পদকে ভেজাল

সেই স্বর্ণপদক এখনো জ্বলজ্বল করছে

ঢাকায় আমার বনানীর বাসার বসার ঘরের দেয়ালে একটা ফটো ঝোলানো আছে। ছবিটিতে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী সুন্দর একটা ক্রেস্ট আমার হাতে তুলে দিচ্ছেন। দুই বছর আগে, ২০১২ সালের ২৭ মার্চ আমাকে ‘মুক্তিযুদ্ধের বন্ধু সম্মাননা’ পদক দেওয়া হয়। ছবিটির নিচে ফ্রেমে বাঁধা একটা সার্টিফিকেট। ওটাও দেওয়া হয়েছিল সম্মাননার অংশ হিসেবে; তাতে বাংলা ও ইংরেজিতে লেখা, যার নিচে স্বাক্ষর করেছেন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী উভয়েই। আর তার নিচে একটা আসবাবের ওপর রাখা সেই ক্রেস্টটি। ক্রেস্ট ও সার্টিফিকেট দুটোই খুব সুন্দর করে নকশা করা। এই উপমহাদেশে আমার ৪০ বছরের জীবনে এর থেকে মূল্যবান আর কোনো সম্পদ আমি অর্জন করিনি। এই ৪০ বছরের ২৩ বছরই কেটেছে আমার বাংলাদেশে, যে দেশটিকে এখন আমি আমার স্বদেশ মনে করি।
৩০০-এরও বেশি সম্মাননা দেওয়া হয় মরণোত্তর হিসেবে। এরই দ্বিতীয় পর্যায়ে ২০১২ সালের মার্চে পদক পান ৮০ জন। তাঁদের মধ্যে মাত্র ২০ জন সশরীরে হাজির হয়ে পদক গ্রহণ করেন। পদকপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মধ্যে আমিসহ মাত্র তিনজন এখনো বাংলাদেশে বাস করছেন এবং কাজ করে যাচ্ছেন। আমরা সবাই চরম দরিদ্রদের মধ্যে কাজ করছি এবং আমাদের কাজ নিয়ে আমরা সবাই-ই খুব খুশি। ২০১২ সালের সেই মার্চ মাসে চার দিন ধরে আয়োজিত অনুষ্ঠান এবং তার অংশ হিসেবে সৌহার্দ্য সফর খুবই সুন্দরভাবে পরিচালনা করা হয়েছিল। আমরা বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথাবার্তা বলতে পেরেছিলাম। অন্য মন্ত্রী ও সম্মানিত ব্যক্তিদের সঙ্গেও আমাদের আনুষ্ঠানিক ও ঘরোয়া দুই রকম আলাপই হয়েছিল। সবই ছিল দারুণ এক অভিজ্ঞতার অংশ।
এ কারণেই সম্প্রতি যখন সংবাদপত্র মারফত জানতে পারি যে প্রতিটি ক্রেস্টে যে পরিমাণ সোনা থাকার কথা ছিল, সে পরিমাণ সোনা তাতে ছিল না—নির্দিষ্ট পরিমাণের চেয়ে প্রায় ৭৫ শতাংশ কম। এবং রুপার বদলে অ্যালুমিনিয়ামের মিশ্রণও তাতে রাখা হয়েছিল। তার মানে এখানে সুস্পষ্টভাবেই দুর্নীতির ব্যাপার ঘটেছে। যে অভিযোগ উঠেছে, আইনের অধীনে তাকে শক্ত হাতে দেখতে হবে। বাংলাদেশ মান ও পরীক্ষণ প্রতিষ্ঠানের দ্বারা এই উন্মোচন সঠিক হলে তা বাংলাদেশ সরকারের জন্য খুবই বিব্রতকর ব্যাপার। এর বিরুদ্ধে যাতে সঠিক ও কঠিন পদক্ষেপ নেওয়া হয়, প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই তা দেখবেন।
তা হলেও, যে স্বীকৃতি আমাদের দেওয়া হয়েছে, সেটি প্রত্যাশার চেয়েও বেশি। এমনকি এর জন্য যদি শুধু একটি সার্টিফিকেটই আমাদের দেওয়া হতো, তা-ও হতো অতীব সম্মানের এবং খুবই বিশেষ রকমের। আর তাই, আমি এ ব্যাপারেও নিশ্চিত যে এই অনন্য সম্মাননা যাঁরা গ্রহণ করেছেন, তাঁরা ‘প্রতারিত’ বা ‘বঞ্চিত’ বোধ করবেন না। আমি আর কোনো দেশের কথা জানি না, যারা এভাবে ‘ধন্যবাদ’ জানিয়েছে। এটা তাই খুবই মনে রাখার মতো এবং আমরা যারা এই সম্মাননা গ্রহণ করেছি, তারা নিজেদের মহিমান্বিত বোধ করেছি। আমরা তো সে রকম বিশেষ কেউ নই। বিশেষ মর্যাদাবান হলেন মুক্তিবাহিনীর পরিকীর্তিত বীরেরা, যাঁরা সব প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন এবং যাঁদের অনেকেই আত্মদান করেছিলেন।
দুর্নীতির বিষয়ে বলতে হলে আমি তিন বছর আগে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ১৯৭১ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশের অগ্রগতির বিষয়ে প্রকাশিত একটি লেখা থেকে উদ্ধৃত করতে চাই:
সকল উন্নয়নমূলক কার্যক্রমকে ক্ষতিগ্রস্তকারী দুর্নীতি ও আত্মসাতের মাত্রা কমিয়ে আনতে শক্তিশালী ও সাহসী সরকার প্রয়োজন। আমি মনে করতে পারি, এমনকি ১৯৭৪-৭৫ সালের রৌমারী দুর্ভিক্ষের সময়ও এক স্থানীয় সমবায় সমিতির চেয়ারম্যান অমূল্য খাদ্য সরবরাহ ভারতের পাচার করে দিচ্ছিলেন। দুঃখজনকভাবে একটা মাত্রা পর্যন্ত আত্মসাৎকরণ নিয়ম হয়ে গিয়েছে, তা আর অস্বাভাবিক নয়। আমাকে বলা হয়েছে, গণপূর্ত বিভাগের একজন ঠিকাদারকে মোট প্রাক্কলিত মূল্যের ৩০ শতাংশ ঘুষ হিসেবে দিতে হয়। সে কারণে, বেশির ভাগ ঠিকাদারই তাঁদের টেন্ডারে দর হিসেবে ৩০ শতাংশ বেশি দাবি করেন। এটা মোকাবিলায় আমাদের কাজের ধরনে আকাশ-পাতাল পরিবর্তন ঘটাতে হবে।
দুর্নীতি ও ঘুষের বিষয়ে আরও যদি বলতে হয়, তাহলে পাঠকেরা আগ্রহী হবেন জানতে যে আমার পূর্বপুরুষ ১৮৬০-এর দশকে নোয়াখালী ও চট্টগ্রামে পুলিশের দায়িত্ব পালন করেছেন। এবং ১৮৭০ সালে তিনিই প্রথম ‘পুলিশের আচরণবিধি’ প্রণয়ন করেন এবং তা কলকাতার ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক গৃহীত হয়। আচরণবিধিটি হিন্দুস্তানি, উর্দু ও বাংলায় অনূদিতও হয়। এটা লিখিত হয়েছিল প্রশ্ন ও উত্তরের আকারে। এ রকম একটি প্রশ্ন ছিল যে:
‘প্রশ্ন: ৪৫ একজন পুলিশের সদস্য সবচেয়ে বড় কী দোষ করতে পারেন?’
‘উত্তর: প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অর্থ বা মূল্য আছে (অর্থ অথবা অর্থমূল্যপ্রমাণ) এমন কোনো কিছু দায়িত্ব পালনে বিরত থাকা বা তাঁর কর্তব্যের লঙ্ঘন ঘটানোর জন্য ঘুষ হিসেবে গ্রহণ করেন।’
আমার জানতে ইচ্ছা হয়, আজকের পুলিশের আচরণবিধিতে কী লেখা আছে!

ইংরেজি থেকে অনূদিত

জুলিয়ান ফ্রান্সিস: উন্নয়ন পরামর্শক। মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে বাংলাদেশের উন্নয়নকাজে যুক্ত রয়েছেন। ‘মুক্তিযুদ্ধের বন্ধু’ পুরস্কারে ভূষিত। যুক্তরাজ্যের নাগরিক।