কার শাস্তি চাইব? বিচার নাই, বিচার কার কাছে চাইব—কথাগুলো সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত সামিয়া আফরান জামালের বাবা জামাল উদ্দিনের। মেয়ে হত্যার বিচার চান না অসহায় বাবা। কতটা কষ্ট ও হতাশা বুকে চাপা দিয়ে একজন বাবা তাঁর মেয়ে হত্যার বিচার চাইতে অপারগতা প্রকাশ করেন। জামাল উদ্দিনের কোথাও বিচার চাওয়ার জায়গা নেই। কোনো সুস্থ-স্বাভাবিক রাষ্ট্রে এমনটা হওয়ার কথা নয়।
অস্ত্রের ঝনঝনানি, গুম, খুন, অপহরণ, নিরীহ মানুষের মৃত্যু—এসব ঘটনা সাধারণত লাতিন আমেরিকার মাফিয়া নিয়ন্ত্রিত কিছু দেশে দেখা যায়। আমরা দেখি, সেখানে অপরাধের কোনো বিচার হয় না। মাফিয়ারা সব সময় ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও ভাবনার বিষয়, আমরা কি সে অবস্থার দিকে এগোচ্ছি?
এলাকা নিয়ন্ত্রণ, মাদক-বাণিজ্য ও চাঁদাবাজি করতে গিয়ে মাফিয়ারা হরহামেশা খুনোখুনিতে লিপ্ত হয়। লাতিন চলচ্চিত্রে একটি চিত্র প্রায়ই দেখা যায়—বিশাল বড় দাগি মাফিয়া শহরের ব্যস্ততম এলাকা দিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ রাস্তার মাঝখানে ফল বিক্রেতার ভ্যান এসে অযথাই আটকে দিল মাফিয়ার গাড়ি বা কোনো গলিতে যানজট। এর মধ্যেই প্রতিপক্ষের মুহুর্মুহু গুলিতে মাফিয়ার জীবনাবসান। হামলার পর ফাঁকা গুলি ছুড়ে আততায়ী দলের মোটরসাইকেলে ঘটনাস্থল ত্যাগ। সবকিছু হয়ে যাওয়ার পর পুলিশ আসে। এই পুলিশের অনেকেই বিবাদমান মাফিয়াদের চর হিসেবে কাজ করে। এ কারণে এসব হত্যাকাণ্ডের কোনো বিচার হয় না। মারিজুয়ানা, কোকেন, হেরোইন, বনজ সম্পদ পাচারসহ নানা কারণেই লাতিন মাফিয়াদের নানা দল-উপদলের মধ্যে সংঘাত-ঠোকাঠুকি চলতেই থাকে। হত্যা-অপহরণ সেখানে নিত্যদিনের ঘটনা।
এই খুনোখুনির ঘটনার তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হচ্ছে সামিয়ার বাবা বিচার না চাওয়া। সামিয়ার বাবা সবার সামনে দেশের প্রকৃত পরিস্থিতিকে আরও একবার তুলে ধরলেন। কার কাছে বিচার চাইবেন সামিয়ার বাবা, জানেন না। কারণ তিনি মনে করেন, দেশে ন্যায়বিচার নেই। বিচার চাইলে পাবেন তো না-ই, উল্টো নানা হয়রানির শঙ্কা থাকে। তাই বুকে পাথর চেপে তিনি মেয়ের মৃত্যুশোক বয়ে যাবেন।
শাহজাহানপুরে আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম ওরফে টিপু হত্যায় যেন লাতিন সেসব চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যের হুবহু বাস্তবায়ন। টিপু নিজে মতিঝিল এলাকার কুখ্যাত গডফাদার হিসেবে পরিচিত। প্রকাশ্যে হোটেল, রেস্টুরেন্ট, ঠিকাদারির ব্যবসা থাকলেও আড়ালে এলাকা নিয়ন্ত্রণের রাজনীতি ছিল। এলাকার দখল বজায় রাখা নিয়ে প্রতিপক্ষের গডফাদারদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব ছিল। এ দ্বন্দ্বের ফলাফল হচ্ছে টিপু হত্যা। গডফাদারদের খুনোখুনির মধ্যে পড়ে অস্ত্রধারীদের এলোপাতাড়ি গুলিতে টিপুকে বহনকারী মাইক্রোবাসের পাশে রিকশায় বসে থাকা কলেজছাত্রী সামিয়া আফরান জামালের জীবনপ্রদীপ নিভে গেল চিরতরে। একটি সম্ভাবনায় প্রাণের কী করুন সমাপ্তি! একটি পরিবারের স্বপ্নের, আশা-ভরসার অকাল-অবসান।
এই খুনোখুনির ঘটনার তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হচ্ছে সামিয়ার বাবা বিচার না চাওয়া। সামিয়ার বাবা সবার সামনে দেশের প্রকৃত পরিস্থিতিকে আরও একবার তুলে ধরলেন। কার কাছে বিচার চাইবেন সামিয়ার বাবা, জানেন না। কারণ তিনি মনে করেন, দেশে ন্যায়বিচার নেই। বিচার চাইলে পাবেন তো না-ই, উল্টো নানা হয়রানির শঙ্কা থাকে। তাই বুকে পাথর চেপে তিনি মেয়ের মৃত্যুশোক বয়ে যাবেন। এভাবেই শোক বয়ে যাচ্ছেন নারায়ণগঞ্জের ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বি বা দিনদুপুরে পুরান ঢাকায় খুন হওয়া দরজি বিশ্বজিতের স্বজনেরা। সাংবাদিক সাগর-রুনির হত্যার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল ৭৯তম বারের মতো পিছিয়েছে। রুনির মা গত হয়েছেন কোনো বিচার না দেখেই।
সম্ভবত এসব দেখেই সামিয়ার বাবা বিচারের আশা হারিয়েছেন। সৃষ্টিকর্তার কাছে ফরিয়াদ করছেন। এই বিচার না চাওয়া আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থার চরম ব্যর্থতাকে সামনে নিয়ে আসে। বলা যেতে পারে রাষ্ট্রব্যবস্থার ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা উঠে গেছে। এ দেশে বিচার হোক আর নাগরিক অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাই হোক, এগুলো সবার জন্য নয়। এসব সুবিধা একটি বিশেষ ক্ষমতাবাদ শ্রেণির জন্য। হতে পারে রাজনীতির ক্ষমতা অথবা অর্থের ক্ষমতা এসব ক্ষেত্রে কাজ করে। এর বাইরে সাধারণ মানুষের এসবে কোনো অধিকার নেই। আমজনতা আদালতে যেতে চায় না। টিসিবির ট্রাকের পেছনে দাঁড়িয়ে পণ্য পায় না। না আছে খাদ্যের নিরাপত্তা, না আছে জীবনের নিরাপত্তা।
স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপনের প্রাক্কালে সামিয়ার মৃত্যু ও তাঁর বাবার বিচারব্যবস্থার ওপর আস্থাহীনতা আমাদের নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে। যে স্বপ্ন ও চেতনা নিয়ে আমরা রাষ্ট্র নির্মাণ করেছিলাম, তা জনসাধারণের আস্থা অর্জন করতে পারেনি। আমাদের সেই স্বপ্নের রাষ্ট্র দুর্বৃত্তরা ছিনতাই করে নিয়ে গেছে।
গুলিতে নিহত জাহিদুল টিপু নিজেও হত্যা মামলার আসামি ছিলেন। ২০১৩ সালে গুলশানে মার্কেটের সামনে রিয়াজুল হক মিল্কি নামের এক যুবলীগ নেতাকে প্রকাশ্যে হত্যা করা হয়। ওই হত্যা মামলায় জাহিদুল জেলেও ছিলেন। পরে জামিনে বের হয়ে আসেন। এজাহারে নাম থাকলেও চূড়ান্ত প্রতিবেদন নাম ছিল না। হতে পারে ওই দিনই প্রতিপক্ষ টিপুর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে, যা বাস্তবায়ন করেছে গত বৃহস্পতিবার।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, দেশ মাফিয়াদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন বাহিনীর তাণ্ডবে জনজীবন অতিষ্ঠ। আজ খাদিজাকে কোপানো হচ্ছে তো কাল ত্বকীর লাশ পাওয়া যাচ্ছে। নোয়াখালীতে গৃহবধূকে গণধর্ষণ করছে যুবলীগের ক্যাডাররা। সিলেটে ছাত্রলীগের ক্যাডাররা এমসি কলেজে গাড়ির মধ্যে আটকে রেখে ধর্ষণ করছে নববধূকে। আজ পাপিয়া আটক হচ্ছেন এদিকে, কাল ওদিকে আটক হচ্ছেন সম্রাট। এর ফাঁকে বেরিয়ে আসছে প্রতারক সাহেদ ও সাবরিনার গল্প। তার কিছুদিন পর শোনা গেল সাবেক মন্ত্রী মুরাদ হাসানের কুৎসিত কথোপকথন। ঠিক যেন লাতিন আমেরিকার মাফিয়াদের নিয়ে তৈরি চলচ্চিত্রের গল্পের মতোই। গুলি, হত্যা, রাহাজানি, মাদক, যৌনতা, প্রমোদকুঞ্জ, জুয়া, ক্যাসিনো—কী নেই। সবকিছুই আছে আমাদের এখানে।
এ অবস্থার অবসান হওয়া দরকার। এটা রাষ্ট্রকে সুপথে ফিরিয়ে আনার জন্য জরুরি। সাধারণের ভাবনা হতে পারে, রাজনীতিবিদেরা নিজেরা মারামারি করছে, করুক। এতে আমাদের কিছু আসে-যায় না। এ ধারণা ভুল। আমাদের আসে যায়। বাড়ি ফেরার পথে রাজনীতির কোন্দলের কারণে চিরতরে ছবি হয়ে যান সামিয়ারা। এই ছবির সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এসব অন্যায়-অনিয়মের বিরুদ্ধে সবার কথা বলা উচিত। সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ করা প্রয়োজন।
রাজনীতিবিদেরা যা ইচ্ছা, তা-ই করতে পারেন না। তাঁদের আচার-আচরণের লাগাম টানা প্রয়োজন। এই অবস্থার অবসান না ঘটলে একদিন আরও অনেকেই ত্বকী-সামিয়ার মতো ছবি হয়ে যাবে। অথচ চারদিকে আশ্চর্যজনক এক সুনসান নীরবতা বিরাজ করছে। কেউ কোনো কথা বলছে না। আজব এক রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে দেশ। অন্যায়ের কোনো প্রতিবাদ নেই। এত এত অধিকার বিষয় সংগঠন। তাদের কাজটা কী? এখানে সবাই খুব হিসাব-নিকাশ করে মেপে মেপে কথা বলেন। কী বললে কে রাগ করে, সেই ভয়ে তটস্থ সবাই। কিন্তু জনসাধারণের এই ডর কি ভাঙবে না? আমজনতা কি নিজের জন্য, প্রীতির জন্য কথা বলবে না। রাজপথে দাঁড়িয়ে একটিবারের জন্য কি হাঁক ছাড়বে না। না হলে দুর্বৃত্তদের হাত থেকে আমাদের মুক্তি মিলবে কীভাবে!
ড. মারুফ মল্লিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক