বৃক্ষ বিনাশ

সবুজ বন্ধুদের কালো শত্রু

আফ্রিকার আদিবাসী, লাতিন আমেরিকার প্রাচীন জনগোষ্ঠী, অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী সমাজ এখনো বিশ্বাস করে, বৃক্ষ থেকেই তাদের জন্ম ও উৎপত্তি। চর্যাপদের কবি লুইপাদ মানুষের শরীরকে গাছের সঙ্গে তুলনা করেছেন। বৃক্ষ ছাড়া কি আমাদের এক মুহূর্তও চলে? বেঁচে থাকাই তো অসম্ভব। আমরা বেঁচে আছি তো বড়সড় ঘাসের বীজ—ধান বা গম খেয়ে। সোজা কথা, গাছপালার কাছেই আমাদের জীবন-জীবিকা অনেকটা বাঁধা। আমরা গভীরভাবে ভাবি না বলেই বিষয়টি উপলব্ধিতে আসে না। অথচ আমরা এতটাই অকৃতজ্ঞ যে ওদের এসব অবদান উপেক্ষা করে রীতিমতো বৃক্ষ হত্যায় নেমেছি। আন্দোলন-সংগ্রামের নামে গত কয়েক মাসে সারা দেশে লক্ষাধিক গাছ কাটা হয়েছে। প্রথম আলোয় এ বিষয়ে অনেকগুলো প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। এ ছাড়া গত ৩০ নভেম্বর এবং ৭ ডিসেম্বর দুটি প্রতিবেদনে বরগুনার পাথরঘাটায় শ্বাসমূলীয় ও টাঙ্গাইলের সখীপুরে শালবনের লক্ষাধিক গাছ উজাড় করে বন দখলের খবরও প্রকাশিত হয়েছে। তবে শুধু আন্দোলনের নামে কেটে ফেলা গাছের বাহ্যিকভাবেই আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৩৫ কোটি টাকার মতো। কিন্তু তাতে শুধু পরিবেশের যে বিপুল ক্ষতি হলো, তার ফিরিস্তি বিশাল।
এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে এমন বর্বরোচিত কাজ কোনো অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য নয়। যারা এ ধরনের অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাদের প্রচলিত
আইনে বিচার হওয়া উচিত। অপরাধীরা আমাদের চারপাশেই ঘোরাফেরা করছে। তাদের আইনের হাতে সোপর্দ করতে সহযোগিতা করুন। অপরাধীরা একবার সাজা পেলে ভবিষ্যতে অন্যরা এ ধরনের কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকবে।
আমরা আসলে ইতিহাস থেকে কোনো শিক্ষাই নিতে পারিনি। প্রতিবেশী দেশ ভারতে অযাচিতভাবে বন উজাড়ের বিরুদ্ধে স্থানীয় নৃগোষ্ঠী একটি ঐতিহাসিক আন্দোলন করেছিল। এটি চিপকো আন্দোলন নামে পরিচিত আর সময়টা ১৭৩১ সাল। যোধপুরের রাজা নতুন প্রাসাদ নির্মাণের জন্য কাঠুরিয়াদের একটি বনে পাঠিয়েছিল। সেই বনের পাশেই ছিল বিষ্ণুসম্প্রদায়ের বসবাস। গাছ কাটার খবর পেয়ে অমিতাদেবী নামে সেই সম্প্রদায়ের এক তরুণী-মা তাঁর তিন মেয়েকে নিয়ে গাছ জড়িয়ে ধরে না কাটার জন্য মিনতি জানাতে থাকেন। কিন্তু রাজার কাঠুরিয়ারা গাছের সঙ্গে ওদের চারজনকেই কেটে ফেলে। সন্ধ্যা নামতে না-নামতে সেই গ্রামের আরও ৩৬৩ জন গাছের জন্য প্রাণ বিসর্জন দিল। সুমহান আত্মত্যাগ। বৃক্ষ ও পরিবেশ সংরক্ষণে আমরা এর সিকি ভাগ আত্মত্যাগের দৃষ্টান্তও স্থাপন করতে পারিনি।
আমরা এখন এমন একটা সময়ে এসে দাঁড়িয়েছি যখন গাছ কাটলে, পাখি বা প্রাণী হত্যা করলে, পরিবেশদূষণ করলে মানুষ প্রতিবাদ করেন, বিক্ষোভ করেন, ঠিক তখনই আন্দোলনের নামে কেটে ফেলা হলো এতগুলো গাছ। শুধু তা-ই নয়, উন্নত দেশগুলো যখন একটি মাত্র বৃক্ষ বা প্রাণীর জীবন বাঁচানোর জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে, দেশের সব প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষায় সর্বাত্মক ভূমিকা রাখে, তখন আমাদের দেশে এক-দুটি নয় হাজার হাজার বৃক্ষ আন্দোলনের বলি হয়। আমরা বিস্মিত ও হতবাক। এ আবার কেমনতর আন্দোলন? যে আন্দোলন দেশের ক্ষতি ছাড়া কোনো কল্যাণ বয়ে আনে না, প্রাকৃতিক পরিবেশকে হুমকির মুখে ঠেলে দেয়, এমন আন্দোলন কি সমর্থনযোগ্য?
দেশের সাধারণ মানুষ যাঁরা নিঃস্বার্থভাবে দেশকে ভালোবাসেন, তাঁদের হাহাকার করা ছাড়া আর কীই-বা করার আছে। বগুড়ার নজিবুর রহমান, রাজশাহীর আনোয়ার হোসেন, লক্ষ্মীপুরের মাসুদ আহমেদ, রংপুরের দীপেন সাহা, জয়পুরহাটের সারোয়ার মুস্তাফিজসহ আরও অনেকেই উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চান, এই নিরীহ গাছগুলোর কী অপরাধ? তাঁদের কী জবাব দিই। বলার আছেই বা কী। আন্দোলনের নামে এতগুলো গাছ কাটা আমাদের দেশে তো বটেই, পৃথিবীর ইতিহাসেও সম্ভবত নজিরবিহীন।
এ ক্ষেত্রে আন্দোলনের বলি প্রধানত পথপাশের গাছগুলোই। আমাদের তো আর উন্নত দেশের মতো পরিকল্পিত ঝকঝকে আধুনিক কোনো মহাসড়ক নেই। যেখানে পথের পাশে কয়েক স্তরে বৃক্ষরোপণ করে পথটি পরিবেশবান্ধব করার চেষ্টা করা হয়। প্রসঙ্গত প্যারির সাজেঁ লিজেঁর দৃষ্টান্ত উল্লেখ্য। প্রায় ২৫০ ফুট চওড়া এ পথের দুধারে ৩১ ফুট ফুটপাত, তারপর এক সারি গাছ, ৩৮ ফুট সমান্তরাল ঘাসের লন, আবার এক সারি গাছ এবং শেষে মাঝের ৮৫ ফুট গাড়িপথ। তা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যকে সম্পৃক্তকারী প্রধান প্রধান সড়কগুলোর দুই পাশেও প্রায় একই দৃশ্য চোখে পড়ে। সেখানে কয়েক স্তরে বৃক্ষরোপণ করে খানিকটা বুনো পরিবেশ তৈরির চেষ্টা করা হয়। হঠাৎ যে কারোই মনে হবে, পথটি কোনো গভীর বনের ভেতর দিয়ে। আদতে তা নয়। পথ ছাড়িয়ে খানিকটা দূরেই লোকালয় বা বিরান শস্যভূমি। তবু আমাদের যা কিছু আছে,
তাই আমাদের রাষ্ট্রীয় সম্পদ। এ দেশের এক মুঠো মাটি বা এক টুকরো কুটোও আমার সম্পদ। দেশের সম্পদ লুণ্ঠন করে তাৎক্ষণিকভাবে ভালো থাকা যায় মনে করা হলেও আদতে এর নেতিবাচক ফল সবাইকে ভোগ করতে হয়।
আধুনিক বর্বরতার বিরুদ্ধে নিজের প্রকৃতি ও পরিবেশকে অক্ষুণ্ন রাখতে সচেষ্ট আরেকটি নৃগোষ্ঠীর সংগ্রামের কথা বলে শেষ করছি। ১৮৫৪ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট সিয়াটলে বসবাসকারী আদিবাসীদের নিজের বসতি ছেড়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেন। কারণ, সেখানে তৈরি হবে আধুনিক শহর। প্রেসিডেন্টের নির্দেশের জবাবে আদিবাসী সর্দার একটি চিঠি লেখেন তাঁকে। সর্দারের পাঠানো এই চিঠি পৃথিবীর ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিলের মর্যাদা পেয়েছে। এই চিঠি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কোনো কবিতার মতো। এর মধ্যে আছে ভাব, আবেগ, ভালোবাসা, সত্য ও দর্শন। সেখানে বলা হয়েছে, ‘পৃথিবী মানুষের সম্পত্তি নয় বরং মানুষই পৃথিবীর। ...কী করে তোমরা বেচাকেনা করবে আকাশ, ধরিত্রীর উষ্ণতা? আমরা তোমাদের চিন্তা বুঝতে পারি না। বাতাসের সতেজতা, জলের ঝিকিমিকি—আমরা তো এগুলোর মালিক নই, তবে তোমরা (আমাদের থেকে) এগুলো কিনবে কেমন করে?’ সত্যি মাতৃভূমির পরতে পরতে ছড়িয়ে থাকা নিখাদ ভালোবাসার কি কোনো বিনিময় মূল্য থাকে? আসুন, আমরা সবাই গভীর মমতায় নিজের দেশকে ভালোবাসি। দেশ ভালো থাকলে আমরাও ভালো থাকব।

মোকারম হোসেন: প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক। সাধারণ সম্পাদক: তরুপল্লব।
tarupallab@gmail.com