কদিন আগে নিজের এক তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন সরকারি কলেজের আমার এক ইংরেজির অধ্যাপক বন্ধু। তাঁর তিক্ত ওই অভিজ্ঞতা এসেছে গ্রামের এক কলেজে নিয়োগ পরীক্ষা নিতে গিয়ে। তবে তিনি স্বস্তি প্রকাশ করলেন এই বলে যে, মানসম্মান নিয়ে তিনি অন্তত বাড়ি ফিরে আসতে পেরেছেন।
ইংরেজির একটি প্রভাষক পদে নিয়োগের জন্য নিয়ম অনুযায়ী নিয়োগ বোর্ড গঠিত হয়েছে। অধ্যাপক বন্ধু গিয়ে দেখেন, সব সদস্য উপস্থিত আছেন, সবাই স্থানীয় লোক। প্রার্থীরাও উপস্থিত। এক এক করে ডাকা হলো তাঁদের। তাঁদের মধ্যে একজন প্রার্থী মোটামুটিভাবে নিয়োগের উপযোগী; তিনি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সরকারি কলেজ থেকে এমএ করেছেন। ম্যানেজিং কমিটির সভাপতির ভাষ্যে জানা গেল, এই প্রার্থীসহ আরও তিন প্রার্থী রয়েছেন, যাঁরা আজকে নিয়োগ পাওয়া প্রার্থীর সাপোর্টিং হিসেবে অংশ নিচ্ছেন। বস্তুত তাঁরা চারজন বন্ধুকে নিয়োগ পাইয়ে দিতে এসেছেন। কলেজে ইংরেজির শিক্ষকেরা বেশি দিন থাকেন না বলে এবার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আউট ক্যাম্পাস থেকে পাস করা প্রার্থী নিয়োগ করা হবে।
অধ্যাপক বন্ধু মজলিসি কায়দায় বলতে লাগলেন: তাঁদের কাঙ্ক্ষিত প্রার্থীকে আমি একের পর এক অতি সাধারণ প্রশ্ন করলাম। ইংরেজি ব্যাকরণের জ্ঞান দেখে মনে হলো, ন্যাসফিল্ড সাহেবকে তাঁর সমাধি থেকে নতুন করে আবার কাজ করতে হবে আর ইংরেজি সাহিত্যে তাঁর যে দখল, তা থেকে মনে হলো ইংরেজি সাহিত্যের নতুন ইতিহাস তিনি রচনা করতে পারবেন। তাঁর বক্তব্য, শেক্সপিয়ার নাটক ও উপন্যাস ছাড়া আর কিছু লেখেননি। ওয়ার্ডসওয়ার্থের শ্রেষ্ঠ রচনা ম্যাকবেথ। ‘স্কাইলার্ক’ কবিতার রচয়িতা শেলির পরিচয় প্রসঙ্গে ওই প্রার্থীর জবাব, তিনি বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একসময়ের উপদেষ্টা ছিলেন। অধ্যাপক বন্ধু চলে এসেছেন নিয়োগ-প্রক্রিয়া সম্পন্ন না করেই। তিনি জানেন না, এখন তা কী অবস্থায় আছে। বন্ধু রস করে বললেন, ছোটবেলায় আমরা সুকুমার রায়ের ‘বাবুরাম সাপুড়ে’ কবিতা পড়েছি। উচ্চশিক্ষা নেওয়া এসব ডিগ্রি পাওয়া ব্যক্তি সুকুমার রায়ের সেই সাপের মতো যার বিষ নেই, ক্ষতি করার কোনো ক্ষমতা নেই, ফোঁসফাঁস মাত্রই সার সেই সাপের মতো। তাঁর কথা, ওই সরীসৃপসদৃশ ডিগ্রিধারী বানিয়ে লাভ কী?
স্বীকার করতে হবে যে এভাবে ডিগ্রি অর্জনের প্রক্রিয়ার সূত্রপাত ঘটে যখন থেকে ঢাকার কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বাইরে আউট ক্যাম্পাস চালু করে। এখন তো প্রতিটি জেলা শহরেই সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক ক্যাম্পাস ছাত্র ভর্তি করছে এবং ডিগ্রি দিচ্ছে। ইদানীং এই আউট ক্যাম্পাসগুলো শিক্ষার্থী আকর্ষণের জন্য নতুন এক কৌশল শুরু করেছে। বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে যেমন সার বেঁধে নামীদামি চিকিৎসকদের নাম-পদবি লিখে রাখা হয়; এই আউট ক্যাম্পাসগুলোতে তেমনি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় বড় অধ্যাপক পরিচিতি দিয়ে বিশাল আকারের তালিকা বানিয়ে ভবনের সামনে সংরক্ষণ করা হচ্ছে। এতে কাজ হচ্ছে বলে মনে হয়। রাজশাহীতে একটি আউট ক্যাম্পাসে আমার অতি পরিচিত এক অধ্যাপকের নাম দেখে বিষয়টি বলায় তিনি বিস্ময় প্রকাশ করলেন। তিনি জানালেন, তাঁদের অনুমতি তিনি দেননি। ইউজিসিতে লিখিত অভিযোগ করে তিনি এর বিচার চাইবেন।
দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আউট ক্যাম্পাসগুলোর পড়ালেখা যে খুবই নিম্নমানের, তা নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে। কিছুদিন আগে আমিও এক লেখায় আউট ক্যাম্পাসে কী ধরনের পড়ালেখা হচ্ছে, তার এক ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছিলাম। স্নাতক পর্যায়ের দুই শিক্ষার্থী ইংরেজি বিষয়ে চতুর্থ সেমিস্টার শেষ করেছে, অথচ উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের নাম শোনেনি। ওই নামটি শুনেই শিক্ষার্থী দুজন প্রশ্নকর্তার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে ছিল বলে জানতে পেরেছি।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আউট ক্যাম্পাস বন্ধ করার জন্য কোনো উদ্যোগই কার্যকর হয়নি। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন চেষ্টা কম করেনি। মঞ্জুরি কমিশনে যথেষ্ট যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি রয়েছেন, কিন্তু তাঁদের কর্মক্ষমতা বোধ হয় খুবই সীমিত। কারণ দেখা গেছে, পরিকল্পনা গ্রহণ করলেও জটিল বিষয়সমূহ তাঁরা সমাধান করতে পিছপা হন।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের দায়িত্ব অনেক। সরকারি-বেসরকারি উভয় বিশ্ববিদ্যালয় ‘সেন্টার অব এক্সিলেন্স’ হিসেবে গড়ে তোলার পুরো ভার অর্পিত হয়েছে এই কমিশনের ওপর। সীমিত শক্তি আর ক্ষমতার কারণে মর্যাদাসম্পন্ন এই প্রতিষ্ঠানটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সভ্যতার দুর্গ হিসেবে, জ্ঞান-জিজ্ঞাসার আর জ্ঞান বিকাশের কেন্দ্র হিসেবে, মুক্তবুদ্ধির চর্চা আর স্বাধীন চিন্তা পরিচর্যার সূতিকাগার হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ গড়ে তুলতে যথার্থ ভূমিকা রাখতে পারছে না।
দেশে উচ্চশিক্ষা কমিশন গঠন বিষয়ে কথাবার্তা হচ্ছে। অভিজ্ঞজনেরা বলছেন, আদৌ ওই কমিশন গঠনের প্রয়োজন আছে কি? কমিশন প্রণীত হলে তা হবে ১৯৭৩-এর বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশের সঙ্গে অনেকটা সাংঘর্ষিক। তাঁরা আরও বলছেন, ১৯৭৩-এর অধ্যাদেশে জাতির পবিত্র যে আমানত, এতে তার প্রতি অবমাননাই করা হবে। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সার্বিক দেখভালের জন্য মঞ্জুরি কমিশনই যথেষ্ট বলে সবাই মনে করছেন। দেশে সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থা সুষ্ঠু, গতিশীল ও যুগোপযোগী করার স্বার্থে এবং বর্তমান শতকের চাহিদা অনুযায়ী মানবসম্পদ গড়ে তোলার প্রয়োজনে সরকারকে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকেই অধিকতর শক্তিশালী করতে হবে।
ড. সাইফুদ্দীন চৌধুরী: গবেষক। অধ্যাপক, ফোকলোর বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
pr_saif@yahoo.com