আমার দাদার বাবা ছিলেন একজন কৃষক, আমার দাদা কৃষক-কাম-সিল্ক ব্যবসায়ী এবং আমার বাবা একজন আইনজীবী। শিক্ষাই ছিল আমার একমাত্র পুঁজি। ১৯৯৬ সালে আমেরিকান ইকোনমিক অ্যাসোসিয়েশনে বক্তৃতার সময় অধ্যাপক থিউডর শুলজ এক বিপ্লবী কথা বলেন যে শিক্ষার বুনিয়াদের ওপরই প্রয়োজনীয় মানবিক পুঁজি গঠিত হয়। ১৯৭৯ সালে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার সময়ও তিনি শিক্ষার ভূমিকার ওপর বিরাট গুরুত্ব আরোপ করেন। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে শিক্ষার ওপর যথেষ্ট জোর দেওয়া না হলে কাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক উন্নতিও হওয়ার নয়।
১৯৫৯ সালে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ বলেছিলেন, ‘কোনো সভ্য দেশে একের অধিক শিক্ষাপদ্ধতি নেই। মোটা দাগে বললে, আমরা তিন ধরনের শিক্ষাপদ্ধতি চালু রেখেছি: ধর্মভিত্তিক, ইংরেজিভিত্তিক এবং অন্য পদ্ধতির।’ আমাদের সংবিধানের ১৭ নম্বর অনুচ্ছেদের দ্বিতীয় ভাগে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে বলা আছে, ‘রাষ্ট্র (ক) একই পদ্ধতির গণমুখী ও সার্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সকল বালক-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের জন্য; (খ) সমাজের প্রয়োজনের সহিত শিক্ষাকে সঙ্গতিপূর্ণ করিবার জন্য এবং সেই প্রয়োজন সিদ্ধ করিবার উদ্দেশ্যে যথাযথ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও সদিচ্ছা প্রণোদিত নাগরিক সৃষ্টির জন্য; (গ) আইনের দ্বারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিরক্ষরতা দূর করিবার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা প্রহণ করিবেন।’
এবারে মনে হচ্ছে, দৃশ্যত শিক্ষা মন্ত্রণালয় জাতীয় শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে উল্লেখযোগ্যভাবে সফল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার ভিত্তি খুবই নাজুক, সম্পদ সীমিত এবং গতি খুবই ধীর। সরকারের এক হিসাবে দেখা যাচ্ছে, ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের ৭০ শতাংশই ঠিকমতো পড়তে, লিখতে ও গুনতে পারে না। আমাদের ৫০ জন শিক্ষার্থীর জন্য রয়েছেন মাত্র একজন শিক্ষক। যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলে গর্ব করা হয়, বিশ্বের ছয় হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে তার স্থান ৪৯২২তম। আমাদের বিজ্ঞান ও গণিতের অবস্থান ১৪৪টি দেশের মধ্যে ১১৩তম।
আমাদের শ্রমিকদের ৯৬ শতাংশই মাধ্যমিক পাস করেনি। পুরুষ শ্রমিকদের ৪০ দশমিক ৬ শতাংশ এবং নারী শ্রমিকদের ৪১ দশমিক ৩ শতাংশ কোনো শিক্ষাই পায়নি। উৎপাদনের স্বার্থে, ব্যাংকিং ও বাজারের কারবারের জন্য আরও শিক্ষার প্রয়োজন। শিক্ষায় আরেকটু অগ্রগতি হলে বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স আসার হারও অনেক বেড়ে যাবে।
আমরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য বরাদ্দ বাড়াতে চাই না, কিন্তু সেই আমরাই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিপুল পরিমাণ খরচ করি। মজার বিষয় হচ্ছে, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মতো সেশনজটে পীড়িত নয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এমনকি জাতীয়ও নয়, বরং আঞ্চলিক। সত্যিকারের বিশ্ববিদ্যালয় হতে হলে অন্য দেশ থেকে শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রী আকর্ষণ করতে হবে। ১৯৪৭ সালের পর ছাত্রছাত্রীরা নির্বাচনের সময় রাজনীতিতে অংশ নিত ভোটার-প্রশিক্ষকের ভূমিকায়। কিন্তু এখন তারা নিজেরাই অপরাজনীতির হাতিয়ার ও শিকার।
কাউকে যদি আদর্শ হিসেবে নিতে হয়, তাহলে কৃষকই আমাদের আদর্শ হওয়া উচিত। তাঁর হরতালের সময় নেই, রাজনৈতিক কূটতর্ক চালানো বা ককটেল নিক্ষেপের সুযোগ নেই। তিনি ভালোই জানেন, তাঁকে জমি তৈরি করতে হবে, বীজ রোপণ করতে হবে, আগাছা বাছতে হবে এবং সময় হলে ফসল তুলতে হবে। তেমনি যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, তাদের প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব হলো পড়াশোনা ঠিকমতো চালানো। আদিমতা থেকে সভ্যতার দিকে যাত্রা করা মানে একসময় ছিল শুধু তির ছোড়ার পর্যায় থেকে বিষ মাখানো তির ছোড়ার পর্যায়ে উত্তরণ। এখন আমাদের বড় বড় শহরের ‘বিদ্রোহীরা’ বোমা ছোড়ার পর্যায় থেকে পেট্রলবোমা ছোড়ার পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। অন্যরা আমাদের প্রায়ই হুজ্জতে বাঙাল বলে অভিহিত করে। কথাটাকে বাংলায় ঝগড়াটে না বলে আমি বলতে চাই, আমরা হলাম তর্কপ্রিয় বাঙালি। আমরা অন্তহীনভাবে সংলাপের আহ্বান জানাই কিন্তু সমঝোতার শিল্পটা আমাদের জানা নেই। প্রাচীনকালে চীনের উচ্চাভিলাষী তরুণ আমলাদের হস্তলিখন ও তিরন্দাজিতে দক্ষ হতে হতো। এখন আমাদের তারুণ্যের দরকার আপস-মীমাংসা ও বিবাদ নিরসনে অভিজ্ঞ হওয়া। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সমাজবিজ্ঞানী ও সমাজপ্রকৌশলীদের সমন্বয়ে আন্তশাস্ত্রীয় বিভাগ খুলতে পারে।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যতটা মুনাফানির্ভর, গবেষণা ও অনুসন্ধানে তাদের বরাদ্দ ততটাই কম। গত বছর দেশের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মিলিত মুনাফার পরিমাণ ছিল এক হাজার ৮৫০ কোটি টাকা। সে বছর আয়ের মাত্র ২ দশমিক ৩ শতাংশ এবং মোট খরচের ২ দশমিক ৪১ শতাংশ ব্যয় হয়েছে গবেষণায়। বরং দেখা গেছে, অনির্দিষ্ট খাতেই অনেক টাকা ব্যয় হয়েছে, যার হিসাব স্বচ্ছ নয়। ৬৫টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ১৫টির গবেষণা খাতে কোনো ব্যয়ই নেই। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন যথার্থই বলেছে যে উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নে এটা এক প্রতিবন্ধকতা। বিষয়টি ১৯৯২ সালের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় আইনেরও বরখেলাপ। জেনে ভালো লাগল যে ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি গবেষণা বরাদ্দে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে। গত বছর তারা ৭৮ লাখ টাকা গবেষণা খাতে ব্যয় করেছে।
বর্তমানে দেশে ১৯৯২ সালের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় আইনের অধীনে ৭৯টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। সরকার যেহেতু লাইসেন্স দেয়, সেহেতু তাদেরই দায়িত্ব হলো এদের তদারক করে দেখা যে তারা আইনানুগভাবে চলছে কি না। কিন্তু সরকারের নানাবিধ তৎপরতা, বহু রকম ব্যস্ততা এবং অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার অভাবে অথবা নিরেট দলীয় মনোভাবের জায়গা থেকে আইন ভঙ্গকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ নেয় না। এবং তারা একটার পর একটা ব্যতিক্রমের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে যাচ্ছে, যা আইনের বরখেলাপ। কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো নিজস্ব ক্যাম্পাসই নেই, নেই উপযুক্ত পাঠাগার ও গবেষণাগার। বনানীতে আধা কিলোমিটারের মধ্যে রয়েছে নয়টি বিশ্ববিদ্যালয়। কেবল ধানমন্ডি এলাকাতেই রয়েছে ৩০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস।
মান যাই হোক না কেন, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উচ্চশিক্ষার প্রসারিত বাজারের চাহিদা পূরণ করছে। তাদের অনেকেরই রয়েছে চিত্তাকর্ষক নাম এবং সেগুলো চলছে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মতো করে। আজকাল নব্য ধনীদের মধ্যে যেমন সংবাদপত্রের মালিক, টেলিভিশন চ্যানেলের মালিক হওয়ার হিড়িক দেখা যাচ্ছে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাও হয়ে পড়েছে তেমনই এক ব্যাপার। এগুলো তাঁদের অনেকের সামাজিক মানমর্যাদা বৃদ্ধির উপায়।
কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকানা নিয়ে এমন মামলা দেখা যায় যে মনে হয় তাঁরা তাঁদের উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত ধানি জমির শরিকানা নিয়ে লড়াই করছেন।
আমার মতে, সব শিক্ষার্থীকেই মাতৃভাষায় প্রথম শিক্ষা দেওয়া উচিত। প্রথমেই তাদের স্বদেশ নিয়ে জানানোর চেষ্টা করা উচিত, তারপর জানানো উচিত প্রতিবেশীদের নিয়ে এবং তারপর বিশ্বকে। আমাদের মনের মধ্যে কোনো দেশকে দারুল হারব বা দারুল ইসলাম ভাবা উচিত নয়। তার বদলে দরকার দারুল আমান, দারুল আহাদ ও তাকুইয়ের ধারণার বিস্তৃতি।
তরুণ স্নাতকেরা, তোমরা পরিণত হয়েছ এবং তোমরা তোমাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে সক্ষম। আমি তোমাদের রাজনীতি করতে নিষেধ করার মতো আহাম্মক নই। যখন বিদ্যায়তনগুলোজুড়ে অশান্তির সমুদ্র দেখা যাচ্ছে, তখন শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের গৌতমবুদ্ধের মতো মৌন থাকা কঠিন। আমি রাজনীতির বিরুদ্ধে নই। যেকোনো দেশকেই উন্নতি ও জাগরণের জন্য ইতিবাচকভাবে রাজনীতিকৃত হতে হবে। রাজনীতিবিদেরা আমাদের কথা শুনবেন, তাঁরা আমাদের প্রতিনিধিত্ব করবেন এবং আমাদের বন্ধু ও পরামর্শকের মতো দায়িত্ব পালন করবেন। কিন্তু তা আমরা দেখতে পাচ্ছি কোথায়?
একজন প্রবীণ নাগরিক হিসেবে আমি তোমাদের বলছি, তোমাদের উৎসাহিত করছি, যদি সবার আগে তোমরা তোমাদের পড়ালেখার দিকে মনোযোগী হও। তাতেই তোমাদের পিতামাতা, অভিভাবক ও শিক্ষকেরা সুখী হবেন। এটাই তোমাদের প্রধান দায়িত্ব। আমার অবশ্যই তোমাদের হুঁশিয়ার করা উচিত যে আজ আমাদের দেশের সুনাগরিকের খুবই প্রয়োজন। দয়া করে এ কাজে তোমরা গাফিলতি কোরো না। আশা করব এই ঘাটতি তোমরা বাড়াবে না। বরং তোমাদের দ্বারাই সুনাগরিকত্বের পুঁজি শক্তিশালী হবে।
আজকের এই অবস্থা যাতে আমাদের হতাশ না করে। তোমরা বিচলিত হবে না। সাইক্লোন-সিডরের মতোই রাজনৈতিক বিকারগ্রস্তদের এই কর্মকাণ্ড দীর্ঘস্থায়ী হবে না। তারা নিজেরাও নিজেদের রক্ষা করতে ব্যর্থ হবে। তারা ধ্বংসের মুখে অবধারিতভাবে ধাবিত। আমি বলতে চাই, তোমরা সব বাধা অতিক্রম করে তোমাদের পথে এগিয়ে যাবে এবং জয় করবে সবকিছু।
ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির সমাবর্তন উপলক্ষে ইংরেজিতে প্রদত্ত ভাষণের সংক্ষেপিত অনুবাদ
মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান: তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা। সাবেক প্রধান বিচারপতি।