সাগরপাড়ে হাজারো শিশুর ‘বাঁচাও’ ডাক!

পর্যটক না আসায় সেন্ট মার্টিনের এই বাবাহারা শিশুরা বেকার হয়ে পড়েছে। তাদের অনেকের আয় রোজগারে সংসার চলে। আচমকা আয় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাদের অনাহারে–অর্ধাহারে দিন কাটাতে হচ্ছে।
ছবি: আবদুল হাফেজ

লকডাউনের সময় কক্সবাজারের পেশাজীবী ঘোড়াদের অনাহারে মৃত্যু দেখে https://tinyurl.com/j34w22v9 অনেকের প্রাণ কেঁদেছে। ঘোড়াদের দুর্ভিক্ষে একটি কোম্পানি এগিয়ে আসায় আপাতত তাদের প্রাণ বাঁচল। তাঁদের ধন্যবাদ। তবে ল্যাম্প ছাড়া যেমন ল্যাম্পপোস্ট হয় না, তেমনি ঘোড়াজীবী অর্থাৎ ঘোড়া খাটিয়ে আয় করা মানুষ ছাড়া ঘোড়াও দেখা যায় না। কক্সবাজার, কুয়াকাটা, পতেঙ্গা কিংবা সেন্ট মার্টিনের সৈকতে অসংখ্য শিশু ঘোড়া চালানোর দিনমজুরিতে নিজের ও পরিবারের পেট চালাত। এখন তাদের কী অবস্থা? অভুক্ত ঘোড়া দেখে আবেগ আসা মধ্যবিত্তের নরম মনের ব্যাপার। কিন্তু খিদে পেটে ঘুরতে ঘুরতে মানবঘোড়া হয়ে যাওয়া শিশুদের জন্যও কি কিছু আবেগ আমরা বরাদ্দ করতে পারি?

স্থানীয় যোগাযোগের মাধ্যমে কথা হলো সেন্ট মার্টিনের তিন এতিম শিশুর সঙ্গে। জহিরের (১২) বাবা মারা গেছেন তুফানে গাছচাপা পড়ে। ওয়াসিমের (১১) কোনো স্মৃতি নেই বাবাকে নিয়ে। ৯ বছর আগে সাগরে মাছ ধরতে গিয়ে মারা যান তিনি। ৩ বছর আগে মালয়েশিয়ায় প্রবাসী শ্রমিক হিসেবে মারা যান জুয়েলের (১০) বাবা। প্রথমজন দিনমজুরি করত লকডাউনের আগে, শেষের দুজন সৈকতে বিক্রি করত পেঁয়াজু বা ডিম বা চা। যখন যা পারত আরকি। বৃহস্পতিবার দুপুরে তিনজনই ছিল না খাওয়া।
কক্সবাজার সৈকতে ফারুক (৯) নামে যে শিশুটি বরই বেচত, সেন্ট মার্টিনে যে নূর মোহাম্মদেরা (১০) জাহাজঘাটায় যাত্রীদের মাল টানত, কিংবা শসা বা ঝালমুড়ি বেচত সৈকতে, তারা কি এখন খেতে পাচ্ছে? খুলনা, কক্সবাজার, টেকনাফ, সেন্ট মার্টিন, চরফ্যাশনে ঘুরেছি আমি। খেয়াল করেছি, অজস্র শিশু এসব জায়গায় পর্যটন কিংবা মাছ ধরার কাজের সঙ্গে জড়িত। জানলাম, এদের বেশির ভাগের বাবাই তাদের মা-কে ছেড়ে চলে গেছে। অনেকের বাবা সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়ে মারা গেছে। পিতা-পরিত্যক্ত শিশুদের সবার কণ্ঠেই ছিল একই দুঃখ, ‘বাবা আমারে চায় না’ অথবা ‘বাবা আমারে নেয় না’।

কেন বাবারা তাদের শিশুদের ছেড়ে চলে যায় কিংবা একেবারেই পরিত্যাগ করে? তারা বলেছে, এলাকায় কাজ না থাকায় তাদের বাবারা চট্টগ্রাম বা ঢাকার মতো বড় শহরে চলে গেছে। সেখানে গিয়ে অনেকেই যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে, অনেকেই নতুন করে বিয়ে করেছে। পুরোনো সংসারের শিশুটির দিকে তখন আর তাদের তাকানোর সময় বা সামর্থ্য নেই।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্ধকার দিকটি তখন চোখে পড়ল। অর্থনীতি ও যোগাযোগের অভূতপূর্ব গতি এসেছে বাংলাদেশে। এর সঙ্গে বেড়েছে কাজের সন্ধানে অভ্যন্তরীণভাবে অভিবাসনের তীব্রতা। লাখো মানুষ দূরদূরান্তে চলে যাচ্ছে কাজের জন্য। বড় অংশটাই হয়তো পোশাকশিল্পে নিয়োজিত। এর বাইরে উত্তরের মানুষ ধান কাটতে আসে ঢাকা ও এর আশপাশের জেলাগুলোতে। কেউ কেউ আর ফেরে না। পোশাকশিল্পের শ্রমিকেরা আবাসনের খরচ কুলাতে না পেরে অনেকে একসঙ্গে থাকেন। নারীদের একটা অংশ নিরাপত্তা ও সাশ্রয়ের স্বার্থে পুরুষ শ্রমিকদের সঙ্গে ঘর বাঁধে। এসব বিয়েকে বলা যায় আপৎকালীন বিয়ে। একা নারীর পক্ষে ঘর ভাড়া করে থাকা কিংবা রাস্তায় চলাফেরা করার ঝুঁকি অনেক। সে ক্ষেত্রে এ ধরনের বিয়েই তাদের জন্য বাস্তব উপায়।

মাছ ধরার ট্রলার ও পর্যটকদের বহন করা সাম্পানে চালকের সহকারি হিসেবে কাজ করত পিতৃহীন শিশুরা। এখন কাজ বন্ধ থাকায় তারা কষ্টে আছে।

কিন্তু অনেকের বিয়েই টেকে না। হয় পুরুষটি অন্য এলাকায় চলে যায় আরও ভালো কাজের জন্য, নয়তো বাড়ি ফিরে যায়। সাময়িক সুবিধার বিয়ের বন্ধন অনেককেই আর ধরে রাখতে পারে না। এসব বিয়ের সন্তানেরা এভাবে পিতাহারা হয়। কিছু ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে মা হয়তো অন্য কারও সঙ্গে চলে গেছে। সন্তান তখন নানির কাছে বড় হয় এবং একটা পর্যায়ে পরিবারের দায়িত্ব নিতে উপার্জনের জন্য বের হয়। চরফ্যাশনে দেখেছি, প্রতিবছর ঝড়–বাদলে অনেক নৌকা ডুবে যায়। যারা আর ফেরে না, তাদের বিধবারা সন্তান নিয়ে বড় বিপদে পড়ে। ছেলে সন্তান হলে তখন তার ভবিতব্য হয় শিশুশ্রম।

জীবনের বহুমুখী মার খেয়ে শৈশব হারানো এসব শিশুদের কেউ কেউ সৈকতে ভ্রমণকারীদের বিনোদনের কাজে নেমে পড়ে। কক্সবাজারের ঘোড়াগুলোকেও এরাই চালায়, এরাই আরোহীদের পেছনে বসে ঘোড়ার লাগাম ধরে রাখে। প্রথম আলোর প্রতিবেদনে অনাহারী ঘোড়াদের পাশাপাশি এসব এতিম বা পিতৃহারা শিশুদের কথাও ছিল। কিন্তু আমরা কেবল ঘোড়ার কষ্ট দেখলাম, শিশুদের উদরের জ্বালা কজন দেখলাম? আর কেউ না দেখুক, জেলা প্রশাসনসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো তো এদের খোঁজ নিতে পারত। আপনারা লকডাউন দেবেন, কিন্তু সেটা মান্য করার ক্ষতিপূরণ অভাবীদের কেন দেবেন না? আর যদি সেই অনাহারীরা শিশু হয়, তখন উপেক্ষা করা তো অমানবিকতা।

পুনশ্চ: এসব গরিব ও এতিম বাচ্চাদের বড় অংশটাকেই কিন্তু ধারণ করে ইবতেদায়ি ও কওমি মাদ্রাসাগুলো। কওমিতে রয়েছে প্রায় ১৪ লাখ শিক্ষার্থী। এদের বেশির ভাগেরই পরিবারের পক্ষে তাদের খাবার জোগানো কঠিন। যাদের বাড়িঘর বা ঠিকানা আছে তারা হয়তো লকডাউনে বাড়ি চলে গেছে। কিন্তু সেখানে কীভাবে তাদের পেট চলছে? যাদের কেউ নেই সেই সব এতিম কিশোর-কিশোরীরাই বা এখন কোথায়, কীভাবে দিন গুজরান করছে? তাদের অভুক্ত পেটের এসওএস বার্তা কি কেউ শুনতে পাচ্ছে?

ফারুক ওয়াসিফ লেখক ও সাংবাদিক।
faruk.wasif@prothomalo.com
আরও পড়ুন: এতিম ও পথশিশুদের ভুবন: বাবা আমারে চায় না https://tinyurl.com/caexc52v