী জনগোষ্ঠীর বসতির ১৫ থেকে ২০ কিলোমিটারের ভেতর জ্বালানি প্ল্যান্ট তৈরির অনুমতি ইতিপূর্বে পৃথিবীর কোনো দেশেই কখনো দেওয়া হয়নি। এ বিষয়ক সরকারের ৬৭৬ পৃষ্ঠাসংবলিত ‘এনভায়রনমেন্ট ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট রিপোর্ট (ইআইএ)’ ইতিমধ্যেই পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা প্রত্যাখ্যান করেছেন। 

ওয়েবসাইটে ও পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত কিছু প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, ২০১০ সালে বর্তমান সরকার একটি গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে সুন্দরবনের চতুষ্পার্শ্বে পশুর নদীসহ ৩৪০ হেক্টর, ৫৬০ হেক্টর ও ১৭০ হেক্টরসহ মোট ১০৭০ হেক্টর সমপরিমাণ এলাকা ‘অভয়ারণ্য’ হিসেবে ঘোষণা করেছিল। গাঙ্গেয় ডলফিন তথা শুশুক সংরক্ষণ করাও এর একটি অন্যতম কারণ ছিল। সরকারের ‘এনভায়রনমেন্ট ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট রিপোর্টে (ইআইএ) বলা হয়েছে, পশুর নদীর পানি প্রস্তাবিত জ্বালানি প্ল্যান্টের শোধনাগারে শোধনকাজে ব্যবহূত হয়ে আবার নদীতেই ফেরত যাবে। কিন্তু জ্বালানি প্ল্যান্টের শোধনাগারে ব্যবহূত পানি যখন পুনরায় নদীতে যাবে, সেই পানি ততক্ষণে বিভিন্ন বিষাক্ত উপাদানে ভরপুর হবে। সেটা নদীর পানির ওপর নির্ভরশীল প্রতিবেশ ব্যবস্থায় হানবে নিদারুণ আঘাত।     

কয়লানির্ভর এই জ্বালানি প্ল্যান্ট প্রচুর পরিমাণে কার্বন ডাই-অক্সাইড, সালফার, নাইট্রোজেন এবং অন্যান্য ক্ষতিকর গ্যাস ও ছাই নিঃসরণ করার মাধ্যমে গোটা এলাকার পরিবেশ শুধু ক্ষতিগ্রস্তই হবে না, অ্যাসিড বৃষ্টির আশঙ্কাও দেখা দিতে পারে। সুন্দরবনের চারপাশের মানুষ বন ও পার্শ্ববর্তী নদী ও খালগুলোর ওপর জীবিকার জন্য নির্ভরশীল। তাদের জন্যও সামনে নেমে আসতে পারে ভয়াবহ দুর্যোগ। জেলে, কাঠুরিয়া, মৌয়ালসহ বিচিত্র পেশার মানুষগুলোর পেশা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। রামপাল প্রকল্প এলাকার মানুষের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকিরও কারণ হয়ে দাঁড়াবে। সরকারের ইআইএ রিপোর্টেই বলা হচ্ছে, জ্বালানি স্থাপনা কর্তৃক নিঃসরিত গ্যাসের কারণে অনেকেরই নিউমোনিয়া দেখা দিতে পারে। অ্যাসিড বৃষ্টির কারণে গাছের আগা মরা রোগ দেখা দেবে। নদীর পানি দূষিত হবে। কারখানার বর্জ্য মিশে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে পানীয় জলও (প্রাগুক্ত)।  

ইতিমধ্যে রামপালের মইদারা খালের চারপাশে প্রস্তাবিত স্থাপনার জন্য জমি তৈরির কাজ চলছে। স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো ‘সুন্দরবন বাঁচাও’ ব্যানারের আওতায় জনস্বার্থে রিট পিটিশন দায়ের করেছে। মহামান্য হাইকোর্ট অবশ্য সরকারের কাছে মইদারা খালের পাশে কয়লানির্ভর জ্বালানি প্ল্যান্ট স্থাপনের চেষ্টা কেন অবৈধ হবে না, সে বিষয়ে জানতে চেয়ে ইতিমধ্যেই নোটিশ জারি করেছেন। বাংলাদেশের পিডিবি আশা করছে, প্রতি টন কয়লা ১০৫ মার্কিন ডলারে এলে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ তৈরিতে খরচ পড়তে পারে ৫ দশমিক ৯০ টাকা। অন্যদিকে প্রতিটন কয়লা ১৪৫ ডলার দাম পড়লে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ হবে ৮ দশমিক ৮৫ বাংলাদেশি টাকা। (মুশফিকুর রহমান, ফরেন অ্যাফেয়ার্স ইনসাইটস অ্যান্ড রিভিয়্যুস-ফেয়ার ওয়েব নিবন্ধ)।       

প্রস্তাবিত রামপাল জ্বালানি স্থাপনায় ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ তৈরিতে প্রতিবছর ৪ দশমিক ৫ মিলিয়ন টন কয়লা লাগবে। কারখানার পাশেই একটি জেটি নির্মাণের কথা ভাবা হচ্ছে কিন্তু মইদারা খাল ও তার সংযোগ নদীগুলোর যে নাব্যতা, তাতে শুকনো মৌসুমে ভারী নৌযান চলাচল সম্ভব নয়। মংলা বন্দরের নাব্যতার অবস্থাও ভালো নয়। জানা গেছে, এ জন্য বঙ্গোপসাগরের মোহনার পাশে আকরাম পয়েন্ট থেকে বড়সড় মাত্রার ড্রেজিং করতে হবে। এই ড্রেজিংয়েই আবার প্রতিবছর খরচ হবে ৩০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।

আর্থিক ও পরিবেশগত বহুবিধ বিবেচনার পাশাপাশি সুন্দরবন আমাদের অমূল্য সাংস্কৃতিক সম্পদেরও প্রাণাধার। ব্যাঘ্রাসনা বনবিবি, কুমিরের রাজা দক্ষিণ রায়, গাজি কালু ও চম্পাবতীর পুঁথি, পটচিত্র, দুবলার চরের রাসমেলা, হিন্দু-ইসলাম-সর্বপ্রাণবাদী সংস্কৃতির মিশেলে এক অনন্য লোকধর্ম...এসবই হারিয়ে যাবে যদি সুন্দরবনকে আমরা রক্ষা করতে না পারি!

ভারতের শাসকশ্রেণী আর সাধারণ মানুষ নিশ্চয়ই এক নয়। সে দেশের মহাশ্বেতা দেবী, দেবেশ রায়, মেধা পাটেকর বা বন্দনা শিবার মতো লেখক-বুদ্ধিজীবীরা দানবীয় উন্নয়নের বদলে পরিবেশ ও মানুষের সমতাকেই গুরুত্ব দিয়েছেন বারবার। সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হলে পশ্চিমবঙ্গ অংশ কি বিপন্ন হবে না? ফারাক্কা বাঁধ হুগলি বন্দরেরও নাব্যতা কমিয়েছে। শেষ কথা হলো: কারও হাতেই ব্যবহূত না হয়ে আমরা যেন আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ ও প্রতিবেশ রক্ষায় সমর্থ হই। 

অদিতি ফাল্গুনী: কথাসাহিত্যিক।