পাকিস্তান ও সৌদি আরবের সম্পর্ক অনেক দিন ধরেই তেতে ছিল। গত মাসের গোড়ার দিকে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মেহমুদ কোরেশি কাশ্মীর ইস্যুতে সৌদি আরব যথার্থ ভূমিকা রাখতে পারেনি বলে সৌদি সরকারের কড়া সমালোচনা করার পর সেই সম্পর্ক একেবারে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।
গত ৪ আগস্ট একটি টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে কোরেশি বলেছিলেন, ইসলামাবাদ আশা করে, কাশ্মীর নিয়ে মুসলিমপ্রধান দেশগুলোর জেদ্দাভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংগঠন ওআইসি শিগগিরই বিশেষ বৈঠক ডাকবে। সেটা যদি করা না হয়, তাহলে পাকিস্তান এই ইস্যুতে মুসলিমপ্রধান দেশগুলোকে নিয়ে আলাদা করে সম্মেলন ডাকতে বাধ্য হবে। কোরেশির এই বক্তব্যকে সৌদি নেতৃত্বাধীন ওআইসির প্রতি ইসলামাবাদের প্রচ্ছন্ন হুমকি হিসেবে দেখা হচ্ছে।
কোরেশির এই বক্তব্যের জবাবে সৌদি আরব পাকিস্তানকে সুদমুক্ত ১০০ কোটি ডলার দেওয়ার বিষয়টি থেকে সরে এসেছে। একই সঙ্গে পাকিস্তানকে বাজারদরের চেয়ে কম দামে তেল সরবরাহ করার একটি চুক্তি নবায়ন করা হবে না বলেও জানিয়েছে সৌদি সরকার।
সম্পর্কের চিড় ঝালাই করার জন্য পাকিস্তানের চিফ অব আর্মি স্টাফ জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়া গত ১৭ আগস্ট রিয়াদে ছুটে গিয়েছিলেন। কিন্তু সৌদি প্রিন্স মোহাম্মাদ বিন সালমান তাঁকে সাক্ষাৎ দেননি। বিমর্ষ মনে জেনারেল বাজওয়া পাকিস্তানে ফেরার পরপরই পররাষ্ট্রমন্ত্রী কোরেশি চীন সফরে যান। এর মধ্য দিয়ে পাকিস্তান সৌদি আরবকে পরিষ্কার বার্তা দিয়েছে, ইসলামাবাদ নিজের পিঠ বাঁচাতে বেইজিংয়ের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধতে বাধ্য হয়েছে।
সৌদি আরব ও পাকিস্তানের সম্পর্কের এই টানাপোড়েনকে আরও বিস্তৃত পরিসর থেকে বিবেচনা করলে বোঝা যাবে, এটি মধ্যপ্রাচ্য তথা মুসলিম বিশ্বের কূটনৈতিক পরিমণ্ডলকেই বদলে দিতে যাচ্ছে।
পাকিস্তান বরাবরই তার প্রতিদ্বন্দ্বী মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে দেখেশুনে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে এসেছে। তবে সৌদি আরব এবং সৌদির ‘নেতৃত্বে’ পরিচালিত হয়, এমন আরব দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের সুসম্পর্ক গড়ে ওঠাকে পাকিস্তান কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। অন্যদিকে সৌদি আরবের সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক থাকা তুরস্ক, মালয়েশিয়া এবং কাতারের সঙ্গে পাকিস্তানের সদ্ভাব থাকাকে সৌদি সরকার মেনে নিতে পারছে না। এর বাইরে ইরান ও চীনের মধ্যে যে চুক্তি হয়েছে এবং চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) প্রকল্পে ইরান ও পাকিস্তান যেভাবে সম্মতি দিয়েছে, তা সৌদিকে চূড়ান্তভাবে হতাশ করেছে। চীনের মধ্যস্থতার কারণে ইরানের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক উষ্ণ হচ্ছে। সৌদি আরব যেহেতু ইরানকে সবচেয়ে বড় হুমকি হিসেবে মনে করে, সেহেতু তার সঙ্গে পাকিস্তানের সুসম্পর্ক সৌদি সরকার ভালোভাবে নেবে না।
গত বছরের আগস্টে ভারত সরকার কাশ্মীরের আধা স্বায়ত্তশাসিত রাজ্যের মর্যাদা বাতিল করার পর পাকিস্তান আশা করেছিল, আরব দেশগুলো পাকিস্তানের কাশ্মীর নীতিকে কড়াভাবে সমর্থন জানাবে। কিন্তু সেভাবে সৌদি আরব ও তার উপসাগরীয় মিত্রদের কেউই ভারতের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া জানায়নি। এটি পাকিস্তানকে ক্ষুব্ধ করেছে।
এর আগে উপসাগরীয় দেশগুলো পাকিস্তান ও ভারতের সঙ্গে ভারসাম্য রেখে সম্পর্ক চালিয়ে গেছে। কিন্তু এখন তারা খোলাখুলিভাবে পাকিস্তানের চেয়ে ভারতের দিকে বেশি ঝুঁকেছে। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে মোহাম্মাদ বিন সালমানের দক্ষিণ এশিয়া সফরের সময় সেটি একেবারে সামনে চলে আসে। ওই সময় মোহাম্মাদ বিন সালমান পাকিস্তান সফরের পরপরই ভারত সফরে যান। ওই সময় পাকিস্তানের সঙ্গে তিনি দুই হাজার কোটি ডলারের একটি সমঝোতা চুক্তিতে সই করেন। পাকিস্তান থেকে ভারতে গিয়ে সেখানে তিনি ১০ হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগের চুক্তি করেন।
এর কয়েক সপ্তাহ পরই সৌদির মিত্রদেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত পরিষ্কার বার্তা দেয়, তারা পাকিস্তানের চেয়ে ভারতকে বেশি কাছে টানবে। ২০১৯ সালের মার্চে সংযুক্ত আরব আমিরাত ওআইসির সম্মেলনে সাম্মানিক অতিথি হিসেবে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে দাওয়াত দিয়েছিল এবং এর প্রতিবাদে পাকিস্তানের প্রতিনিধি ওআইসির সম্মেলন থেকে বেরিয়ে আসেন।
এখন সৌদির সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য অনেক গুণ বেড়েছে। অন্যদিকে দিন দিনই সৌদির সঙ্গে পাকিস্তানের ব্যবসা কমছে। এই জায়গা দখল করছে চীন। অন্যদিকে তুরস্ক ও মালয়েশিয়ার দিকে পাকিস্তানের ঝোঁক বাড়ছে। ফলে, এই অঞ্চলে একটি নতুন সমীকরণ দেখা দিচ্ছে। সেটি কত দূর গড়াবে, তা ভবিষ্যৎই বলতে পারবে।
আল–জাজিরা থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত
আবুল বাসিত সিঙ্গাপুরের এ রাজারত্নম স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের একজন রিসার্চ ফেলো এবং ড. জাহিদ শাহাব আহমেদ ডেকিন ইউনিভার্সিটির একজন রিসার্চ ফেলো