সিভিল সার্ভিস ডে

সেবা ও সততায়জনপ্রশাসন

নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রের প্রতিটি অফিস থেকে সেবা, সহযোগিতা ও তথ্য পাওয়ার অধিকার রয়েছে জনগণের। সরকারি অফিসকে সাধারণ মানুষ ‘সেবা প্রদায়ী প্রতিষ্ঠান’ হিসেবে দেখতে চান। সততা, স্বচ্ছতা, নিষ্ঠাসহ জনপ্রশাসনের কর্মকর্তাদের প্রকৃতই সেবকের ভূমিকায় দেখতে চান মানুষ। কিন্তু ভুক্তভোগী মানুষের অভিযোগ, সরকারি অফিসে অনেক প্রত্যাশা নিয়ে জনসাধারণ আসেন, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে অপমান ও হয়রানির কষ্ট নিয়ে ফিরে যান। ফলে মানুষ হয়ে পড়েন জনপ্রশাসনবিমুখ। এর কারণ হলো অনেক কর্মকর্তা মানুষের অভিযোগ মন দিয়ে শোনেন না। সরকারি অফিসের বারান্দায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা প্রতীক্ষায় থাকলেও অনেকে তাঁদের সাক্ষাৎ দেওয়ার কিংবা অভিযোগ শোনার সময় দেন না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে যখন সেবা বা সাহায্যপ্রার্থী মানুষ জানতে চান, ‘আমার কাজটি কখন হবে?’ তখনো এর সদুত্তর পান না। কখনো বা অপমান করে বিদায় হতে হয়।

কিছু সরকারি অফিসের কক্ষে কক্ষে ছড়িয়ে আছে যন্ত্রণা ও হয়রানির বলয়। এসব অফিসের নাম শুনলেই মানুষ আতঙ্কিত হন। দীর্ঘ ভোগান্তি মানুষকে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। সরকারি সেবা পেতে কী অবিশ্বাস্য মন্থরতা, তা আমরা উপলব্ধি করি অবসর গ্রহণের পর। অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা সাধারণ নাগরিকদের কাতারে এসে যখন সরকারি অফিসে যান, তখন বোঝা যায় এই যন্ত্রণা কত কষ্টকর! কিন্তু এর মধ্যেও নাগরিক স্বার্থরক্ষায় কিছু কিছু কর্মকর্তার সাহসী ভূমিকা এবং জনগণের প্রতি সেবামুখী আচরণ মানুষের মনে আস্থা ফিরিয়ে দেয়। অনেক শ্রম দিয়ে, কষ্টার্জিত অর্থ ব্যয় করে এবং ঘাম ঝরিয়ে মানুষ সরকারি অফিসে আসেন কিন্তু কাঙ্ক্ষিত সেবা না পেয়ে নীরবেই অশ্রু ঝরিয়ে চলে যান। সরকারি অফিসে অনেক ক্ষেত্রে পিয়ন, পিএ কিংবা প্রহরীরাই যেন সব দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। সেবাপ্রার্থী জনগণ আর প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মধ্যে অনেক ক্ষেত্রে তাঁরাই দূরত্ব সৃষ্টি করেন। মাঠপর্যায়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অফিসের মধ্যে হয়েছে ইউএনও অফিস, পুলিশ স্টেশন, সাব-রেজিস্ট্রি অফিস আর ভূমি অফিস। এসব অফিস দিবারাত্রি মানুষের ভিড়ে মুখরিত থাকে। এসব অফিসে সেবা পেতে মানুষের যত আকুলতা ও প্রত্যাশা, তার বিপরীতে হতাশা ও দুঃখও জড়িয়ে আছে অনেক।

আজ আন্তর্জাতিক পাবলিক সার্ভিস ডেতে প্রতিটি সরকারি অফিসের প্রধান নির্বাহী এবং অধীনস্থ কর্মকর্তা হিসেবে আমাদের নিশ্চিত করতে হবে ভূমি অফিসে নামজারি করতে অতিরিক্ত টাকা লাগবে না, ভবন তৈরির নকশা অনুমোদনে বাড়তি অর্থ লাগবে না। উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে উপরি দিতে হবে না। গ্যাস, বিদ্যুৎ বা পানির সংযোগ নিতে টিপস দিতে হবে না। থানায় এজাহার/জিডি এন্ট্রি করতে কিংবা রেকর্ডরুমে নকল নিতে টাকা দিতে হবে না। ড্রাইভিং লাইসেন্স বা পাসপোর্ট নিতে চাঁদা দিতে হবে না। জমির দলিল রেজিস্ট্রেশনে অতিরিক্ত অর্থ লাগবে না। ভূমি অধিগ্রহণের টাকা নিতে হয়রানির শিকার হতে হবে না। পরিবেশ ছাড়পত্র পেতে কারখানার মালিকদের ভোগান্তি পেতে হবে না এবং সরকারি হাসপাতালে সেবা পেতে বিড়ম্বনার শিকার হতে হবে না। সিভিল সার্ভিসের কর্মকর্তাদের ‘ক্ষমতা’কে ‘সেবা’য় পরিণত করেই জনগণের ভালোবাসা অর্জন সম্ভব।

মানুষ চায় আইনের আশ্রয় এবং প্রশাসনের ছায়া। সরকারি অফিসে আসা অসহায় জনগণের বেদনা অনুভব করার চেতনা থাকতে হবে। অবহেলা বা অপ্রাপ্তির যন্ত্রণা নিয়ে কেউ ফিরে গেলে তার অভিশাপের বোঝা বইতে হবে কর্মকর্তাদের। কর্তা হয়ে অধীনস্থ ব্যক্তিদের উপদেশ দেওয়ার আগে নিজেকে পরিপূর্ণ দায়িত্ববান, সৎ ও শুদ্ধ হতে হবে। সবার আগে নিজের মধ্যে আইন মান্যতা ও আইনের অনুশীলন নিশ্চিত করতে হবে। নিজের মধ্যে সততা না থাকলে অধীনস্থ ব্যক্তিদের ওপর সততা আরোপ অর্থহীন।

সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা হয় জনগণের করের টাকায়। তাই জনপ্রশাসনকে দুর্নামের কলঙ্ক ঘোচাতে হবে। মানুষের পাশে থেকে হয়রানিমুক্তভাবে সেবা প্রদানের পরিবেশ তৈরি হয়ে গেলে আপনাআপনিই তার সঙ্গে মানুষের অভিযোজন হয়ে যাবে। আন্তর্জাতিক পাবলিক সার্ভিস ডের মর্মবাণী অনুযায়ী আমাদের অঙ্গীকার হোক, ‘জনগণের কাছে প্রসারিত করব সেবার হাত। জনগণের প্রতি থাকবে না বৈরী মনোভাব।’ জনপ্রশাসন হোক জনগণের আস্থা ও নির্ভরতার প্রতীক। সরকারি অফিসে জ্বলে উঠুক সেবার প্রদীপ। জনকল্যাণ, জননিরাপত্তা ও জনসেবা—এ চেতনায় উজ্জীবিত হোক বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের সব কর্মকর্তা।

মোহাম্মাদ মুনীর চৌধুরী: ব্যবস্থাপনা পরিচালক, মিল্ক ভিটা, বিসিএস (প্রশাসন), ১০ম ব্যাচের কর্মকর্তা।

mmunirc@gmail.com:n: