মত দ্বিমত

সরকারকে পরামর্শ দিতে পারেন তিনি

রাজনীতি
রাজনীতি

সম্প্রতি রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনের সঙ্গে বৈঠকে নির্বাচন ও সংলাপ নিয়ে কিছু বক্তব্য দিয়েছেন, যা রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে৷ এ বিষয়ে দুজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর অভিমত এখানে দেওয়া হলো:
নিউইয়র্কে জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুনের সঙ্গে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের বৈঠকের খবরটি আমরা জেনেছি তাঁর প্রেস সচিব ও বিভিন্ন গণমাধ্যমের বরাতে৷ মহামান্য রাষ্ট্রপতি বান কি মুনের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে ঠিক কী বলেছেন, সেটি তিনিই জানেন৷ তবে রাষ্ট্রপতিকে আমরা যতটুকু জানি, তিনি একজন প্রাজ্ঞ ব্যক্তি ও প্রবীণ রাজনীতিক৷ এর আগে জাতীয় সংসদের স্পিকার হিসেবে অত্যন্ত বিচক্ষণতা ও নিরপেক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন৷ দলমত-নির্বিশেষে তিনি সবার আস্থা অর্জন করেছেন৷
রাষ্ট্রপতি পদে আসীন থেকেও তিনি এমন কিছু করেননি, যাতে তাঁর প্রতি জনগণের সেই আস্থা নষ্ট হতে পারে৷ এর আগে বিএনপিদলীয় রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন দলীয়করণের মাধ্যমে ২০০৭ সালের নির্বাচনটিই ভন্ডুল করেননি, তিনি প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার জন্য সংবিধানও লঙ্ঘন করেছিলেন৷
গণমাধ্যমে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের বরাতে যে বক্তব্য এসেছে, তার দুটি দিক আছে৷ এক. ৫ জানুয়ারির নির্বাচনটি দেশের মানুষ মেনে নিয়েছে৷ দুই. সরকারের মেয়াদ শেষে বিরোধী দলের সঙ্গে অালোচনা হতে পারে৷
আমি মনে করি, তাঁর বক্তব্যের প্রথম অংশ নিয়ে বিতর্কের সুযোগ নেই৷ দেশের মানুষ নির্বাচন মেনে নিয়েছে, তার বড় প্রমাণ এই নির্বাচনের বিরুদ্ধে কোনো আন্দোলন হয়নি, কেউ রাস্তায় নেমে আসেনি৷ নির্বাচনের আগে বিরোধী দল যেভাবে চলন্ত বাসে আগুন দিয়ে জীবন্ত মানুষ হত্যা করেছে, যেভাবে হরতালের নামে দেশের অর্থনীতি ধ্বংস করেছে, তাতে নির্বাচনের পর জনগণ স্বস্তিই ফিরে পেয়েছেন৷ সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির বক্তব্যে জনমতেরই প্রতিফলন ঘটেছে বলে মনে করি৷
বলার অপেক্ষা রাখে না যে কেবল দেশের মানুষ নয়, বিদেশি রাষ্ট্রগুলোও িনর্বাচন মেনে নিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপানসহ যেসব দেশ সবার অংশগ্রহণে নির্বাচন চেয়েছিল, তারাও এখন বলছে, এই সরকারের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী৷ এমনকি হাইকোর্টে নির্বাচনের বৈধতা নিয়ে যে রিট হয়েছিল, সেটিও খারিজ হয়ে গেছে৷ আদালত বলেছেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বৈধ৷
তবে রাষ্ট্রপতির বক্তব্যের দ্বিতীয় অংশে ছিল বিরোধী দলের সঙ্গে সংলাপের বিষয়টি৷ রাষ্ট্রপতি দেশের এক নম্বর ব্যক্তি এবং তাঁকেই রাষ্ট্রের অভিভাবক হিসেবে বিবেচনা করা হয়৷ যদিও সংসদীয় গণতন্ত্রে তাঁর তেমন ক্ষমতা নেই৷ প্রধানমন্ত্রীই রাষ্ট্রের নির্বাহী প্রধান৷ রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণী বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীকে পরামর্শ ও উপদেশ দিতে পারেন৷ কিন্তু কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে পারেন না৷ সে ক্ষেত্রে এসব বিষয়ে রাষ্ট্রপতির সরাসরি বক্তব্য না দেওয়াই ভালো৷
অন্যদিকে রাষ্ট্রপতির বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর রাষ্ট্রপতির প্রতি বিশ্বাসভঙ্গের অভিযোগ করেছেন, সেটি একেবারেই অগ্রহণযোগ্য৷ রাষ্ট্রপতি এখানে জনগণের সঙ্গে কোথায় বিশ্বাস ভঙ্গ করলেন? বরং জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসভঙ্গের ঘটনা বিএনপিই ঘটিয়েছে নির্বাচন বর্জন করে৷ নির্বাচনের আগে তারা অান্দোলনের নামে দেশব্যাপী যে নৈরাজ্য তৈরি করেছিল, নির্বাচনের পর তার অবসান হয়েছে৷ জনমনে স্বস্তি ফিরে এসেছে৷
এটি অবশ্যই ইতিবাচক দিক৷ বর্তমানে দেশে স্থিতিশীল পরিবেশ রয়েছে, তাও কেউ অস্বীকার করবেন না৷ তবে প্রধান বিরোধী দলকে সংসদের বাইরে রেখে এই স্থিতিশীলতা কত দিন বজায় রাখা যাবে, সেটি ভাবনার বিষয়৷ গত রোববার বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ঈদের পর হরতালের ডাক দেবেন বলে আগাম ঘোষণা দিয়েছেন৷ সে ক্ষেত্রে সংসদের বাইরে থাকা বিরোধী দলকে কীভাবে নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করা যায়, সে বিষয়টিও ক্ষমতাসীনদেরও ভাবতে হবে৷ আবার বিএনপির নেতৃত্বকেও ৫ জানুয়ারির নির্বাচন-পরবর্তী বাস্তবতা মানতে হবে৷ সরকার অবৈধ, সংসদ অবৈধ—এ ধরনের কথাবার্তা না বলে তাদের উচিত হবে আলোচনার মাধ্যমে একটি সমঝোতায় আসা৷ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচনের আগে সেই সমঝোতার ব্যাপারে ইঙ্গিতও দিয়েছিলেন৷ উভয় পক্ষ একমত হলে সুবিধাজনক সময়ে সবার অংশগ্রহণে আরেকটি নির্বাচন হতে পারে৷
সে ক্ষেত্রে বিএনপিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে গো না ধরে বর্তমান সংবিধানের আওতায়ই একটি উপায় খুঁজে বের করতে হবে৷ বিএনপি নেতৃত্ব যদি মনে করে থাকেন, জামায়াতে ইসলামী ও অন্যান্য ডানপন্থী দলকে নিয়ে আন্দোলন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায় করবেন, সেটি ভুল হবে৷ কেননা, জামায়াতে ইসলামীর ভিন্ন এজেন্ডা আছে৷ নতুন নির্বাচনের চেয়ে তারা যুদ্ধাপরাধের বিচার বন্ধেই সচেষ্ট থাকবে৷ তাই বিরোধী দলকে গঠনমূলক রাজনীতির প্রতিই মনোযোগী হতে হবে৷ আর ক্ষমতাসীন দলটিরও উচিত হবে, তাদের জন্য সেই সুযোগ করে দেওয়া৷ কিন্তু উভয় পক্ষ নিজ নিজ অবস্থানে অনড় থাকলে দেশে এখন যে স্থিতিশীল অবস্থা আছে, তা ধরে রাখা কঠিন হবে৷ সবাইকে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থের ঊর্ধ্বে থেকে বৃহত্তর জনগণের স্বার্থের কথাই ভাবতে হবে৷
ড. হারুন-অর-রশিদ: রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, উপাচার্য, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়৷