হামবুর্গের লেন্ডেন্সব্রোগেন পাতাল সাবওয়ে স্টেশন থেকে বের হতেই এলবে নদীর নির্মল বাতাস এসে ঝাপটা দিল। সঙ্গে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির ছাট। পাশের লঞ্চ টার্মিনালের কোনায় দাঁড়িয়ে থাকা এক নিরাপত্তারক্ষীকে গন্তব্যস্থল হোটেল ওয়ানের কথা বলতেই তাঁর প্রশ্ন, তুমি সাংবাদিক? হ্যাঁ বলার পরপরই যে উত্তর শুনেছিলাম, তার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না।
সাদা পাকা চুলের সেই নিরাপত্তারক্ষী বলেছিলেন, দুদিনে অন্তত কয়েক শ সাংবাদিককে তিনি এই হোটেলের গন্তব্যস্থল দেখিয়ে দিয়েছেন। তিনি এ–ও বলেছিলেন, একটা সাধারণ হোটেলের ঠিকানাই যদি বুঝতে না পারো, তাহলে সাংবাদিক হয়ে তুমি খুঁজবেটাই বা কী? গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্ট নেটওয়ার্কের (জিআইজেএন) উদ্যোগে আয়োজিত পাঁচ দিনব্যাপী এক কনফারেন্সে যোগ দিতে গত সেপ্টেম্বরে যেতে হয়েছিল হামবুর্গে। আমার প্রথম ইউরোপ যাত্রা। সিনেমায় দেখা পাশ্চাত্যের দেশে যাওয়ার রোমঞ্চকর অনুভূতি যেমন কাজ করছিল, তেমনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বাঘা বাঘা অনুসন্ধানী সাংবাদকিদের সঙ্গে সাক্ষাতের উত্তেজনাটাও কম ছিল না। জার্মানিতে যাওয়া–আসা এবং পাঁচ দিনের থাকা–খাওয়ার খরচ বহন করেছিল জিআইজেএন।
বিশ্বের অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের নিয়ে ২০০৩ সালে গঠিত জিআইজেএনের ১১৩ম আয়োজন ছিল এই সম্মেলন। এর ট্যাগ লাইন ছিল ‘১১তম গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম কনফারেন্স’। জার্মানির নেটজোয়ার্ক রেশের্সে ও ইন্টারলিংক একাডেমি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডায়ালগ অ্যান্ড জার্নালিজমও ছিল এ আয়োজনের সহযোগী। ১৩০টি দেশ থেকে দেড় হাজারের বেশি সাংবাদিক এসেছিলেন এ সম্মেলনে। ২৫০টির বেশি প্যানেল, ওয়ার্কশপ ও নেটওয়ার্কিং সেশনে কথা বলেন অভিজ্ঞ সাংবাদিক ও বিশেষজ্ঞরা। নাৎসি শাসক অ্যাডলফ হিটলারের দেশে বসে তাঁরা বাতলে গেছেন ঘটনার পেছনের ঘটনা খোঁজার নানা কলাকৌশল।
হামবুর্গের ওই সম্মেলনে বিশেষজ্ঞরা বললেন, বিশ্বজুড়ে মানবাধিকার, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর হুমকি-হামলা বেড়েই চলেছে। স্বৈরশাসকেরা সাংবাদিকদের প্রধান শত্রু হিসেবে দেখছেন। তবে সত্য প্রকাশে থমকে যাওয়া যাবে না। নতুন ভাবনা-প্রযুক্তিতে নিজেদের সমৃদ্ধ করে রুখে দাঁড়াতে হবে। অন্তর্জালে মিথ্যার বেসাতি দিন দিন বাড়ছে। সাংবাদিকদের ওপর মানুষের আস্থাও কমে গেছে। সাংবাদিকদের সত্য প্রতিষ্ঠার লড়াই তাই সামনে কঠিন।
দীর্ঘ ভ্রমণের ক্লান্তি ও গন্তব্যে পৌঁছানোর তাড়ার কারণে জার্মানির সেই বয়স্ক নিরাপত্তারক্ষীর সঙ্গে তখন আলাপটা জমেনি। তবে এটা দিব্যি বলতে পারি, তাঁর সেই মন্তব্য পরবর্তী কয়েকটি দিন মাথায় বারবার ঘুরপাক খেয়েছে। মনে হলো, সাংবাদিকেরা সবকিছু জেনে যাবেন—এটা আসলে অনেকটা বৈশ্বিক মনস্তত্ত্ব। দেশে দেশে স্বৈরশাসক, ডান রাজনৈতিক শক্তির উত্থানের এই সময়ে সাংবাদিকদের ওপর যুগপৎ আস্থা ও হতাশাও তাই বেশি।
২৫ সেপ্টেম্বর হামবুর্গের হাফেনসিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের হোলসিম হলে উদ্বোধনী বক্তব্য দিয়েছিলেন জিআইজেএনের নির্বাহী পরিচালক ডেভিড কাপলান। স্বাধীন অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ধারণার অন্যতম প্রবর্তকও বলা হয় তাঁকে। উদ্বোধনী বক্তব্যে তিনি বলছিলেন, সাংবাদিকদের ওপর হামলা রেকর্ড পরিমাণে বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যের মতো দেশে আইনি হেনস্তার মুখে পড়তে হচ্ছে। স্বৈরশাসক হয়ে উঠতে চাওয়া শাসকেরা এগুলো করছেন। সামনের সারিতে থাকা অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের জন্য তাই খুব কঠিন সময় যাচ্ছে।
কাপলান বলছিলেন, একনায়কেরা যদি মনে করেন, সাংবাদিকেরা হারিয়ে যাচ্ছেন, তাহলে তাঁদের জন্য বিস্ময়ই অপেক্ষা করছে। আসলে সাংবাদিকদের শক্তিবৃদ্ধি হচ্ছে। এখন এমন অনেক সাংবাদিক আছেন, যাঁরা আরও ভালোভাবে প্রস্তুতি নিয়ে কঠিন কঠিন লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন। পুরো বিশ্বেই এ ঘটনা ঘটছে।
আবার সাংবাদিকদের ওপর মানুষের বিশ্বাসের জায়গাটিতেও ভাঙন ধরেছে বিশ্বব্যাপী। এ জায়গাটি পুনরুদ্ধারে কাজ করার বিভিন্ন পরামর্শ এসেছে এই সম্মেলন থেকে। জার্মানির সাময়িকী ডের স্পিগেলের ন্যাশনাল ডেস্ক এডিটর কোরদুলা মায়ার বলেছেন, ‘যদি মানুষ তথ্য-প্রমাণকেই আর বিশ্বাস না করে, তাহলে আমরা সত্যিই হারিয়ে গেছি। জার্মানিতে মোট জনসংখ্যার পাঁচ ভাগের এক ভাগ মানুষ সাংবাদিকদের বিশ্বাস করে না। তাদের কেউ কেউ আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে। যুক্তির কথা দিয়ে আমরা তাদের কাছে পৌঁছাতে পারছি না। তবে কারও কারও কাছে এখনো পৌঁছানো যায়। আমাদের সব রকমের পদ্ধতি ব্যবহার করে সংবাদ নিয়ে আলোচনায় আসতে হবে। আমাদের স্কুলে স্কুলে যেতে হবে। দক্ষিণ জার্মানিতে আমরা এরই মধ্যে এ রকম উদ্যোগ নিয়েছি। আমরা কীভাবে কাজ করি, সে সম্পর্কে জানাচ্ছি স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের।’
অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা যাঁরা করেন, তাঁদের জন্য একটি কার্যকর ও টেকসই পরিবেশ গড়ে তোলার কথা বারবার উঠে এসেছে সম্মেলন থেকে। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের প্রসঙ্গও সামনে এসেছে। সম্মেলনে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়। ২৫০টি সেশনের ৬৩টিই ছিল প্রযুক্তিসংশ্লিষ্ট। স্প্রেডশিট-পাইথনের মতো ডেটা জার্নালিজমের কৌশল থেকে শুরু করে অনলাইন সার্চিং, ভুয়া তথ্য যাচাই ও স্যাটেলাইটের ছবি ব্যবহার করে অনুসন্ধানের সুযোগ তুলে ধরা হয়।
অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন রিপোর্টিং প্রজেক্টের সহপ্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান সম্পাদক ড্রিউ সুলিভান বলছিলেন, ‘আমরা দেখব যে বিভিন্ন জাতিরাষ্ট্র ও কোম্পানি সংবাদ তৈরি করছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে সংবাদ তৈরি করা হচ্ছে। চারদিক থেকে এত এত সংবাদ আসবে যে অনুসন্ধানী সাংবাদিক কারা, কী করি—তা হারিয়ে যেতে বসবে। আমাদের এসব তথ্যবিভ্রান্তি পেরোতে হবে। এ জন্য দরকার হবে নতুন নতুন প্রযুক্তি ও কৌশল।’
সাংবাদিকদের নিয়ে জার্মান নিরাপত্তাকর্মীর ক্ষোভ ও হতাশার সেই মন্তব্যের মধ্য দিয়ে সম্মেলন শুরুর আগেই একটি ঘোরের মধ্যে ঢুকেছিলাম। ঘোরটি ছিল নিজের সাংবাদিকতা নিয়ে, নিজ দেশের সাংবাদিকতা নিয়ে। তবে পাঁচ দিনব্যাপী এই সম্মেলনে অংশ নেওয়া অনেক সাংবাদিকই বলেছেন, রাষ্ট্রযন্ত্রের চাপ তাঁদের ওপর দিন দিন বাড়ছে। তথ্য প্রকাশের সুযোগ সীমিত হয়ে আসছে। তবে সত্য প্রকাশে তরুণ ও বাঘা সাংবাদিকদের মনোবলে যে একটুও ফাটল ধরেনি, তা বোঝা গেছে নানা আলাপচারিতায়।
অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের নিয়ে জিআইজেএনের এই বৈশ্বিক সম্মেলন দুই বছর অন্তর অনুষ্ঠিত হয়। ২০২১ সালে অনুষ্ঠিত হবে পরবর্তী সম্মেলন। আবার সাংবাদিকেরা জড়ো হবেন নিত্যনতুন ভাবনা ও অনুসন্ধানের নানা কৌশল নিয়ে।